'কোনো লেখাই আমি শেষ করতে পারিনি'

বেলাল চৌধুরী (১২ নভেম্বর ১৯৩৮—২৪ এপ্রিল ২০১৮)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম, ১৯৭৯
বেলাল চৌধুরী (১২ নভেম্বর ১৯৩৮—২৪ এপ্রিল ২০১৮)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম, ১৯৭৯
>আমৃত্যু বাউণ্ডুলে ছিলেন তিনি। বেলাল চৌধুরী। ষাট দশকের অন্যতম এই কবি মারা গেছেন সম্প্রতি। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমাদের আয়োজন

এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল বেলাল চৌধুরীর পল্টনের বাসায়, ২০১১ সালে। তখন কবির স্মৃতি ছিল উজ্জ্বল। জীবনের নানা গল্প তিনি মেলে ধরেছিলেন এ কথোপকথনে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন লোপা মমতাজ

লোপা মমতাজ: আপনার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক গল্প, ঘটন আর অঘটনও। নানা রকম দুরন্তপনায় ঘেরা আপনার জীবন। আপনার ছেলেবেলাটা কেমন ছিল?

বেলাল চৌধুরী: আমারছেলেবেলাটা আর পাঁচজনের মতোই। গ্রামে জন্ম নেওয়া একটা ছেলে যেমন হয়। আমাদের বাড়িটা ছিল খুবই অদ্ভুত। গাছগাছালিতে ঘেরা বাড়ি। দুটো পুকুর ছিল। ওই বাড়িতে আমি যখন জন্মালাম, মা আমাকে পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন। কারণ, বাড়িতে আর কোনো লোকজন তখন ছিল না। আমার বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। রেলে চাকরি করতেন। রেলে রেলে ঘুরতেন। মাঝে মাঝে বাড়ি আসতেন। তাই বলা যায়, বাল্যকালটা আমি গ্রামে আমার আম্মার কাছেই কাটিয়েছি। ছেলেবেলার একটা ঘটনা বলি: একদিন দুপুরবেলা আমাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে দেখা গেল, আমি পালঙ্কের নিচে। ঘটনা কী? ওখানে খাবার রাখা ছিল। আমি ওই খাবার নিয়ে এতই মশগুল ছিলাম যে কোনো দিকে আর খেয়াল ছিল না।

লোপা: এপার বাংলা, ওপার বাংলা—দুই জায়গাতেই সমান পদচারণ ছিল আপনার। সেই সময়ের কিছু কথা বলেন।

বেলাল: এপার বাংলা, ওপার বাংলা—আজ এটা বলা যত সহজ, আমি যে সময়ে ছিলাম, তখন পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন রকম। এপার বাংলা, ওপার বাংলা বলতে সে সময় ছিল মুখ দেখাদেখি বন্ধ। পাকিস্তান আমল সেটা। পাকিস্তান আমলে আমি জেল-টেল খেটেছি রাজনৈতিক কারণে। জেল খেটে তারপর একটা সময় ব্যবসার চেষ্টা করেছি। চট্টগ্রামে ছিলাম। তারপর সমুদ্রে মাছ ধরার কাজ করেছি। ওই কাজ করতে করতেই ট্রলারে চেপে চলে গিয়েছিলাম কলকাতায়। সেখানেই আমি থেকে যাই। আমার স্বপ্ন ছিল আমেরিকায় যাওয়ার। কিন্তু কলকাতার প্রেমে পড়ে গেলাম, আমেরিকায় আর যাওয়া হলো না। কফি হাউসে আমি কিন্তু একা একা গিয়েছি, আমাকে কেউ নিয়ে যায়নি। বইপত্র নেড়েচেড়ে দেখাটা আমার নেশা ছিল। সেটা দেখতে দেখতেই কফি হাউসে পৌঁছে গেলাম। ওখানে গিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়সহ আরও কয়েকজন লেখকের সঙ্গে পরিচয় হলো। শক্তি তখন আন-ক্রাউন কিং—মুকুটহীন রাজার মতো। পরে আস্তে আস্তে উৎপলকুমার বসুর সঙ্গে আলাপ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন আমেরিকায় ছিলেন। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে অনেক পরে।

এই কফি হাউসেই প্রথম দেখলাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। তাঁকে এখানে দেখে আমি তো অবাক, তিনি এখানে! তিনি তখন নামজাদা তারকা। অপুর সংসারে অভিনয় করে খুব নামডাক হয়েছে। পরে কিন্তু সৌমিত্রর সঙ্গে ভাব জমে গেল।

যা হোক, কলকাতায় আমার পরিচিতি ও বন্ধুবান্ধব—দুই-ই বাড়তে থাকল। ঘুরে বেড়াতে লাগলাম শহরের আনাচে-কানাচে। কলকাতায় অনেক জায়গাতেই আমি ছিলাম। এ নগরে এত ঘুরেছি যে একসময় নগরটি আমার কাছে খুব ছোট শহর হয়ে গিয়েছিল।

লোপা: কথাসাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা বই আছে—স্বর্গে তিন পাপী। আমরা জানি, এই তিন পাপীর এক পাপী আপনি। আর দুজন কারা?

বেলাল: তুমি এটা জানলে কী করে! হ্যাঁ, স্বর্গে তিন পাপী বলে একটা বই আছে শ্যামল গাঙ্গুলির। কিন্তু মজার বিষয় হলো, এই তিন পাপীর মধ্যে শ্যামল গাঙ্গুলি নিজে ছিলেন না। সেই পাপী অভিযাত্রী ছিলাম আমরা তিনজন। ওই যে কফি হাউসের গল্প করলাম। কফি হাউসে আমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ইন্দ্রনাথ মজুমদারের। তিনি নিজে লেখালেখি করতেন না, কিন্তু ছিলেন মজার চরিত্র। বইয়ের দোকান ছিল তাঁর। তো, তিনি সৌমিত্রদের সঙ্গে বসে থাকতেন। আমাদের সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়েছিলেন কমলকুমার মজুমদারের সূত্রে। কমলকুমারের অন্ধ ভক্ত ছিলেন। আমরা তাঁকে ইন্দ্রদা বলতাম। এই ইন্দ্রদা হলেন একজন বিগ বেবি—একটা বাচ্চা শিশুর মতো। খেতে খুব পছন্দ করতেন। তাঁর অনেক গল্প আছে। যা হোক, কফি হাউসে ইন্দ্রদা, তারপরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর আমি—পাপী এই তিনজন।

একবার ঠিক হলো, তিনজন মিলে বাইরে যাব। ইন্দ্রদাই বললেন, তাঁর এক বন্ধু উড়িষ্যার কোনারক থাকেন, সেখানে যাওয়া যেতে পারে ছুটিছাটায়। ছুটিছাটা আবার কী! ইন্দ্রদা তখন ব্যবসা করেন, সুনীলদা ফ্রিল্যান্স লিখেন, আর আমার তো অনন্ত ছুটি। সুতরাং আমরা তিনজন মিলে বেরিয়ে পড়লাম কোনারকের উদ্দেশে। গাড়িতে উঠে আমাদের আর কাজ কী—একটু পান করেছি।

হাওড়া স্টেশন থেকে গাড়িতে উঠলাম। নামব ভুবনেশ্বরে। গাড়িতে আমাদের পাশে নানান ব্যবসায়ীরাও আছে। এদের অধিকাংশই কটক যাচ্ছে। আমাদের এক বন্ধু বলে দিয়েছিল, তোমরা যদি ভুবনেশ্বর যাও, ওখানে রাজা-রানির মন্দির আছে। গোধূলিবেলায় ওই মন্দিরকে খুব সুন্দর দেখায়। তোমরা সেখানে একবার ঘুরে এসো। তো, ট্রেনে উঠেছি; এখন একটু আড়মোড়া ভাঙতে হবে, পান করতে হবে। আমাদের কাছে তরল আছে বটে, কিন্তু প্রথমে আমরা কীভাবে শুরু করব। একসময় সাহস করে খুলে শুরু করে দিলাম। শুরু হলেই তো আর কারও কিছু যায়-আসে না। তারপরে হলো কি, পাশে বসা ব্যবসায়ীরা আমাদের কম্ম দেখে যারপরনাই বিস্মিত, তারা ব্যবসা নিয়ে আলাপ করছে আর আমাদের দেখে বারবার নাক সিটকাচ্ছে। আমাদের কাজকারবার ওদের পছন্দ হচ্ছে না। এর মধ্যে আমরা করলাম কি, সিগারেট খেতে খেতে ওই ধূম্র-শলাকা দিয়ে ওদের সিট ফুটো করে দিলাম। কাজটা ইন্দ্রদা, সুনীলদা আর আমি—আমরা তিনজনই করছিলাম। এরপর একই কায়দায় আমরা ফুটো করতে শুরু করলাম ওই ব্যবসায়ীদের জামা, জুতা—এসবও। এর বিনিময়ে ওরা যখন কটকে নেমে গেল, আমাদের দিকে রোষ কষায়িত নেত্রে তাকিয়েছিল কেবল। এভাবে মজা করতে করতে পৌঁছে গেলাম কোনারকে। গিয়ে দেখি ইন্দ্রদার বন্ধু—মানে যে লোকের কাছে আমাদের থাকার কথা—তিনি সদ্য বিয়ে করেছেন। বিয়ে করেছেন কিশোরী এক মেয়েকে। অথচ আমরা জানতাম যে তিনি সিঙ্গেল। ফলে এখন কোথায় থাকব আমরা? আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা ভন্ডুল।

এর মধ্যে ইন্দ্রদার ওই বন্ধু করলেন কি, গোয়ালঘরের মতো একটা ঘরে আমাদের তুলে দিয়ে বললেন, এখানে থাকেন। আমরা গোয়ালঘরে থাকলাম দুপুর পর্যন্ত। তারপর কোনারক মন্দিরে কিছু সময় কাটিয়ে বের হলাম। গেলাম চন্দ্রভাঙা নদীর পাড়ে। এই নদীর পরেই সমুদ্র। ওখানে গিয়ে আমরা মাছ কিনলাম—সামুদ্রিক মাছ। মাছ কেনার পর চাল—জানো তো উড়িষ্যাতে খুব সুন্দর চাল হয়—এসব কেনাকাটা শেষে খাওয়াদাওয়া সাঙ্গ করে বিশ্রাম নিলাম কিছুক্ষণ। সন্ধ্যায় আমরা তিনজন হাঁটছি নদীর পাড় ধরে। পাশে বিরাট ঝাউবন—চন্দ্রভাঙা নদী থেকে সমুদ্রের দিকে। সমুদ্র ওখান থেকে মাত্র দুই মাইল দূরে। কিন্তু ঝাউ বন-টন আছে। ওখানে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ আমাদের কী খেয়াল হলো, সবাই কাপড়চোপড় খুলে ফেললাম। একদম দিগম্বর। দিগম্বর বেশে তিনজনই যাচ্ছি। আসলে অন্য জিনিসের প্রভাবও ছিল। এ তো বুঝতেই পারো। আমাদের যে কাপড়চোপড় ছিল, সেগুলো আমরা মাথায় বেঁধে নিয়েছি অলমোস্ট। তবে সুনীলদা না থাকলে সেদিন আমরা মারাই যেতাম। কেননা, যেতে যেতে আমরা সেদিন সমুদ্রের গভীরে নামতে শুরু করেছিলাম। এ সময় সুনীলদা আমাদের বাধা দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, যেয়ো না যেয়ো না। আমার এখনো মনে আছে, একটা দূরাগত ধ্বনি। ‘বেলাল বেলাল...ইন্দ্রনাথ ইন্দ্রনাথ’ বলে ডাকছে। এত মায়াময় ছিল সেই ডাক, সেই কণ্ঠ! পরে অবশ্য টের পেয়েছিলাম, ওই জায়গাটা খুবই ভয়ংকর ছিল।

লোপা: আপনার জীবনে এত এত ঘটনা ও অঘটনের ঘনঘটা, বাউন্ডুলেপনার মাধ্যমে জীবনকে এই যে উল্টে-পাল্টে দেখা, আদতে কী হওয়ার ইচ্ছে ছিল আপনার?

বেলাল: ছোটবেলায় খুব দুরন্ত ছিলাম আমি। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে রেলগাড়ি যেত। এই রেলগাড়ি যে লোকটি চালাত, তাকে বলা হতো ড্রাইভার। তাকে দেখে আমার অসাধারণ লাগত। আমি এমন ড্রাইভার হতে চেয়েছিলাম। স্বপ্ন ছিল আমি ড্রাইভার হব, ইঞ্জিনের ড্রাইভার।

লোপা: ড্রাইভার হতে চেয়ে হয়েছেন কবি। এখন যদি আপনাকে অন্য কিছু হতে বলা হয় কী হতে চাইবেন?

বেলাল: শোনো, ইঞ্জিনের ড্রাইভার না হলেও আমি কিন্তু নাবিক হয়েছি। নাবিক হিসেবে নানা জায়গায় ঘুরেছি। মাছের ট্রলারে কাজ করেছি। আর আজকে যদি বলি কী হতে চাই, বলব যে, যা হয়েছি, আমার কাছে এটাই সবচেয়ে সুন্দর। আমার জীবনে খুব উচ্চাশা নেই। মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি, তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারছি। এর বেশি কী চাই! মানুষের ভালোবাসার চেয়ে আর বড় কিছু নেই।

লোপা: এমন কী কাজ আছে, যা এখন পর্যন্ত শেষ করতে পারেননি?

বেলাল: শেষ করতে পারিনি বলতে কোনো লেখাই আমি শেষ করতে পারিনি। আদতে লেখা ধরলামই-বা কখন আর ছাড়বই-বা কখন। এত লেখা মাথার মধ্যে! গল্প বলো কবিতা বলো, না-লেখা এমন সব জিনিস আছে!

আমি কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম এমন একটা অবস্থায়, যখন আমার চূড়ান্ত আইডেনটিটি ক্রাইসিস। কলকাতায় প্রথম আমাকে নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠল যে আমি একটা স্পাই। আমি একটা সময় একটু বাইরে গিয়েছিলাম। ওই সময়ে আমার বন্ধুবান্ধব রটিয়ে দিয়েছিল যে আমি স্পাই। তখন কলকাতায় ওটা খুব চলত যে ‘পাকিস্তানের স্পাই’। সেই সময় কমলকুমার মজুমদার এগিয়ে এসেছিলেন আমার সাহায্যে। তিনি বললেন, যে ছেলে আমাদের সঙ্গে সারাক্ষণ ঘুরে বেড়ায়, সে স্পাই হবে! তোমরা স্পাইগিরির কী জানো? বলে কমলদা সাংঘাতিকভাবে আমাকে রক্ষা করলেন। আর আমি তো আদতে স্পাই ছিলাম না।

এই অবস্থায় ভাবলাম, আমি কী পারি? এত বই পড়েছি ছোটবেলা থেকে। আব্বা-আম্মা দুজনেই ছিলেন বইয়ের পোকা। আম্মা লিখতেনও কবিতা-টবিতা। চির সুমধুর নামে তাঁর একটা বইও পরে বের করে দিয়েছিলাম। কাইয়ুম ভাই (কাইয়ুম চৌধুরী) কাভার করেছিলেন। সে যা হোক, যখন মনে হলো, আমি কী পারি, সবচেয়ে সহজে কী করা যায়? দেখা গেল, আমি কবিতা লিখতে পারি। প্রথমে ধরলাম কবিতা। কবিতা ধরে দেখলাম যে পাঁচজন পড়ে। পড়ে হয়তো তিন বা চারজনই কিছুই বলল না। একজন অন্তত বলল যে ভালো তো। এই কবিতা লিখেই কলকাতায় আমি আইডেনটিটি ক্রাইসিস কাটিয়েছিলাম। আর গদ্যের কথা যদি বলি, গদ্য লিখতে আমার খুব মজা লাগে। গদ্য আমি প্রচুর লিখেছি বা এখনো মাথার মধ্যে গদ্য গিজগিজ করে। কিন্তু এখনো তো ওগুলো কাগজে-কলমে শেষ করতে পারিনি।

লোপা: অগোছালো, এলোমেলো কবিজীবন আপনার। সংসারজীবনেও কি আপনি বাউন্ডুলে?

বেলাল: সংসার তো করলাম আম্মার দিকে তাকিয়ে। আব্বার মৃত্যুর পর আম্মা যখন বললেন, কলকাতায় ফিরে যেতে হলে আমার লাশের ওপর দিয়ে যাও, ভেবে দেখলাম, জীবনে তো মাকে কখনো খুশি করিনি, তাঁকে খুশি করি এবার। এ জন্যই বিয়ে।

লোপা: বিয়েটা তাহলে আপনার জীবনের মধুর ভুল বলতে পারি। একটা ভুল কখন আপনার জীবনে খুব মধুর হয়ে ওঠে?

বেলাল: আমার এই জীবনের সবই তো ভুল। ভুলে ভরা জীবন। আমি মনে করি, সবটাই ভুল। আর ভুলগুলো মধুরই হয়। যখন পেছনে ফিরে তাকাই, তখনই মধুর মনে হয়।