ইংরেজি অনুবাদে সূর্য দীঘল বাড়ি

আবদুস সেলিমকৃত আবু ইসহাকের কালজয়ী উপন্যাস সূর্য-দীঘল বাড়ির ইংরেজি অনুবাদ হাতে পেয়ে প্রথমেই খুব আনন্দ হলো। বইটি আবু ইসহাক লিখেছিলেন বাংলা ভাষায়। তাঁর ভাষা যেমন ঝরঝরে, আবদুস সেলিমের সুদক্ষ অনুবাদে সেই ঝরঝরে ভাবটি ম্লান হয়নি মোটেও। মূল উপন্যাস ও অনুবাদের মধ্যে সারবস্তুগত ন্যূনতম তফাত অবধারিত। সেটুকু ছাড়া এটিকে আলাদা করে অনুবাদ হিসেবে চিহ্নিত করা খানিকটা মুশকিল বটে। যেমন সূর্য-দীঘল বাড়িতে সংলাপ ও শব্দচয়নের ক্ষেত্রে আবু ইসহাক লোকজ ভঙ্গিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। গ্রামীণ লোকায়ত মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আবেগ যথার্থভাবে তুলে ধরার জন্য দক্ষতার সঙ্গে আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার করেছেন তিনি। ইংরেজি অনুবাদে এটি হুবহু ফুটিয়ে তোলা প্রায় অসম্ভব। তবে এই বিভেদকে ক্ষুদ্রতম মাত্রা পর্যন্ত কমিয়ে আনতে আবদুস সেলিম চমৎকার কৌশল অবলম্বন করেছেন। ইংরেজির মাঝে মাঝেই তিনি বসিয়ে দিয়েছেন মূল লেখকের ব্যবহৃত বাংলা শব্দ এবং বন্ধনীর ভেতর দিয়েছেন সেটির ব্যাখ্যা। যেমন উপন্যাসের প্রধান চরিত্র জয়গুনকে তার ছেলেমেয়ে মা বলে ডাকে। অনুবাদকও ‘মা’ শব্দটিই ব্যবহার করেছেন। শ্বশুর-শাশুড়ি তাঁদের পুত্রবধূকে ডাকে বউ বলে। অনুবাদেও সেটি অবিকৃত রাখা হয়েছে। ইংরেজি হরফে ‘বউ’ লেখা হয়েছে এবং বন্ধনীর ভেতর ‘ডটার ইন ল’ লিখে দেওয়া হয়েছে। আরেকটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ বেপর্দা (bepurdah), অনুবাদকও তাই-ই রেখেছেন।

এ পর্যায়ে উপন্যাসের প্রেক্ষাপট নিয়ে একটু বলি। এই উপন্যাসের শুধু প্রেক্ষাপট নয়, এর মেজাজও আধুনিক। নিজেদের সৃষ্ট যুদ্ধে রাজনীতিবিদেরা যাঁর যাঁর স্বার্থ বুঝে নিলেন, কিন্তু যুদ্ধের করাল থাবার প্রথম এবং মোক্ষম আঘাতটি আসে তাঁদের ওপর, যাঁরা কী, কেন, কীভাবে ও কাদের কারণে যুদ্ধ হয়—এসব বোঝেন না। অনাহারে মরছেন তাঁরাই, যাঁরা যুদ্ধ চান না এবং বুকের ভেতর লালিত কিছু সরল, নিষ্পাপ স্বপ্নই কেবল যাঁদের সম্বল। এই শ্রেণির সরল স্বপ্নের প্রথমটি হচ্ছে তিনবেলা ভাত খাওয়া। স্বপ্ন যেমন সরল, স্বপ্নপূরণ কিন্তু ততটা সরল নয়। মনুষ্যসৃষ্ট আকালে সরল মানুষের ক্রমশ বিলুপ্তির পথে আরোহণ এই উপন্যাসের অন্যতম উপজীব্য।

তবে আবদুস সেলিমের অনুবাদকৃত এ বইয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হচ্ছে, এখানে আছে অনুবাদকের একটি সমৃদ্ধ ভূমিকা। উপন্যাসের রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট বোঝার জন্য এ ভূমিকাটি খুব কার্যকর হবে। সেলিম উপন্যাসটি স্রেফ অনুবাদ করেননি, অনুবাদে হাত দেওয়ার আগে করেছেন গবেষণা। কথা বলেছেন আবু ইসহাকের ছেলে ইশতিয়াক জামিলের সঙ্গে। খুঁজে বের করেছেন আবু ইসহাকের উপন্যাস ও ছোটগল্প নিয়ে গবেষণা করা দুজনকে—হাসান অরিন্দম ও সুব্রত কুমার দাস। পড়েছেন তাঁদের গবেষণা। সব মিলিয়ে বলা যায়, এটি একটি শ্রমসাধ্য ও দীর্ঘ প্রতীক্ষিত অনুবাদ। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত এ বইয়ে একটি বড় ত্রুটি রয়ে গেছে। আবু ইসহাকের মৃত্যুর সাল উল্লেখ করা হয়েছে ২০১৩। প্রকৃতপক্ষে এটি হবে ২০০৩। কিন্তু শেষে এটি বলতেই হবে, বাংলার চিরায়ত সাহিত্যকর্মগুলোকে ইংরেজিতে অনুবাদের বাংলা একাডেমি যে উদ্যোগ নিয়েছে, নিঃসন্দেহে তা প্রশংসনীয়।

সূর্য-দীঘল বাড়ি
আবু ইসহাক
অনুবাদ: আবদুস সেলিম
প্রচ্ছদ: রফিকুন নবী, প্রকাশক: বাংলা একাডেমি, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৬৮ পৃষ্ঠা, দাম: ৬৫০ টাকা।