ঝড়ের পরে পাতাবাহার ঝলকায়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পাখিরা কীভাবে জুটি বাঁধে, তাই নিয়ে ভীষণ তর্ক লেগে গেল ওদের। ওরা তো দল বেঁধে থাকে, একসঙ্গে অনেক পাখি ঝাঁক বেঁধে ওড়ে, নামে, আবার সেভাবেই উড়ে যেতে থাকে। কিন্তু এর মাঝে কীভাবে দুজন করে আলাদা হয়ে যায়, খাবার খুঁটে খায়, নীড় বাঁধে, ডিম পাড়ে, বাচ্চাও ফোটায় দুজন মিলেই। কীভাবে তারা নির্দিষ্ট একজনকেই বেছে নেয়, আবার দল বেঁধে উড়েও সেই জোড়া কি একই থাকে? কীভাবে থাকে? কেন থাকে?
অনিক কিংবা দিলতানা—কেউই কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারল না। কিন্তু বরাবর যা হয়, অনিক মেনে নিল দিলতানার কথা—জুটি স্বর্গ থেকে আসে। বিধাতা সবার জোড়াই অনেক আগে থেকে নির্দিষ্ট করে রেখেছেন, তাদের দেখা হবেই। এবং তখন, এর মাঝে তাড়াহুড়ায় ভুল জুটির সঙ্গে মিশলেও, ঠিকই সে তার নিয়তিকে খুঁজে পায় এবং তারা অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে যায়।
অনেকে তো পৃথিবীর উল্টা পিঠে গিয়েও তার মনের মানুষ খুঁজে পায়, বিয়েও করে, কেউ কেউ বিয়ের পরেও ভেঙে দিয়ে আবার করে, এই সংশয়ের জবাবে সাফ জানিয়ে দিল দিলতানা, ওটাই ছিল তাদের নিয়তি, পূর্বনির্ধারিত। ওভাবেই বিধাতা লিখে রেখেছিল।
সব বাদ দিয়ে ওদের বর্তমান সমস্যার দিকে আঙুল তুলল অনিক। কোথাও কোনো বাসের টিকিট খুঁজে পাচ্ছে না, লম্বা ছুটির আজ শেষ দিন বলে অনেকেই ফিরে যাচ্ছে। সে জন্যই অনিক ভাবল, ওরা অত সহজে আসার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল। অথচ দিলতানার সাফ কথা, সে আজই ঢাকা ফিরবে, কোনো হোটেল-ফোটেলে থাকবে না। কিন্তু কোনো উপায় তো দেখা যাচ্ছে না। অথচ ও শুনছে না তার কথা, সে ফিরবেই। যেভাবেই হোক ব্যবস্থা করতে হবে। মনে মনে বিরক্ত হলেও এবং হুট করে এভাবে চলে আসার জন্য নিজেকে গালমন্দ করলেও বরাবরের মতো চোখমুখ উজ্জ্বল করে রাখল অনিক। হাঁটতে লাগল পাশে পাশে, মজা হচ্ছে...মজা হচ্ছে...ভাবতে লাগল। সকাল থেকে এভাবেই ভাবছে সে। আসলে সব সময় তাই-ই করে। একটা ‘মজা হচ্ছে’ ধারণার মধ্য দিয়ে চলতে থাকে, সত্যই কোনো মজা হচ্ছে কি না, বা কতখানি কী হচ্ছে—সেটা সে নিশ্চিত হতে পারে না। তবে দিলতানার যে মজা হয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এবং সে জন্য সে সব করতে পারে—যেকোনো কষ্টই তার কাছে তুচ্ছ। আর অনিকও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে প্রাণপণ চেষ্টা করে। যেমন আজ, খুব ভোরে দিলতানা যখন ফোন করে ওকে ঘুম থেকে তুলল লেকের ধারে হাঁটবে বলে, একদম দেরি না করে তিড়িং করে উঠে পড়ল সে। চলে গেল তার কাছে। আবার হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ল অনেকগুলো বাস—বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যাচ্ছে, দেখে দিলতানার মনে হলো, বাসে করে বহু দূরে কোথাও চলে গেলে দারুণ হবে। ব্যস, ছুটল দুজনেই। রাস্তার ওপারে বেশ কয়েকটি দূরপাল্লার বাসের কাউন্টার, একটুও দেরি না করে নিয়ে ফেলল দুটো টিকিট—তারপর সোজা কক্সবাজার।
ঠিক বোঝে না অনিক, তবে সবাই যখন ওদের এই খেয়ালিপনার প্রশংসা করে, তখন আবার ভালোই লাগে তার। ওদের বিস্মিত অবিশ্বাস, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকাÑঅতঃপর উচ্ছ্বসিত মন্তব্যগুলো উপভোগ করে সে, এমন সব হুটহাট আজগুবি কর্মকাণ্ড নিয়ে গর্ববোধ করে। তখন কার বেশি পাগলামি স্বভাব, উচ্ছলতা কার বেশি—এই নিয়ে যেন প্রতিযোগিতা চলে ওদের।
ওরা এমনই, সবাই জানে ওদের এ রকম বিভিন্ন খামখেয়ালির কথা। কদিন আগে হঠাৎ একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে ঢাকার আশপাশে যে কটা প্রাচীন জমিদারবাড়ি আছে—মানিকগঞ্জ, জয়দেবপুর, মধুপুর—সব ঘুরে দেখল, তারপর ফেসবুকে সেসব ছবি আপলোড করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল। আর একবার সোজা মাওয়া চলে গিয়ে আস্ত ইলিশ ভাজা গাপুস-গুপুস খাওয়ার ছবিও খুব হিট হয়েছিল। তবে...এবার বোধ হয় একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেল।
এখন ওরা এলোমেলো হাঁটছে আর সামনে যাকে দেখছে তারই বয়স অনুমান করার চেষ্টা করছে, দুজন হলে বয়সের পার্থক্য এবং তাদের সম্পর্ক কী হতে পারে, তা নিয়ে বিতর্ক করছে, মোটা এক লোকের ভুঁড়ি বাগিয়ে হাঁটা দেখে প্রচণ্ড হাসছে। তবে একটা জিনিস আবারও মনে মনে স্বীকার করল অনিক, সব বিষয়ে ওর চেয়ে অনেক ভালো বোঝে দিলতানা। কোনো মানুষের বয়স অনুমান করারও যে বিশেষ কোনো টেকনিক থাকতে পারে, তা কে জানত!
হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তা ছেড়ে ভেতরের দিকে চলে এসেছে ওরা, ফিরে যাওয়ার কী ব্যবস্থা করা যায় ভাবছে। সারি সারি ঘরবাড়ি, লোকজন তেমন দেখা যায় না, দুটো খালি ট্রাক দাঁড়ানো দেখে মনে হচ্ছে এলাকাটা বিভিন্ন অফিস কিংবা গুদাম হবে বোধ হয়। পেছনের বিচ রোডের সঙ্গে পুরোই বেমানান রংহীন গায়ে গায়ে লাগা ঠাসাঠাসি নিচু দালানকোঠা। সামনেই একটা বাড়ির পাশের ছোট বন্ধ দরজার সামনে একটা রংচটা গাড়ি এসে থামল। ড্রাইভার দ্রুত নেমে চাবি বের করে ঘরটার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল, একটু যেন তাড়াহুড়া করছে। কত হবে লোকটার বয়স, ভাবল অনিক—সাতাশ কিংবা আটাশ।
হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে উঠল দিলতানার চোখ, অনিকের দিকে ফিরে মাথা ঝাঁকিয়ে ইশারা করল। বুঝে ফেলল অনিক, দ্রুত গাড়ির কাছে গিয়ে টেনে দেখল দরজা খোলা, নিশ্চয়ই এখনই এসে পড়বে বলে লক করেনি। টুপ করে ততক্ষণে হাত ঢুকিয়ে পেছনের দরজা আনলক করে ভেতরে ঢুকে পড়েছে দিলতানা, অনিকও ঢুকল উত্তেজিত ভঙ্গিতে। সিনেমায় অনেক দেখেছে এ রকম দৃশ্য, এভাবেই মজা শুরু হয়। এমনিতেই প্রায় অন্ধকার, তার মধ্যে মাথা নিচু করে রইল দুজনই। দারুণ একটা ফিনিশিং হবে আজকের অ্যাডভেঞ্চারের, ফিসফিস করে বলল অনিক। বুক ঢিপঢিপ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল লোকটার ফিরে আসার।

দুই.
সবকিছু গুছিয়ে নিতে নিতে দেরি হয়ে গেল, বরাবরই তা-ই হয়। সময় ঠিক রাখা যায় না। গাড়িতে উঠতে উঠতেই বেলা পড়ে গিয়েছিল। এখন ট্যুরিস্ট সিজন। চারদিকে কিলবিল করছে লোকজন। চলাফেরা করাই মুশকিল। এদিকে না ঢুকতে হলেই ভালো হতো।
বাহারের অফিসটা আসলে টেকনাফে, থাকে মরিচায়। ছয় মাস ধরে এডিবির একটা প্রজেক্ট ফিজিবিলিটির সোশিও-ইকোনমিক অ্যাসেসমেন্ট করছে ওরা। ওখান থেকে এসে টিমের সবার বেতন এবং সারা মাসের অফিস খরচের টাকাটা সকালেই ব্যাংক থেকে তুলে এখানে রেখে গেছে। তারপর মহেশখালীর পুরোটা চক্কর দিয়ে কাজ সেরে এয়ারপোর্টের পাশে নুনিয়ারছড়ার ফিল্ড-অ্যাসিস্ট্যান্টের সঙ্গে ডেটাশিটগুলো নিয়ে একটু বসতে হলো, আর তাতেই দেরি হয়েছে। তারপর এল এই ডিসি হিলের পাশে, আগে যেদিক দিয়ে সি-বিচের মূল রাস্তাটা ছিল। এখানে ওদের একটা অফিস আছে। অফিস বলতে ছোট একটি কুঠুরি, একটা স্টিলের আলমারি, কেবিনেট, তার পাশে একটা টেবিল পাতা গেছে কোনোমতে। প্রতিটা অফিসে একজন করে ম্যানেজার থাকে, কিন্তু ওরা সাধারণত ছয়টার মধ্যেই কাজ শেষ করে দিয়ে চলে যায়।
মুরাদ, মানে ওর ড্রাইভার কাম কুক কাম পার্সোনাল সেক্রেটারি অসুস্থ, তাই ছুটিতে। এখন সব ধকল ওর ওপর দিয়েই যাচ্ছে। অফিসের সামনে গাড়িটা থামিয়েই দ্রুত গিয়ে ভেতরে ঢুকল। লকার খুলে টাকাগুলো কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে ঢোকাল, তারপর চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে বের হয়ে এসে গাড়িতে উঠে পড়ল। ঘুরে ঢাকা রোড ধরে এগিয়ে চলল। বেশ কিছুদূর গিয়ে মুহুরিপাড়ার মোড়ে ভাই ভাই হোটেলকে বাঁয়ে রেখে আরেফিন এন্টারপ্রাইজের সামনে দিয়ে ডানে মোড় নিয়ে টেকনাফ রোডে উঠল গাড়ি। ফোন বাজছে, সিটের পাশ থেকে নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে রিপোর্টের ড্রাফট কপি নিয়ে পরশু ঢাকা যাবে বলে জানিয়ে রেখে দিল বাহার।
আপাতত আর কাজ নেই। সেই চেইন্দা বাজারের আগে আর থামবে না। ওখানে পাঁচ মিনিট থেমে পানেরছড়া পার হয়ে খুনিয়াপালঙে থামবে একটু, তারপর সোজা মরিচা। রাতটা ওখানেই থাকবে, টেকনাফ যাবে সকালে। এবার একটু আরামে চালানো যাবে। রেডিওটা অন হয়ে আছে নাকি, কিসের যেন একটা ফিসফাস শোনা যাচ্ছে! সুইচে হাত দিয়ে নিশ্চিত হলো, নাহ্, হয়তো বাতাস।
কিন্তু হঠাৎ...কার যেন সে ঢাকার দিকেই যাচ্ছে কি না, প্রশ্ন শুনে তিড়িং করে উঠল বাহার। ভূতের ভয় ছাপিয়ে সঙ্গে থাকা অনেকগুলো টাকার কথা মনে হলো তার। ওর ‘কে, কে ওখানে!’ এর জবাবে পেছনের অন্ধকার থেকে কেউ মৃদু গলায় জানালÑতারা দুজন, ঢাকা যাবে বলে তার গাড়িতে উঠেছিল, এখন মোবাইলে তাকে পরশু যাবে বলতে শুনে চিন্তায় পড়ে গেছে। সঙ্গে সরি-টরিও বলল।
স্থির হয়ে গেল বাহার, শান্ত থাকার চেষ্টা করল। সামনেই নয়াবাজার, ওখানে ছোট একটা গ্যারেজের মতো আছে, এর আগেও একদিন থেমেছিল, ওখানেই গাড়ি ঢুকিয়ে দিল সে।
গ্যারেজ বন্ধ, তবু নামল বাহার। পেছনের সিট খুলে কে কে আছে দেখার চেষ্টা করল, নামতে বলল দুজনকেই। সঙ্গে আর কে কোথায় আছে জানতে চাইল। ছেলেটার নানাভাবে দেওয়া ব্যাখ্যা এক ফোঁটাও বিশ্বাস হলো না। মেয়েটি নির্বিকার ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক হেঁটে দেখছে। ঝোলাটা নিয়েই নেমেছিল বাহার, ভেতরে সিটের ওপর রেখে দরজা লক করল।
এবার ছেলেটাকে ধরল বাহার। জামার কলার ধরে জুতমতো টেনে নিয়ে কষে এক চড় দিল। মিথ্যা কথা না বলে আসল কাহিনিটা বলতে বলল। ফুঁপিয়ে উঠল অনিক। সত্যিই তারা বিপদে পড়েছে বলে জানাল। সকাল থেকে যা ঘটেছে আদ্যোপান্ত বলল। কিন্তু কঠিন লোকটা তাকে বিন্দুমাত্রও বিশ্বাস করছে বলে মনে হচ্ছে না। দিলতানা কোথায় গেল, ও কেন কিছু বলছে না! লোকটার ভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন চোর ধরেছে, বাঁধবে এখনই। মিনতি করতে লাগল অনিক। হইচই শুনে দু-তিনজন ছোকরামতো লোক ছুটে এল। তামাশা দেখতে কে না মজা পায়। কিন্তু এরা বিপজ্জনক হয়, মাদকাসক্তও হতে পারে। ওদের পাত্তা না দিয়ে অনিককে জেরা করতে লাগল বাহার। নামধাম পরিচয় নিল বিস্তারিত। একটু পরে একই কথা আবার জিজ্ঞেস করল, মিথ্যা বললে এলোমেলো হয়ে যাবে। নাহ্, যে দুটোর জবাব মনে রেখেছিল মিলে যাচ্ছে। আর, চেহারা দেখে মনে হয় না ডাকাতি করার মতো গাট্স আছে। গাড়িচোর বলেও মনে হচ্ছে না।
কিন্তু একটু পর হঠাৎ লক্ষ করল, আশপাশে ওই ছোকরাগুলো নেই। কেমন সন্দেহ হলো বাহারের। পরিবেশটাই বদলে গেছে যেন! দ্রুত অনিককে ঠেলে পাঠাল দিলতানাকে খুঁজতে। নিজে গেল গ্যারেজ ঘরের পেছন দিয়ে ভেতরের দিকে। ওদিকে কারা যেন থাকে, আগেরবার দেখেছিল।
হতভম্ব অনিক দৌড়ে গেল সামনের দিকে, যে ঘরটার দরজা তখন খোলা ছিল, এখন সেটা বন্ধ দেখা যাচ্ছে। সেদিকে দ্রুত এগিয়ে গিয়েও বন্ধ জানালার পাশে থমকে দাঁড়াল সে, চেপে চেপে দম ছাড়ার মেয়েলি শব্দ পাওয়া যাচ্ছে ভেতর থেকে। মানে! কখন নিয়েছে ওকে ভেতরে? কতজন? কী করছে ওরা? হঠাৎ জেগে ওঠা অনেক প্রশ্নের জবাবে শুধু ওই শ্বাস ফেলার শব্দই পেল সে।
খুব ধীরে কেটে যাচ্ছে থমকে যাওয়া মুহূর্তগুলো।
ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে চেষ্টা করল অনিক। ভেতরে কতজন আছে, কে জানে! নিশ্চয়ই এতক্ষণে সব শেষ। শেষ? ওর দিল আজ এইমাত্র শেষ হয়ে গেল! একটা চুমুও খেতে দেয়নি কোনো দিন...এসব নাকি ভালো না। অথচ এখন নিজেকে এভাবে বিলিয়ে দিল! প্রচণ্ড রাগে ওকে মারতে ইচ্ছা করল তার। যেতে না চাইলে কি জোর করে নিয়ে যেতে পারত ওকে ঘরের ভেতর? কী করবে ভেবে না পেয়ে হয়তো নিজের চোখে ব্যাপারটা একবার দেখতে চাইল অনিক। এখনো তার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না, ভেবেই পাছে না কেন সে গেল ওদের সঙ্গে। তাকে কখনোই এ রকম মেয়ে মনে হয়নি, অথচ আজ? ডেকে নিয়ে গেল আর চলে গেল? জোর করে তো নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। স্কুলে থাকতেই সে জুডো কারাতে শিখেছে। নিজেই বলেছে, যেকোনো পরিস্থিতিতে সে আত্মরক্ষা করতে জানে। তাহলে এখন কী হলো? কোনো রকম চিৎকার, একটু চেঁচামেচিও না করে একদম চুপচাপ চলে গেল কেন? এনজয় করছে? হুম্, ওই চেপে চেপে শ্বাস ফেলা সে কথাই বলছে।
মুহূর্তের মধ্যে এত কিছু ভাবনা তার মনের ভেতর পোকার মতো কিলবিল করতে থাকল। আসলে চিৎকার কিংবা আর্তনাদের বদলে ওই দম ফেলার শব্দটাই তাকে বিরাট ধাক্কা দিয়েছে এবং ওই সব ভেবে প্রচণ্ড রাগে উন্মাদের মতো তেড়ে গেল দরজার দিকে। কিন্তু অমনি কোত্থেকে উদয় হলো টিংটিঙে খ্যাপাটে এক ছোকরা। এসেই মারল এক ধাক্কা, মেরে নিজেই পড়ে গেল। তবে অনিকও তাল রাখতে পারেনি, হঠাৎ চলে আসা ওই উটকো বোঁচকাকে নিয়ে সে-ও গড়িয়ে পড়ল। ওদের শব্দ পেয়ে আরেকজন পেছন থেকে এগিয়ে এসে দিল এক বাড়ি। দুজন মিলে গড়াগড়ির মধ্যেই বেশ কিছু মার হজম করল অনিক। দিলও কয়েকটা, কিন্তু ওই এলোমেলো মারে ওদের কিছুই হলো না। বরং অনিক রক্তাক্ত অবস্থায় একা হয়ে পড়ল। আর পারল না সে। বুকভরা রাগ আর ঘৃণা নিয়ে হঠাৎ নিজের অসহায়ত্ব বুঝতে পেরে ঘুরে গিয়ে পেছন ফিরে পাকা রাস্তা ধরে দৌড়াতে শুরু করল।
ফোন বাজছে। দৌড়ানোর মধ্যেই পকেট থেকে বের করল, হ্যাঁ, দিলতানাই! কেন করেছে? হুম্...দায়িত্ব, কান্নাকাটি হাসপাতাল টানাহ্যাঁচড়া, অজুহাতের অভিনয়! হাহ্...এত সোজা? ও কি এতই গাধা! কিন্তু সেটা জানিয়ে দেওয়া দরকার ভেবে রিসিভ করল সে। কেমন এনজয় করল জানতে চেয়ে শুরু করল, আগে যেমন মনের ভাব গোপন করে তার কথাতেই সায় দিত। এখন মনের সবটুকু ঝাল ঝেড়ে বাড়তি কিছু দিল বরং, এত দিনকার অবদমিত পুঞ্জীভূত যত ক্ষোভ, সব একসঙ্গে বিস্ফোরিত হলো একদম অশ্লীল ভাষায়। তারপর কথ্য বাংলায় একজন বেহায়া-প্রমোদবালা ইত্যাদি উপাধি দিয়ে জীবনে আর কখনো তাকে ফোন করতে নিষেধ করে লাইন কেটে দিল সে।
কয়েকজন লোক নিয়ে একটা নছিমন যাচ্ছিল, ওকে দৌড়াতে দেখে একটু থেমে ডাকতে লাগল। কক্সবাজারের দিকেই যাচ্ছে। দৌড়ে গিয়ে তাতে উঠে পড়ল অনিক।

তিন.
পেছনে গিয়ে থমকে গেল বাহার। কোনো পথ নেই সামনে, পাশাপাশি দুটো ঘর শুধু। একটা ঘরের সামনে দাঁড়ানো এক মহিলা বাহারকে দেখে হকচকিয়ে বিপন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চকিতে একবার পেছন ফিরে ঘরের ভেতরটা দেখে নিল সে। এবং ওই তাকানোটাই কিছু বার্তা দিল বাহারকে। একদম দেরি না করে হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। ঘর খালি কিন্তু সামনে আরেকটা দরজা, বন্ধ। ছুটন্ত অবস্থায়ই উড়ে গিয়ে সপাট লাথি চালাল, প্লাস্টিকের দরজা ভেঙে ভেতরে গড়িয়ে পড়ল সে। উঠে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। মেঝেতে এক লোকের ওপর চড়ে বসে আছে সেই মেয়েটি। উপুড় হয়ে থাকা লোকটার শরীরের পাশে এক হাঁটু ভাজ করে আরেক হাঁটু পিঠের ওপর ঠেসে ধরে দুই হাত মোচড়ে এক করে ফেলেছে। কোনো কিছু না পেয়ে তার শার্টের হাতা টেনে ওটা দিয়েই বাঁধার চেষ্টা করছিল। ঝড়ের মতো বাহারকে ঢুকতে দেখে থমকে তাকিয়ে আছে এখন। দেরি করল না বাহার। ঘাড়ের কাছে জোরে একটা লাথি দিয়ে শান্ত করে দিল লোকটাকে। বাঁধার মতো জুতসই কিছু না পেয়ে ভাবল বেঁধে আর কী হবে, দুজন মিলে আচ্ছামতো ধোলাই দিল ব্যাটাকে।
বাহারের সঙ্গে বাইরে এসে সঙ্গীকে খুঁজছে মেয়েটি। জিনসের পকেট থেকে মোবাইল বের করে কল করল। একটু পর উদ্বিগ্ন স্বরে ‘এই, তুমি কোথায়’ বলার পর একবার ‘কী বলতেস, কিছুই বুজতেসি না’ বলে অনেকক্ষণ আর কোনো কথা বলল না, শুনে গেল কেবল। একটু পর রাগে আছাড় মারার ভঙ্গিতে ফোনের লাইন কাটল। বাহার কী বলবে ঠিক বুঝে উঠছে না। আসলে নিজেকে কিছুটা অপরাধীও লাগছে তার। কিন্তু ব্যাপারটা হালকা করার কোনো সুযোগ পাচ্ছে না। একভাবে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটি। কাঁদতে শুরু করল নিঃশব্দে।
কী হলো আবার!
এখন আর সরাসরি ঢাকার বাস পাবে না বলে বাহার জানাল মেয়েটিকে। তাদের গড়িতে উঠতে বলল। চট্টগ্রাম নামিয়ে দিয়ে আসবে। আশ্বাস দিল, সেখান থেকে একটা ব্যবস্থা হবেই। জানতে চাইল, তার সঙ্গের ছেলেটা কোথায়। সে আসছে না কেন। জবাবে সে রেপড হয়েছে ধারণা করে ওকে ছেড়ে চলে গেছে বলে উষ্মাভরা বিষণ্ন গলায় জানাল মেয়েটি।
অবাক হয়ে কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারল না বাহার।
তারপর আশ্বাস দিয়ে বলল, তাকে চট্টগ্রামে ভালো কোনো বাসে তুলে দিয়ে তবেই সে ফিরবে। একা যেতে ভয় পাবে কি না, জানতে চাইল। জবাবে সে কোথায় যাচ্ছিল, সেটা জিজ্ঞেস করল দিলতানা। টেকনাফের পথে মরিচার কথা শুনে চুপ করে রইল।
এখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। বখা ছেলেগুলো কোনো ঝামেলা করতে পারে। মেয়েটিকে তাড়া দিয়ে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল। চাবি ঢুকিয়েও থমকে গেল বাহার তার কথা শুনে, খুব শান্তভাবে সে এখন তার সঙ্গে টেকনাফ যাবে বলে জানাল। রেগেমেগে নেমে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে সাফ জানিয়ে দিল দিলতানা, সাহায্য করতে চাইলে তাকে সঙ্গে নিয়েই যেতে হবে। এবং পরে সে তার সঙ্গেই ঢাকা ফিরবে, পরশু-তরশু কিংবা অন্য কোনো দিন, যখন বাহারের রিপোর্ট রেডি হবে, কিংবা হবে না।
তার কথা শুনে হাঁ করে তাকিয়ে রইল বাহার।
অনেক ওপরে কেউ হয়তো একটা মুচকি হাসি দিল।