নজরুলের সাম্যবাদ

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজফ্ফর আহ্‌মেদ ছিলেন নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একক ব্যক্তি হিসেবে কবির মানস গঠনে তিনি যতটা প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, সম্ভবত অন্য কেউ তা করেননি। তাঁর কাছ থেকে তিনি কেবল অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা লাভ করেননি, ধনী-দরিদ্রভেদে মানুষ যে সমান, এই ধারণাও অর্জন করেছিলেন। মুজফ্ফর আহ্‌মেদের এই প্রভাব এতটাই গভীর ছিল যে, কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার কথাও কবি একসময়ে ভেবেছিলেন, যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি পার্টিতে যোগ দেননি। কারণ তিনি পার্টির নিয়মকানুন মেনে চলার মতো মানুষ ছিলেন না, তিনি চলতেন আপন খেয়ালে। তিনি যে লিখেছিলেন, ‘আমি দলে যাই যত নিয়ম কানুনশৃঙ্খল।’ সেটা স্রেফ কবিত্বের কথা ছিল না। এ বৈশিষ্ট্য তাঁর নিজের স্বভাবের মধ্যেই প্রোথিত ছিল। তা ছাড়া, প্রথম দিকে তাঁর হৃদয়ে যে অফুরন্ত মানবপ্রেম ছিল, তা দিয়ে তিনি মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ থাকবে না, দরিদ্ররা দুবেলা দুমুঠো খেতে পাবে—এই সরল সত্যটা যতটা বুঝতেন, মার্ক্সবাদী শ্রেণি-সংগ্রামভিত্তিক সাম্যবাদ সম্পর্কে তাঁর ধারণা ততটা সম্যক ছিল না।

এই ধারণা তাঁর কাছে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৯২৫ সালের শেষ দিকে, কুতুবউদ্দীনের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে অংশ নেওয়ার সময়ে। কুতুবউদ্দীন প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করলেও কমিউনিস্ট দলের প্রতি তাঁর আনুগত্য ছিল একান্তভাবে আন্তরিক। তখনকার সরকারি প্রতিবেদনে তাঁকে আখ্যায়িত করা হয়েছিল ‘বলশেভিক এজেন্ট’ বা বলশেভিকদের দালাল হিসেবে। তিনি ছিলেন উর্দুভাষী। তাই তিনি বাঙালি কবি নজরুল ইসলামকে তাঁর পক্ষে প্রচারাভিযানে অংশ নিতে অনুরোধ করেছিলেন। নজরুল তখন অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। তা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট মুসলিম-নির্বাচনী এলাকা থেকে কুতুবউদ্দীন ফিরে এসেছিলেন মাত্র ১২৪টি ভোট নিয়ে। আর নজরুল ফিরেছিলেন দৃশ্যত ম্যালেরিয়া এবং রক্ত-আমশয় নিয়ে। কিন্তু অদৃশ্য যা নিয়ে ফিরেছিলেন, তা হলো সাম্যবাদী চিন্তাধারায় বর্ধিত আস্থা।

তারই প্রভাবে কয়েক সপ্তাহ পরে পয়লা নভেম্বর Ñ হেমন্তকুমার সরকার ও কুতুবউদ্দীনসহ কয়েক বন্ধুকে নিয়ে তিনি কংগ্রেস দলের মধ্যেই লেবার স্বরাজ নামে একটি উপদল গঠন করেন। তিনি ও তাঁর বন্ধুরা উপলব্ধি করেছিলেন যে, তখনকার রাজনীতি সীমাবদ্ধ ছিল কেবল শহরের শিক্ষিতদের মধ্যে। সেই রাজনীতিকে কৃষক-শ্রমিকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁরা এই দল গঠন করেছিলেন। এই দল কৃষক-শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে দাবি-দাওয়া উত্থাপন করেছিল। এরই সূত্র ধরে পরের মাসে কবি তাঁর বন্ধুদের নিয়ে এই দলের মুখপত্র হিসেবে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটির নাম দেন লাঙল। নাম থেকেই বোঝা যায় পত্রিকাটি কাদের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকা প্রকাশের জন্য এক হাজার টাকা দিয়েছিলেন কুতুবউদ্দীন।

কবি এ সময়ে একগুচ্ছ কবিতা লেখেনÑ‘সাম্যবাদী’ নাম দিয়ে এবং তা প্রকাশিত হয় পত্রিকার প্রথম সংখ্যায়। এ কবিতাগুচ্ছ তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলোর অন্যতম। এ কবিতাগুলোর বিষয়বস্তু হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন ‘ঈশ্বর’ থেকে আরম্ভ করে ‘চোর-ডাকাত’, ‘কুলি-মজুর’, ‘বারাঙ্গনা’ ইত্যাদি নিম্নশ্রেণির মানুষ পর্যন্ত। এই কবিতাগুচ্ছ এবং সর্বহারা কাব্যের কৃষক, শ্রমিক ও ধীবরদের নিয়ে রচিত তিনটি কবিতায় সাম্যবাদ সম্পর্কে কবির ধারণা প্রকাশিত হয়েছে।

যেমন: ‘কুলি-মজুর’ কবিতায় তিনি বলেছেন, শ্রমজীবীদের শ্রমের বিনিময়ে সভ্যতা গড়ে উঠেছে। সুতরাং সভ্যতার পরিচালিকা শক্তি তাদেরই হাতে ন্যস্ত থাকার কথা: ‘সিক্ত যাদের সারা দেহ-মন মাটির মমতা-রসে/এই ধরণির তরণীর হাল রবে তাহাদেরি বশে!’ এ কবিতাগুচ্ছের প্রথম কবিতা ‘সাম্যবাদী’র বক্তব্যও মূলত এক। এ কবিতায় তিনি বলেছেন, মানুষে-মানুষে সব ধর্মীয় এবং জাতিগত ব্যবধান ঘুচে গেছে, ‘যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রিশ্চান। পারস, জৈন, ইহুদি, সাঁওতাল, ভিল, গারো?’ কারণ, মানুষের ‘হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।’ এবং ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!’ ভিখারি, চাষি, চণ্ডাল, রাখাল—মানুষ হিসেবে সবারই অভিন্ন পরিচয়। বিচিত্র নামের আড়ালে এসব কবিতার মূলে আছে মানবপ্রেম এবং শ্রেণি-নির্বিশেষে সামাজিক সাম্য। এই হলো নজরুলের সাম্যবাদী চিন্তার স্বরূপ। এ সময়কার কিছু কবিতায় সমকালীন রাজনীতির কথাও প্রতিফলিত হয়েছে।

মুজফ্ফর আহ্‌মেদ
মুজফ্ফর আহ্‌মেদ

কিন্তু তিনি ‘সর্বহারা’ ও ‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছে সামাজিক সাম্য ও দরিদ্রদের অধিকারের কথা লিখলেও, এসব কবিতায় কবি ‘তারা’ ও ‘আমরা’র ভেদ রক্ষা করেছিলেন। তিনি দূর থেকে কুলি-মজুর-চাষি-ধীবর ইত্যাদি সমাজের সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্রদের দেখে তাঁদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে এ কবিতাগুলো রচনা করেছিলেন। তাঁর আন্তরিকতায় ঘাটতি ছিল না, কিন্তু এসব কবিতায় তিনি এই দরিদ্রদের সঙ্গে নিজেকে শনাক্ত করতে পারেননি। সেদিক দিয়ে ‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছ মানবিক দরদে পরিপূর্ণ, কিন্তু শ্রেণিসংগ্রামের বিচারে সাম্যবাদী কবিতা নয়।

১৯২৫-২৬ সালে রচিত এই কবিতাগুলোর পরবর্তী প্রায় পনেরো বছর কবির সৃষ্টিকর্মে ‘সাম্যবাদী’ চেতনার প্রতিফলন তেমন একটা লক্ষ করা যায় না। কিন্তু নতুন করে দরিদ্রদের প্রতি আন্তরিক দরদের প্রকাশ লক্ষ করি নজরুল-জীবনের একেবারে শেষ পর্বে, অর্থাৎ কবি অপ্রকৃতিস্থ হওয়ার ঠিক আগেকার পর্বে। ১৯৪১-৪২ সালে সমাজের নিচের তলার মানুষের দারিদ্র্য এবং নিম্ন মর্যাদা নিয়ে তিনি অনেকগুলো কবিতা রচনা করেছিলেন। এই কবিতাগুলো রচনা করার পেছনে আপাতদৃষ্টিতে বিশেষ কোনো উপলক্ষ ছিল বলে মনে হয় না। কবিতাগুলোর সম্ভবত সব কটিই দৈনিক নবযুগ-এ প্রকাশিত হয়েছিল।

এসব কবিতায় তিনি সর্বহারাশ্রেণির সঙ্গে আগের তুলনায় নিজেকে অনেকটা একাত্ম বোধ করেছেন এবং শ্রেণি-সংগ্রামের কথাও স্পষ্ট করে বলেছেন। ধনীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছেন যে, দরিদ্ররা তাদের দ্বারে এসেছে অধিকার নিয়ে, তাদের ভাগ তাদের দিয়ে দাও, নয়তো ওরা কেড়ে নেবে। আলোচ্য কবিতাগুলো তাই সাম্যবাদী ও শ্রেণিসংগ্রাম ধারণায় সম্পৃক্ত। কিন্তু এ কবিতাগুলোতে আরেকটি বৈশিষ্ট্য নির্ভুলভাবে দেখা যায়, সে হলো সাম্যবাদী ধারণার সঙ্গে তাঁর নব্য-ধর্মীয় চেতনাও এ কবিতাগুলোয় একাকার হয়ে আছে।
১৯৪২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, অর্থাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ার সাড়ে চার মাস আগে প্রকাশিত একটি কবিতায় ধারণাটি অবাস্তব ও ইউটোপিয়ান হলেও কবি বলেছেন: ‘রবে না দারিদ্র্য রবে না অসাম্য’:
‘জয় হোক জয় হোক আল্লার জয় হোক/শান্তির জয় হোক সাম্যের জয় হোক/সত্যের জয় হোক জয় হোক জয় হোক।...নহিলে আল্লার আদেশ না মানিবে/পরকালে দোজখের অগ্নিতে জ্বলিবে/...রবে না দারিদ্র্য রবে না অসাম্য/সমান অন্ন পাবে নাগরিক গ্রাম্য/রবে না বাদশা রাজা জমিদার মহাজন/কারও বাড়ি উৎসব কারও বাড়ি অনশন।’

লক্ষণীয় এই যে, এ কবিতায় ধনীদের তিনি শ্রেণি-সংগ্রামের ভয় না দেখিয়ে দোজখের আগুনে পোড়ার ভয় দেখিয়েছেন।

 ‘দরিদ্র মোর পরমাত্মীয়’ কবিতায়ও সর্বহারাদের প্রতি কবি তাঁর গভীর সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু শ্রেণি-সংগ্রামের শেষে তারা জয়ী হবে—এ কথা বলেননি; বরং আল্লাহর আশ্বাসের কথা বলেছেন। ‘আল্লা আমার সহায়—আল্লা পুরাবেন মোর আশ;/গরিব ভাইরা ভয় নাই, আসে আল্লার আশ্বাস।/আসে আল্লার কাবার শির্নী, ক্ষুধার খোরাক আসে—রোজা শেষ হবে, দেখিব ঈদের চাঁদ পুন এ আকাশে। /দরিদ্র মোর নামাজ ও রোজা, আমার হজ-জাকাত; উহাদের বুকে কাবা-ঘর; মহা মিলনের আরফাত।’

‘ঈদের চাঁদ’ কবিতায়ও ঈদ উপলক্ষে নিজেদের ভাগ আদায় করে নেওয়ার জন্য চাষি, মজুর ও বিড়িওয়ালাদের আগমনের কথা বলেছেন, কিন্তু দোহাই দিয়েছেন আল্লাহ তাআলার: ‘সিঁড়িওয়ালাদের দুয়ারে এসেছে আজ/চাষা মজুর ও বিড়িওয়ালা; /মোদের হিস্‌সা আদায় করিতে ঈদে/দিল হুকুম আল্লাতালা/দ্বার খোলো সাততলা-বাড়ি-ওয়ালা, দেখো কারা দান চাহে, /মোদের প্রাপ্য নাহি দিলে যেতে নাহি দেব ঈদগাহে।’

শ্রেণি-সংগ্রামের কথা স্মরণ করিয়ে না দিয়ে তিনি আল্লাহর বিচারের কথা ‘শ্রমিক মজুর’ কবিতায়ও বলেছেন। তবে এ কবিতাটি তিনি আল্লাহর দোহাই দিয়ে শেষ করেননি; বরং সর্বহারাদের ‘শক্তি’র কথা বলেছেন। এ কবিতায় আমরা ধর্ম ও শ্রেণি-সংগ্রাম—উভয়ের কথা শুনতে পাই: ‘নহে আল্লার বিচার এ ভাই, মানুষের অবিচারে/আমাদের এই লাঞ্ছনা, আছি বঞ্চিত অধিকারে/...দেখেছি নিজের শক্তিকে, আর লাঞ্ছনা সহিব না!/যে হাত হাতুড়ি দিয়া গড়িয়াছি প্রাসাদ হর্ম্যরাজি,/সেই হাত দিয়া বিলাস-কুঞ্জ ধ্বংস করিব আজি।...গড়ার হাতুড়ি ধরেছি, এবার ভাঙার হাতুড়ি ধর।’ কবি এখানে শ্রেণি-সংগ্রাম সম্পর্কে তাঁর অভ্রান্ত সচেতনতা প্রকাশ করেছেন। তা ছাড়া, অন্যত্র তিনি এ কথাও ঘোষণা করেছেন যে, নির্যাতিতের ধর্মীয় পরিচয় নেই।

জানি না, তাহারা হিন্দু কি ক্রিশ্চান কি মুসলমান।

নির্যাতিতের জাতি নাই, জানি মোরা মজলুম ভাই।

তবে কবির দৃষ্টিভঙ্গি এ সময়ে ধর্মীয় চিন্তা দিয়ে এত প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছিল যে, নির্যাতিতের কোনো ধর্মীয় পরিচয় নেই, এ কথা বলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি আল্লাহর দোহাই দিয়েছেন:

‘এক আল্লার সৃষ্টিতে আর রহিবে না কোনো ভেদ,...

টলেছে খোদার আসন টলেছে, আল্লাহু-আকবর।...

সাত আসমান বিদারী আসিছে তাঁহার পূর্ণ ক্রোধ,

জালিমে মারিয়া করিবেন মজলুমের প্রাপ্য শোধ।’

তিনি অবশ্য নিজের সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করেছেন ‘কেন আপনারে হানি হেলা’ কবিতায়। নিজের সৃষ্টি সর্বহারাদের জন্য নয় বলে তিনি এ কবিতায় অনুশোচনাও প্রকাশ করেছেন।

‘মোর বাণী ছিল রসলোকের আল্লার বাণী শুনিনু এই,

বিলাসের নেশা গেল টুটে জেগে দেখি আর সে আমি নেই।...

জমিদার মহাজনপাড়ায় মেয়ের বিয়েতে বাজে সানাই

ইহাদের ঘরে বার্লি নাই ওদের গোয়ালে দুধেল গাই।

আগুন লাগুক রসলোকে, কত দূরে সেথা কারা থাকে?...

মুক্তি চাহি না, চাহি না যশ, ভিক্ষার ঝুলি চাহি আমি,

এদের লাগিয়া মাগিব ভিখ, দ্বারে দ্বারে কেঁদে দিবাযামী।’

ভিক্ষা এবং দ্বারে দ্বারে কান্নার কথা বলে এ কবিতায় নজরুল আরও একবার প্রমাণ করেন, তিনি শ্রমিকশ্রেণির প্রতি আন্তরিকভাবে দরদি হলেও তিনি নিজে শ্রমিকশ্রেণির সদস্য নন, তিনি মধ্যবিত্ত। কিন্তু এ কবিতার অল্পকাল পরে চিয়াংকাইশেকের আগমন উপলক্ষে ১৯৪২ সালের প্রথম দিকে তিনি যে গানটি গ্রামোফোন কোম্পানির ফরমাশে রচনা করেন, তাতে তিনি শ্রমিকশ্রেণির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন: ‘হইব সর্বজয়ী আমরাই সর্বহারার দল/সুন্দর হবে, শান্তি লভিবে নিপীড়িত ধরাতল।’ মোট কথা, একুশ-বাইশ বছরজুড়ে বিস্তৃত তাঁর কবিজীবনের প্রথম ছয়-সাত বছর পর্যন্ত তিনি যতটা শোষিত মানুষের জন্য আন্তরিক সহানুভূতি দেখিয়েছেন, পরবর্তী প্রায় বছর পনেরো সেখান থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলেন। তারপর আলো নেভার ঠিক আগে, শেষের আট-নয় মাস—তিনি আবার নিঃস্বদের জন্য তাঁর সমমর্মিতা প্রকাশ করেন। এবারে সেই সহানুভূতির সঙ্গে বাড়তি যা দেন, তা হলো সৃষ্টিকর্তার দোহাই।

খেয়াল করলে দেখা যায়, শোষিত মানুষের প্রতি সচেতনতা দেখালেও দেশের রাজনীতির প্রতি তাঁর সচেতনতা তত দিনে প্রায় লোপ পেয়েছিল। যে নজরুল একদা রাজনৈতিক কবিতা লিখে বিস্ময়ে অভিভূত পাঠক-সমাজের হৃদয় জয় করেছিলেন এবং তাঁদের মনে সাহস ও আশাবাদ জুগিয়েছিলেন, ১৯২৬ সালের পর থেকে সেই নজরুল রাজনীতির অঙ্গন থেকে যোজন-যোজন দূরে সরে যান—সে রাজনীতি দেশীয় হোক, অথবা আন্তর্জাতিক। রাজনীতিক নন, কবি হয়েও বঙ্গদেশের তাবৎ রাজনীতিকের আগে তিনি লিখিতভাবে ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানিয়েছিলেন, ১৯২২ সালে। তারপর ১৯২৬ সালের শেষ অবধি রাজনীতির প্রতি তাঁর আন্তরিক আগ্রহ বজায় ছিল। সেই আগ্রহ লোপ পেল নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর (নভেম্বর ১৯২৬)। কিন্তু সে কি নির্বাচনে হেরে যাওয়ার দরুন, নাকি রাজনীতির সত্যিকার চেহারা বুঝতে পারার কারণে, তা সঠিক বলা মুশকিল। এ সময়ে তিনি যে কেবল কংগ্রেসি রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেলেন তা-ই নয়, সর্বহারাদের রাজনীতি থেকেও ছিটকে পড়লেন।

১৯২৫ সালের পয়লা নভেম্বর তারিখে তাঁরই স্বাক্ষরে যে লেবার স্বরাজ গঠিত হয়েছিল কৃষক-শ্রমিকদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে, বছর তিনের মধ্যে তিনি সেই দলের বার্ষিক সম্মেলনে পর্যন্ত অনুপস্থিত থাকেন। সব শেষবার তাঁকে বামপন্থীদের সম্মেলনে যোগ দিতে দেখি ১৯২৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ২৩ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত সেই সম্মেলনে তিনি গান পরিবেশন করেছিলেন। অনুষ্ঠানের পরের দিন সম্মেলনের সভাপতি মুজফ্ফর আহ্‌মেদ কলকাতায় ফিরে যান। আর নজরুল কদিনের জন্য কুষ্টিয়াতেই থেকে যান। অতঃপর মুজফ্ফর আহ্‌মেদ দীর্ঘদিনের জন্য গ্রেপ্তার হন। আর নজরুল যাত্রা করেন কেবল বামপন্থী রাজনীতির জগৎ থেকে নয়, সার্বিকভাবে রাজনীতির জগৎ থেকেই অন্তহীন দূরে—গানের জগতের উদ্দেশে। তারপর রাজনীতি নয়, স্বাধীনতা আন্দোলন নয়, তিনি এক ধর্ম-সম্পৃক্ত সাম্যবাদী চিন্তা-জগতে ফিরে যান অসুস্থ হওয়ার স্বল্পকাল আগে।