আলোছায়ার ফুটবল

>

ফুটবলের শুরু কবে? জন্মলগ্নে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কীভাবে হতো এই খেলাটি? প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আধুনিক যুগে কী কী বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে ফুটবল? উরুগুয়ের ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক এদুয়ারদো গ্যালিয়ানোর লেখা সকার ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো বইয়ে আছে ফুটবলের আদ্যোপান্ত ইতিহাস। ফুটবল নিয়ে এ পর্যন্ত লেখা বইগুলোর ভেতরে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছে এটি। এই বই থেকে নির্বাচিত অংশের অনুবাদ।

সকার ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো-এর প্রচ্ছদ
সকার ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো-এর প্রচ্ছদ

ফুটবলের ইতিহাস সত্যিকার অর্থে সৌন্দর্য থেকে কর্তব্যের দিকে এক দুঃখজনক যাত্রা। খেলাটা যেদিন বাণিজ্যের পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়, খেলার মুহূর্তগুলো থেকে উথলে ওঠা আনন্দ সেদিন শিকড়সহ উপড়ে নেওয়া হয়। বিড়াল যেভাবে উলের বল নিয়ে খেলে, মানুষ যদি তেমনি করে নিজেকে ভুলে বেলুনে লাথি মেরে খেলতে খেলতে শিশুও হয়ে যায়, তবু সেই অনির্বচনীয় আনন্দ থেকে কেউ কোনো পয়সা আয় করতে পারে না। মানুষ যদি নিজের অজান্তে খেলে, সেখানে না থাকে সময়ের কোনো হিসাব, না থাকে রেফারির প্রয়োজন। অথচ সেসব বাদ দিয়ে একদিন খেলা হয়ে ওঠে প্রদর্শনী, যেখানে নাটকের মূল চরিত্রে কয়েকজন আর বাকিরা প্রদর্শনীর অংশ, ফুটবল যখন কেবল দেখার। আর তারপরে সেই প্রদর্শনীই হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আয়ের ব্যবসাগুলোর অন্যতম। ফুটবল ম্যাচ তাই খেলার জন্য নয়, খেলার আনন্দ মুছে ফেলার জন্যই যেন এর আয়োজন। বিজ্ঞানের অগ্রগতি আর বাণিজ্যিক খেলার আয়োজন ফুটবলকে যেন আলোর গতিতে খেলার ক্ষমতা এনে দিয়েছে; অপরিমেয় শক্তি জুগিয়েছে আয়োজকদের। কিন্তু হয়ে পড়েছে এমন এক খেলা যা সাবলীল আনন্দকে উপেক্ষা করে, অবাস্তব কল্পনাকে করে খুন আর দুঃসাহসিকতাকে অনিয়ম বলে মনে করে।
প্রথমে খেলোয়াড়ের কথাই ধরা যাক, সে পাখায় ভর করে ওড়ার মতো দৌড়ায়। তার একদিকে যেন স্বর্গের ঝকমকে শোভা, আরেক দিকে ধ্বংসের গভীর হতাশা। আশপাশের সবার ঈর্ষার কারণ সে। সে যেন লটারি পেয়েছে। তার শরীর থেকে যদি বালতির পর বালতি ঘাম ঝরে, তবু তার পরাজিত হওয়ার বা ক্লান্ত হওয়ার অধিকার নেই। তাকে দেখা যাবে টেলিভিশনে, তার ছবি উঠবে খবরের কাগজে, রেডিওতে তার নাম শোনা যাবে, তরুণীরা তার নামে অজ্ঞান হবে, শিশুরা তার মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখবে। কিন্তু হয়তো নিম্নবিত্তের ময়লা অলিগলিতে সামান্য আনন্দ পাওয়ার জন্য সে খেলতে শুরু করেছিল, আর এখন স্টেডিয়ামে খেলে কর্তব্যের খাতিরে, যেখানে কেবল বিজয় এবং বিজয় ছাড়া তার অন্য কিছু ভাবার উপায় নেই। ব্যবসায়ীরা তাকে কেনে-বেচে, তাকে ধার দেয়, আর সে তাকে নিয়ে নানান পরিকল্পনা সাজাতে দেয় কেবল আরও জনপ্রিয়তা, আরও টাকার জন্য। সে যত সফল হয় ততই টাকা বানাতে পারে, তত বেশি বন্দীও হয়ে পড়ে। তাকে তখন সেনাবাহিনীর মতো বাধাধরা নিয়মের জালে আটকে পড়তে হয়। প্রতিদিনের প্রশিক্ষণে তার শরীর জর্জরিত হয়, ব্যথার ওষুধ আর কর্টিসানের প্রভাব আঘাতের ব্যথা লুকিয়ে তার শরীরটাকে বোকা বানায়। বড় কোনো ম্যাচের আগে তাকে বিশেষ কেন্দ্রে রাখা হয়, যেখানে সে বিশেষ ধরনের শরীরচর্চায় বাধ্য, খেতে বাধ্য স্বাদবিহীন খাবার আর যেখানে তার একমাত্র পানীয় হয় পানি, যেখানে তাকে ঘুমাতেও হয় একা। অন্য যেকোনো পেশায় মানুষ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বুড়ো হয়, অথচ একজন ফুটবল খেলোয়াড় তিরিশ বছর বয়সেও বুড়ো হয়ে যেতে পারে।
এরপরে, গোলকিপার। অনেকে তাকে বলে ডোরম্যান, কিপার, বাউন্সার বা নেট-মাইন্ডার। কিন্তু তাকে আসলে বলা যেতে পারে শহীদ, অনুতাপের আধার কিংবা ঘুষির উপযুক্ত এক ব্যাগ। সে একাকী দূরে দাঁড়িয়ে খেলা দেখার বাধ্য দর্শক। গোলপোস্ট ছেড়ে সে নড়তে পারে না। দুটো পোস্ট আর ক্রসবার তার বরাবরের সঙ্গী। সে যেন ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড়িয়ে প্রতিমুহূর্তে একটা গুলির অপেক্ষা করে। গোল তো সে করেই না বরং গোল ঠেকানোই তার কাজ। সে তার পিঠের পেছনে এক নম্বর লাগায়, সে কি সবচেয়ে প্রথমে মূল্য বুঝে পাওয়ার জন্য? না, সবচেয়ে প্রথমে নিজেকে উৎসর্গের জন্য। কারণ, গোল নিয়ে যা কিছু ভুল সব কিপারেরই দোষ। আর যখন তার দোষ নয় তখনো সে-ই দোষী। এমনকি কোনো খেলোয়াড় যদি ফাউল করে তাহলেও শাস্তিটা বেচারা গোলকিপারেরই প্রাপ্য। বাকি সবাই মিলে তাকে তখন শূন্য গোলপোস্টের সামনে একাকী নিজের ফাঁসির আদেশ প্রদানকারীর মুখোমুখি হতে বাধ্য করে। এত কিছুর পরেও দর্শক গোলকিপারকে কখনো ক্ষমা করে না।
আদর্শ খেলোয়াড়। কোনো এক শুভ দিনে বাতাসের দেবী একজন মানুষের পায়ে চুমু বসিয়ে দেয়, নিদারুণ অবহেলা আর অবজ্ঞায় অভ্যস্ত কোনো পা আদরের প্রভাবে ফুটবলের অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হয়। ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে সে জানে কীভাবে হাঁটতে হয়, কীভাবে খেলতে হয়। ছোটকালে সে হয়তো বালুতে বল ছুড়ে ঝড় তুলেছিল, উপেক্ষিত এলাকার পতিত জমিতে রাতের অন্ধকার নামা অবধি উন্মাদের মতো খেলেছে, যখন কিনা অন্য কেউ বলটা আর দেখতে পেত না। তারুণ্যের শুরুর দিকটায় সে যখন কোথাও উড়ে যেত, স্টেডিয়ামগুলোও তার সঙ্গে উড়ত। তার চমৎকার শারীরিক ভঙ্গি মানুষকে পাগল করত, পাগল করত রবিবারের পর রবিবারে বিজয়ের পর বিজয়ে উদ্‌যাপনের পর উদ্‌যাপনে। কিন্তু একজন আদর্শ খেলোয়াড় কেবল একটি মুহূর্তের জন্য আদর্শ হয়ে ওঠে, চিরকালের হিসাবে সেই মুহূর্তের কোনো মূল্য নেই। আবার যখন সোনার পা দুটো খোঁড়া হাঁসের পায়ে পরিণত হয়, তারকা তখন তার ঝলমলে ভ্রমণ শেষে অন্ধকূপের দিকে যাত্রা করে। তার শরীরে তখন জোকারের পোশাকের চেয়েও বেশি জোড়াতালি থাকে। শারীরিক ভঙ্গি হয়ে ওঠে পঙ্গুর মতো, তার ভেতরের শিল্প যেন তারই বোঝা হয়ে ওঠে। তারকা কখনো মাটিতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায় আর তার ভক্তরা টুকরোগুলো টপাটপ গিলে ফেলে।

উরুগুয়ের মন্টিভিডিওতে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে উরুগুয়ের প্রথম গোল, ৩০ জুলাই ১৯৩০। ছবি: সংগৃহীত
উরুগুয়ের মন্টিভিডিওতে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে উরুগুয়ের প্রথম গোল, ৩০ জুলাই ১৯৩০। ছবি: সংগৃহীত

এবারে ভক্ত। ভক্তের হাতে ব্যানার ওড়ে, বাতাস ভারী হয় তাদের চেঁচামেচিতে, তাদের ফোটানো বাজি-পটকা-আতশবাজিতে আকাশ ভরে ওঠে, মনে হয় যেন ভালোবাসার বৃষ্টি। ভক্তকুল বাড়িতে টেলিভিশনের সামনে বসেও আরাম করে খেলাটা উপভোগ করতে পারে, কিন্তু তারা পছন্দ করে সেখানে পৌঁছাতে, যেখানে প্রিয় দেবদূতের সঙ্গে সেদিনের অসুরের যুদ্ধ হবে। ভক্ত প্রায় বলতেই পারে না যে, ‘আমার টিম আজকে খেলবে’, বলে ‘আজ আমরা খেলব’; ‘গোল’ বলতে পারে না, বলে ‘গোওওওওওওওওল’। খেলার মাঠে ভক্ত বারো নম্বর খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হয়। দলও জানে যে ভক্তের উপস্থিতিবিহীন খেলা যেন তাল-লয়-সংগীত ছাড়া নাচের অনুষ্ঠান। খেলা শেষে ভক্তের মুখে শোনা যায়, ‘কী একটা গোল আজ আমরা করলাম!’ কিংবা ‘কেমন মারটা মারলাম ওদের!’ আবার হারলে ভক্ত তাড়াতাড়ি স্টেডিয়াম ছাড়ে, বলে, ‘তারা আবারও আমাদের ওপরে বাটপারি করল! ওই রেফারি ব্যাটাই ঠকিয়েছে!’ আর তারপর সূর্য ডোবার মতো ভক্তও উবে যায়, স্টেডিয়াম যেমন ফাঁকা পড়ে থাকে, ভক্তও নিজের বাড়িতে ফেরে একা। ‘আমরা’ থেকে সে আবারও ‘আমি’ হয়ে যায়। 

আহা রেফারি! ঠোঁটের মাঝখানে বাঁশি আর হাতে নানা রঙের কার্ড নিয়ে খেলোয়াড় ছাড়া সে-ই একমাত্র খেলার মাঠে প্রবেশের অধিকার পায়। তার দায়িত্ব হলো নিজেকে প্রত্যেকের কাছে ঘৃণার উপযুক্ত করে তোলা। তার চেয়ে বেশি কেউ দৌড়ায় না। তবু কোনো প্রশংসা শোনে না, শোনে কেবল শিস। এক সমুদ্র ঘামে নেয়ে সে খেলোয়াড়দের পায়ের ফাঁকে ফাঁকে এঁকেবেঁকে ছোটে। ওদিকে উন্মত্ত ভক্তরা তার মাথা কেটে নেওয়ার হুমকি দেয়। তারও নিশ্চয় খেলতে ইচ্ছে করে কিন্তু কখনোই সে সুযোগ পায় না। তার ওপরে যদি কোনোভাবে বল একবার গিয়ে তার গায়ে লাগে তবে তাকে বাপ-মা তুলে গালি দেওয়াটা স্বাভাবিক। পরাজিতরা তাদের পরাজয়ের দায় চাপায় রেফারির ওপরে আর বিজয়ীরা বিজয়ের উল্লাসে একবারও তার কথা মনে করে না। প্রায় এক শতক ধরে রেফারি শোকের রঙের পোশাক পরত; পরত কার জন্য? কার আর, নিজের জন্যই। ইদানীং দুঃখ-কষ্ট ঢাকতে সে রঙিন কাপড় পরে।
চীনের লোকেরা দড়ির গোল্লা ভেতরে পুরে চামড়া দিয়ে বল বানাত। মিশরীয় ফারাও সম্রাটের আমলে রঙিন কাপড়ে খড় আর বীজের খোসা মুড়িয়ে বল বানানো হতো। গ্রিক আর রোমানরা বল বানাতে ষাঁড়ের মূত্রথলি ফুলিয়ে সেলাই করে নিত। মধ্যযুগীয় ইউরোপিয়ান আর রেনেসাঁর যুগের মানুষেরা ওভাল আকৃতির বলের ভেতরে ভরত ঘোড়ার লোম। আমেরিকানরা রাবারের এমন হালকা বল বানাত যা যেকোনোখানে লাফাত। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে রাবারের প্রকোষ্ঠে বাতাস পুরে চামড়া দিয়ে মোড়ানো বলের প্রচলন হলো। এ জন্য ধন্যবাদটুকু আমেরিকার কানেকটিকার বুদ্ধিমান চার্লস গুডইয়ারের প্রাপ্য। তারও অনেক দিন পরে আর্জেন্টিনার করডোবা থেকে তিনজন, টসোলিনি, ভালবোনেসি আর পোলোর হস্তক্ষেপে বল থেকে ফিতার ব্যবহার উঠে যায়। ভাল্বের সাহায্যে গঠিত এক চেম্বারে ইনজেকশনের মাধ্যমে বাতাস ঢোকানোর কায়দা বের করেন তাঁরা। আর সে কারণে ১৯৩৮ সালের বিশ্বকাপের সময় থেকে বলকে সহজেই ব্যথাবিহীনভাবে মাথা দিয়ে ধাক্কা দেওয়া সম্ভব হয়েছে; আগে ফিতার জোড়ার কারণে যা খুব কষ্টসাধ্য ছিল। বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বলের রং ছিল বাদামি। পরে হয়ে যায় সাদা। আমাদের সময়ে তা সাদার ওপরে বিচিত্র কালো নকশায় দেখা যায়। মানুষ একে বিভিন্ন নামে ডাকে, স্ফিয়ার, রাউন্ড, টুল, গ্লোব, বেলুন কিংবা প্রজেক্টাইল। ব্রাজিলে কারও সন্দেহ নেই যে বল এক তরুণী। তাই তো মারাকানায় হাজারতম গোল করে পেলে বলটাকে ওইভাবে চুমু খেয়েছিল! তা ছাড়া, বল কখনো মাঝপথে মত বদলে ফেলতে পারে, গোলপোস্টের দিকে গিয়েও শেষে কিনা বেঁকে চলে যায় আরেক দিকে। সে সহজেই বিব্রত হয়। সে যেন আদর আর চুমুতেই অভ্যস্ত, বুকে কিংবা হাঁটুর ওপরে ঘুমোতে পটু। সে মানুষকে বড় ভালো করে চেনে। সে জানে যে দারুণভাবে উড়ে চললে মানুষ তাকে ভালোবাসে আর বিশ্রীভাবে কোথাও গিয়ে নামলে মানুষের হৃদয় খানখান হয়ে যায়। আর তাই হয়তো ১৯৩০ সালের বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলায় দুই দলই তাদের নিজস্ব বল নিয়ে খেলার ব্যাপারে জেদ ধরে বসেছিল। শেষ পর্যন্ত কোনো সমাধান না পেয়ে রেফারিকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে প্রথম অর্ধেক খেলা হবে আর্জেন্টিনার বল দিয়ে আর দ্বিতীয় অর্ধেকের সময়ে ব্যবহার করা হবে উরুগুয়ের বল।

ক্যারিয়ারের এক হাজারতম গোল করার পর মারকানা স্টেডিয়ামে ফুটবলার পেলের উদ্‌যাপন, ১৯৬৯। ছবি: সংগৃহীত
ক্যারিয়ারের এক হাজারতম গোল করার পর মারকানা স্টেডিয়ামে ফুটবলার পেলের উদ্‌যাপন, ১৯৬৯। ছবি: সংগৃহীত

অন্য অনেক কিছুর মতো বল খেলার ক্ষেত্রেও চায়নিজরাই ছিল প্রথম। পাঁচ হাজার বছর আগে চায়নিজ জাগলাররা তাদের হাঁটুর ওপরে বল নাচানোর খেলা দেখাত। তারপর প্রজন্মের পর প্রজন্ম খেলে গেছে। খ্রিষ্টের জন্মের আগে থেকে শুরু করে চীনের মিং রাজবংশের দেয়ালে অঙ্কিত ছবিতে খোদাই করে তা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ধারাবাহিক এই ইতিহাস যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, সেই প্রাচীন খেলাই একদিন এ অবস্থায় আসবে যে অ্যাডিডাস তার জন্য বল বানাবে। চীনারাই প্রথম ফুটবল ম্যাচের আসর বসিয়েছিল, যেখানে মাঠের মাঝখানে থাকত নেট। খেলোয়াড়েরা মাটি থেকে হাতের সাহায্য ছাড়া বল পাঠাত নেটের ওপারে। খ্রিষ্টের জন্মের ১৫০০ বছর আগে মেক্সিকো আর মধ্য আমেরিকায় কোনো এক অনুষ্ঠানে রাবারের গোলক সূর্যের প্রতিনিধিত্ব করেছিল। তবে আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে ফুটবল খেলা শুরুর নির্দিষ্ট সময় জানা যায় না। শোনা গেছে, আস্তেক জাতির মধ্যে বিজয়ী দলের খেলোয়াড়দের বিধাতার নামে উৎসর্গ করার নিয়ম ছিল। মাথা কাটার আগে তাদের শরীরে লাল রঙের ডোরা আঁকা হতো। তারা বিশ্বাস করত, বিধাতা পৃথিবীকে আরও উর্বর আর স্বর্গকে আরও মোহনীয় করার জন্য তাদের রক্তকে বেছে নিয়েছে।
ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে শেষ পর্যন্ত ফুটবল এক নতুন রূপ পায়। খেলার আধুনিক সংস্করণে ১৮৬৩ সালে লন্ডনের এক সরাইখানায় বারোটি ক্লাবের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৮৪৮ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত নিয়ম মেনে চলার ব্যাপারে তারা একমত হয়। ক্যামব্রিজ রাগবিকে উপেক্ষা করে ফুটবলকে জনপ্রিয় করে তুলতে চেষ্টা করছিল। তখন অবশ্য খেলোয়াড়ের সংখ্যা, খেলার ধরাবাঁধা সময়, মাঠের আকৃতি বা গোলপোস্টের উচ্চতার ব্যাপারে কোনো নিয়ম হয়নি। তখনকার দিনে মাঠের নির্দিষ্ট স্থানে খেলার জন্য নির্দিষ্ট খেলোয়াড় থাকত না। তারা কেবল বলের পেছনে দৌড়াত, নিজেদের অবস্থান ক্রমাগত বদলে ফেলতে পারত।
১৮৭০ সালে স্কটল্যান্ড দল ডিফেন্স, মিডফিল্ডার্স আর স্ট্রাইকারকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে। তত দিনে এগারোজন খেলোয়াড় নিয়ে খেলা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এমনিতে হাত দিয়ে বল না ছোঁয়ার নিয়ম থাকলেও ১৮৭১ সালে নিয়ম হলো গোলকিপার তার সমস্ত শরীর দিয়েই বল ঠেকাতে পারবে। আগেকার দিনের প্রায় দ্বিগুণ উঁচু আর সরু গোলপোস্ট বদলে আজকের গোলপোস্টের চেহারাটা এসেছিল ১৮৭৫ সালে। ১৮৭২ সালে প্রথম রেফারি নিয়োজিত হলো। তার আগ পর্যন্ত খেলোয়াড়েরা নিজেরাই ছিল তাদের বিচারক। তারপর ১৮৯১ থেকে রেফারি মাঠের ভেতরে খেলোয়াড়দের সঙ্গে দৌড়ানোর সুযোগ পেল। কাছাকাছি সময়ে মাঠকে লাইন দিয়ে নির্দিষ্ট করে মাঝখানে একটি বৃত্ত আঁকার প্রচলন হলো। গোল হয়েছে কি না এই বিতর্কের অবসান ঘটাতে গোলপোস্টে নেট লাগানো হলো একই বছরে। ব্রিটিশ আধিপত্যের একটা শতক চলে গিয়ে ১৯০৪ সালে জন্ম হলো ফিফার।
১৯৩০ সালে, যে বছর ইতালির দক্ষিণ দিক কাঁপানো ভূমিকম্পে ১৫০০ নিয়াপোলিটান নিহত হয়েছে, মারলিন দিয়াত্রিচ ‘ফলিং ইন লাভ অ্যাগেন’ গাইছেন, রাশান বিপ্লবকে স্তালিন অন্যায়ভাবে গ্রাস করেছেন আর কবি ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন, ইংরেজরা মহাত্মা গান্ধীকে কারাগারে পাঠানোর ষড়যন্ত্র করছে, ঠিক তখন প্রথম বিশ্বকাপের আয়োজন হলো। ফ্রান্সের লুইস লরেন্ট মেক্সিকোর বিরুদ্ধে বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম গোলটি করেছিলেন। স্টেডিয়ামে ছুড়ে দেওয়া হ্যাটের সমুদ্র দেখা গেলেও জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা বিশ লাইনের সাধারণ একটা কলামের চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল উরুগুয়ে। খেলার পরে বুয়েনস আয়ারসে একদল লোক উরুগুয়ের কনসুলেটের ওপরে পাথর ছুড়েছিল।