সময়ের রৈখিক বিস্তার

‘অন্ধকারের ভয়’, শিল্পী: নিসার হোসেন
‘অন্ধকারের ভয়’, শিল্পী: নিসার হোসেন

মনের গভীর মন্থনে উঠে আসা শিল্পকর্মে শিল্পের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের কারণেই বিবৃত হয় মানুষের ইতিহাস, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। আর শিল্পী যদি হন স্থানিক সংস্কৃতির অধ্যবসায়ী সাধক, তাহলে তাঁর রচিত শিল্পকর্মে সৃষ্ট হয় অনন্য পাঠ। নিসার হোসেনের সাম্প্রতিক কালের চিত্রকলায় আমরা পাই আমাদের বর্তমানের মুখচ্ছবি এবং ভবিষ্যতের পথরেখা।

‘বিকারগ্রস্ত সময়ের রৈখিক বয়ান’ শীর্ষক তাঁর চলমান চিত্র প্রদর্শনীতে দেখা মেলে শিল্পীর ধ্যানস্থ মনের। এই প্রদর্শনীর ছবিগুলোতে নিসার যেমন ঐতিহ্যের দিকে ধাবিত হয়ে হারানো বাংলার ঐশ্বর্য অন্বেষণ করেছেন, তেমনি সমসাময়িক পৃথিবীও উঠে এসেছে তাঁর ক্যানভাসে।
বিক্ষত-বিধ্বস্ত মানবতার রূপায়ণের মধ্য দিয়েই জেগে ওঠে পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিরুদ্ধে শিল্পীর প্রতিবাদী চেতনা। স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটানো এবং চিত্রপটে তার উপস্থাপন শিল্পী ও সমাজের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় বটে। ঢাকার ইকবাল রোডে অবস্থিত কলাকেন্দ্রে চলমান এই প্রদর্শনী এর সাম্প্রতিক উদাহরণ।
প্রদর্শনীর ছবিগুলোতে রয়েছে রেখার পরিমিত ব্যবহার। তবে একই রেখার ভেতরেই আছে নিঃশব্দ অভিব্যক্তির শক্তিশালী প্রকাশ। বর্তমানের নেতিবাচক সময়কে দারুণ দক্ষতায় ক্যানভাসে হাজির করেছেন শিল্পী।
এই প্রদর্শনীর জন্য চিত্রকর্মগুলো তিনি বিশেষভাবে করেননি; বরং বেশ কিছু বছর ধরে বিভিন্ন শিরোনামে এঁকেছেন ছাপচিত্রগুলো। ‘কোল এইজ’, ‘টুয়ার্ডস হেল’, ‘ফিয়ার অব ডার্কনেস’ প্রভৃতি সিরিজ থেকে বাছাই করা ছাপচিত্রগুলো নিয়েই তৈরি হয়েছে ‘বিকারগ্রস্ত সময়ের রৈখিক বয়ান’।
প্রদর্শনীতে তালপাতায় অঙ্কিত চিত্রমালা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শিল্পমাধ্যম হিসেবে তালপাতা বাংলার ঐতিহ্য ও গুরুত্ব বহন করে। সেই তালপাতাকে মাধ্যম করে বিষয়বস্তু হিসেবে তাতে সমসাময়িক সময়ের উপস্থাপন তৈরি করেছে এক ভিন্ন মাত্রা। ছাত্রাবস্থা থেকেই মাধ্যম হিসেবে কলম ব্যবহারে আগ্রহী ছিলেন নিসার। আর ছাপচিত্রে সূক্ষ্ম নিডেল বা সুচ ব্যবহার করে অভ্যস্ত এই শিল্পী তালপাতাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে প্রকারান্তে যেন এক স্বতন্ত্র চিত্রমালা উপস্থিত করেছেন দর্শকের সামনে। গত বছর ভারতের ওডিশার একটি কর্মশালায় এ কৌশলটিকে আত্তীকরণ করে বেশ কিছু চিত্রকর্ম করেছিলেন নিসার। তার ধারাবাহিকতায় চিত্রপটে সমাজ বাস্তবতার সংবেদনশীল রূপকে প্রচ্ছন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন এই শিল্পকর্মগুলোতে।
বলা বাহুল্য এই শিল্পীর চিত্রপট সমাজ বাস্তবতায় আলোড়িত। প্রতিবাদী চেতনা আর ইন্দ্রিয়ময় শরীরী সৌন্দর্যের পাশাপাশি কল্পরূপাত্মক (ফ্যান্টাসি) অনুষঙ্গ মানবিক এক ভঙ্গির দৃশ্যায়ন করেছে চিত্রতলজুড়ে। মানবিক বোধের শূন্যতা এই সময়ের মেরুদণ্ডকে ক্ষমতার দম্ভে প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত করেছে। পাশাপাশি পারিপার্শ্বিক সম্পর্ক, নৈতিকতা, বুদ্ধিবৃত্তিক সাধনা—সবকিছুর মধ্যে তৈরি করেছে শূন্যতার রহস্য।
করণকৌশল, আঙ্গিক, মাধ্যমকে নতুনভাবে পাঠ করার ছক নির্মাণ করেন নিসার, এই প্রদর্শনীতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। প্রদর্শনীর ছবিগুলো সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘একটি ফর্ম এঁকে তার পাশের অন্য ফর্ম ছবিতে এসেছে চাহিদা অনুযায়ী। এখানে মানব অবয়বের শারীরিক ভঙ্গি, অভিব্যক্তি, হিংস্রতা, রুক্ষতা, অশালীন, নোংরা প্রকৃতি—মোট কথা খুঁজে পাওয়া যায় সবকিছুই। আমার মনে হয়েছে, আমরা এমন একটি সময়ের মধ্য দিয়েই যাচ্ছি। তাই আপনা থেকেই বেরিয়ে আসছে এই ড্রয়িংগুলো। এই ছবিগুলোতে বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় আমি খুব বেশি ভাবিনি। আদিম প্রবৃত্তি, অমার্জিত, অশালীন, অপরিশীলত বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছি।’
প্রদর্শনীটি চলবে ২৫ জুলাই পর্যন্ত।