আহা ফুটবল, বাহা ফুটবল!

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

আমার গোটা শৈশবটাই কার্যত ছিল ফুটবলময়। আজকের ছেলেপেলেরা শুনলে খানিক অবাকই হবে হয়তো, আমাদের বাল্যকালে ক্রিকেটের নামটুকুও অব্দি আমরা শুনিনি। বরং হকির কথা একটু-আধটু শোনা যেত। অপর পক্ষে শৈশব-কৈশোরের দুরন্তপনার আকাশজুড়েই ছিল ফুটবলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজত্ব। আকৃতিতে অত্যন্ত ক্ষুদ্র অজপাড়াগাঁয়েও ভরদুপুরে ঠা-ঠা রোদ্দুরের মধ্যে কিংবা বৃষ্টিভেজা বিকেলে ছেলেরা ফুটবল খেলছে—এমন দৃশ্যের দেখা পাওয়া ছিল অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার। একটু আত্মপ্রচার করি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমি ফুটবলে এতই আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম যে খেলা বলতেই বুঝতাম ফুটবল। অন্য কিছু নয়। শুধু আমাদের গাঁ কেন, আশপাশে ছোট-বড় প্রতিটি গাঁয়েই ফুটবল ছিল নৈমিত্তিক বিনোদনের প্রধান অংশ। প্রতিটি স্কুলেরও নিজস্ব ফুটবল থাকত। আর এক স্কুলের সঙ্গে আরেক স্কুলের ফুটবল ম্যাচ নিয়ে উত্তেজনা তো ছিলই। কখনো কখনো আশপাশের দশগাঁয়ের ফুটবল টিম মিলে টুর্নামেন্ট খেলছে—এমন স্মৃতিও মনের মধ্যে রয়ে গেছে। সেই সঙ্গে ছিল খেলোয়াড় ‘হায়ার’ করার চল। এর অনুষঙ্গ হিসেবে থাকত কোন দল কত দ্রুত কত বেশি দক্ষ খেলোয়াড়কে দলে টানতে পারে, তাই নিয়ে রেষারেষি-মারামারি। এমন খেলায় যতটা না খেলা থাকত, তার থেকে কখনো কখনো বেশি থাকত ফাউলের মহামারি। একবার এক খেলায় রেফারি হিসেবে আমাদের গাঁয়ের পঞ্চাদাকে নামানো হয়েছিল। এক দলের গোলকিপার তাঁকেই দিল এক ল্যাং মেরে। তিনি তৎক্ষণাৎ লাল কার্ড দেখিয়ে গোলকিপারকেই মাঠছাড়া করে ছাড়লেন! মনে আছে, সেই ম্যাচে গোলকিপার-হারানো দল সর্বমোট ১৯টা গোল খেয়েছিল।

আমি কবে থেকে প্রথম ফুটবল খেলতে আরম্ভ করেছিলাম, তা এখন আর স্মরণে আনতে পারি না। তবে প্রথম কী দিয়ে ফুটবল খেলেছিলাম, তা বেশ মনে আছে। একটা আপাত-বড় আকৃতির কাঁচা বেল কারও বাড়ি থেকে চুরি করে আনা শাড়ি জড়িয়ে সেবার বল তৈরি করা হয়েছিল। পরে খেলেছি কাঁচা বাতাবিলেবু দিয়ে। একসময় ক্যাম্বিস কাপড়ের বল বাজারে এলে তা দিয়েও খেলেছি। শৈশব পেরিয়ে যখন কৈশোরে পা দিলাম, তখন বাবার কাছে আবদার ধরলাম এই বলে যে এবার একটা রাবারের ফুটবল কিনে দিতেই হবে। আমার বদমেজাজি বাবা এই একটি ব্যাপারে আমাকে চরম স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। বল কেনার জন্য তাঁর কাছে পয়সা চাইলে দিতে দ্বিধা করতেন না। কিন্তু কেন? কে জানে। যাহোক, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাবারের বলের আকারও বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু তাতেও একসময় আর মন ভরত না। পরে একদিন গাঁয়ের বন্ধুরা মিলে বিশ টাকা চাঁদা তুলে কলকাতা থেকে আসল চামড়ার বল কেনা গেল। কিন্তু দেখা গেল, দেখতে-শুনতে ভারী সুশ্রী ও ওজনদার হলেও সে জিনিস নিয়ে বিরক্তিকর ঝক্কি একটা আছে। তা হলো ওই বল নিয়ে খেলার আগে তার ব্লাডারে পাম্পার দিয়ে বাতাস ঢোকানো। ঠিকমতো কাজটা না হলে বলের সব দিক সমান হবে না, খেলেও স্বস্তি মিলবে না। দু-চারজন মিলেও ঠিক সুবিধা করা যেত না। পরে মুশকিল আসানের জন্য শেষমেশ পাড়ার বড় দাদাদের দ্বারস্থ হতে হতো।

হাইস্কুলে উঠে সত্যিকারের ফুটবল খেলার মজা পেয়েছিলাম বলতে হবে। ছুটির পর স্কুলের মাঠের মাঝে চুন দিয়ে খেলোয়াড়দের জন্য জায়গা নির্দিষ্ট করে নিতাম। বাঁশ দিয়ে বানাতাম গোলপোস্ট। স্কুলের তরফ থেকে আবার ছাত্রদের জন্য একটি পাঁচ নম্বরি চামড়ার বলও কেনা হয়েছিল। খেলতে খেলতে তা বিগড়ে গেলে আরেকটা কেনা হতো। এই স্কুলেই একদিন এক বন্ধুর সঙ্গে ফুটবল খেলতে গিয়ে মহা মুশকিলে পড়েছিলাম। স্কুল ছুটির পর বৃষ্টি পড়ছে, আশপাশে আর কেউ নেই। বন্ধুটি বলল, ‘চল, কেউ তো নেই, এখন মাঠে একটু ফুটবল খেলা যাক।’ আমি তো সানন্দে রাজি হয়ে মাঠে নেমে পড়লাম। খেলতে খেলতে আমরা আর খেয়াল করিনি যে আমাদের শিক্ষক কালীকিঙ্কর পণ্ডিত ওই বৃষ্টির মধ্যেই মাঠ দিয়ে কোথাও হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ আমার এক কিকে সোজা বলটা গিয়ে লাগল তাঁর ভুঁড়িতে!

ছোটখাটো আকৃতি ও নিরীহ প্রকৃতির মানুষ কালীকিঙ্করবাবু মাঠের মধ্যে পড়ে যাওয়ার পর নিজেকে খানিক সামলে চেঁচাতে থাকলেন, ‘বলটা আমার দিকে কে মেরেছিস রে! তাকে আমি আজ নরকদর্শন করাব।’ আমার সেই বন্ধুটি তখন অম্লানবদনে পুরো দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে বলল, কুকর্মটি তারই। বাঁচোয়া এই, কালীকিঙ্করবাবুর মারধর করার অভ্যাস বা ক্ষমতা—দুটির কোনোটিই ছিল না। তাই তিনি বাড়িতে নালিশ দেওয়ার কথা বলে আমাদের ছেড়ে দিয়ে নিজের গন্তব্যে হাঁটা দিলেন। যদিও পরে আমাদের বাড়িতে এসে নালিশ তিনি আর করেননি। পরে এই ঘটনার স্মৃতি মাথায় রেখে ও তাতে খানিক রং চড়িয়ে আমার ‘ফুটবল থেকে সাবধান’ গল্পটা লেখা হয়েছিল।

এভাবে দুরন্তপনার সঙ্গে ফুটবল খেলতে খেলতে এলাকায় আমার এই বলে বেশ সুনাম ছড়িয়ে গিয়েছিল যে আজিজুল ছেলেটা বেশ ভালোই খেলে। কিন্তু এত সুখ আর বেশি দিন সইল না। মাধ্যমিক পরীক্ষার বছরখানেক আগে, একদিন ফুটবল খেলতে গিয়ে পায়ে ভয়ানক এক চোট পেলাম। এরপর থেকে ফুটবল খেলতে গেলেই দেখতাম, পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। একসময় ভাবতাম, কোনো ফুটবল ক্লাবে ডিফেন্ডার হিসেবে খেলব কখনো। সেই আশার গুড়ে হতাশার বালি পড়ল। ফুটবল এখন তাই আমার কাছে যেমন আনন্দের, তেমনি একটু বিষাদের ছোঁয়াও তাতে মিশে থাকে।

ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে নিদারুণ মাতামাতি যথারীতি চলমান। প্রথম বিশ্বকাপ দেখেছি (আবশ্যিকভাবেই টিভির পর্দায়) গত শতাব্দীর আশির দশকে। সেই থেকে চার বছর পরপর ফুটবল নিয়ে গোটা বিশ্ব যেভাবে আলোড়িত হচ্ছে, সেভাবে সেই আলোড়নের আঁচও আমার গায়ে এসে লাগছে ও লাগবে। এতে আমি আনন্দই পাই। রাত জেগে খেলা দেখতেও ক্লান্ত বোধ করি না। এর নেপথ্যে আমার শৈশবের ফুটবল উন্মাদনা কাজ করছে—এমনটা বললে অত্যুক্তি হবে না। আশির দশকে খুব ভালো লাগত ডিয়েগো ম্যারাডোনার খেলা। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড-আর্জেন্টিনা সেমিফাইনালে ওঁর দুটো গোলের কথা আমি কোনো দিন ভুলতে পারব না। মাঝমাঠ থেকে এক দৌড়ে এক দমে প্রতিপক্ষের জালে গোল দেওয়ার দৃশ্যটা এখনো চোখে ভাসে। কোনো খেলোয়াড়ই তাঁকে আটকাতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল, মেক্সিকোর এস্তাদিও আসতেকা স্টেডিয়ামের সেই গর্জায়মান ম্যারাডোনা যেন কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধরত আত্মদীপ্ত অর্জুন। সমগ্র কুরু সেনাদল তাঁকে আটকাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু তিনি অবিচল থেকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে শর ভেদ করেই ছাড়লেন। ম্যারাডোনার আচার-আচরণ যেমনই হোক, তা দেখে তাঁকে ভালোবাসা থেকে বিরত থাকতে পারি না। এমন ‘লার্জার দেন লাইফ’ চরিত্র আধুনিক কালের ফুটবলে আর কজনই বা আছে? এখন ভালো লাগে লিওনেল মেসির শান্ত-সুন্দর-স্নিগ্ধ খেলা। কিন্তু এই বিশ্বকাপে সে যেন খানিক ছন্দহারা-ছন্নছাড়া। রোনালদোর খেলায় চাকচিক্য ও গতি যতটা দেখি, ততটা মমতা দেখি না। আর নেইমারের এখনো অনেকটা পথ হাঁটা বাকি—ব্রাজিল সমর্থকেরা রাগ করবেন হয়তো, কিন্তু তাঁকে কিঞ্চিৎ অস্থির কিসিমের বলেই মনে হয়।

এই লেখা যখন লিখছি, তখন ফুটবল-পাগল বাঙালির সবেধন নীলমণি দুই লাতিন আমেরিকান দল ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা খেলায় হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছে। অতঃপর? ভালোবাসার দলগুলো নেই বলে বাকি খেলাগুলো দেখার মজা নষ্ট করতে আমি রাজি নই। এবারের সেমিফাইনাল খেলাও কম জমেনি। আর এখন ফ্রান্স আর ক্রোয়েশিয়ার মধ্যে জমজমাট ফাইনাল খেলা দেখার অপেক্ষায় গোটা িবশ্ব।

বিশ্বরাজনীতিতে নানান ওলটপালট যেমন এখন ঘটছে, তেমনি বিশ্ব ফুটবলেও কি গহিনে-গোপনে এক পরিবর্তন আসন্ন? লাতিন আমেরিকার দলগুলো এই বিশ্বকাপে তেমন কলকে পেল না, উল্টো ইউরোপেরই জয়জয়কার। আবার ইউরোপীয় দলগুলোও ‘সেরিব্রাল’ খেলার মেজাজ ছেড়ে প্রাণবন্ত-দুরন্ত হয়ে উঠছে—এমন দৃশ্যও তো নজরে আসছে। ফ্রান্সের কিলিয়ান এমবাপ্পে বা বেলজিয়ামের রোমেলু লুকাকুর খেলার দাপুটে ভঙ্গি তো রীতিমতো উপভোগ্য। সে যাহোক, আমি যেমন ইউরোপের ফুটবলে এই নতুন রক্ত সঞ্চারকে স্বাগত জানাই, তেমনি আশা করি লাতিন আমেরিকার পুনরুত্থানের। এ বাদে আপাতত জমজমাট একটা ফাইনাল ম্যাচ দেখার প্রতীক্ষায় থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই।