আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন যে কবি

নেলসন ম্যান্ডেলা। ছবি: রয়টার্স
নেলসন ম্যান্ডেলা। ছবি: রয়টার্স

দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মের ১০০ বছর পূরণ হলো ১৮ জুলাই। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর আত্মজীবনী লং ওয়াক টু ফ্রিডম থেকে নেওয়া হয়েছে এই অংশটুকু। অনুবাদ করেছেন সারফুদ্দিন আহমেদ 

আমি তখন উমতাতা থেকে পৌনে দুই শ মাইল দূরে অবস্থিত ফোর্ট বিউফোর্টের হিল্ডটাউনের ওয়েসলিয়ান কলেজে পড়ি। রাতের আকাশ চিরে যেমন উল্কা ছুটে যায়, তৃতীয় বর্ষে ওঠার পর যেন একটা আকস্মিক ঘটনা আমার জীবনে ঘটে গেল। খবর এল, খোসা সম্প্রদায়ের বিখ্যাত কবি ক্রুনি এমখাওয়ি আমাদের স্কুল পরিদর্শনে আসছেন।

এমখাওয়ি ছিলেন একজন জাত ‘ইমবোঙ্গি’ বা স্বভাব গীতিকবি। তিনি মুখে মুখে সমসাময়িক ও ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকে তাৎক্ষণিকভাবে কাব্যিক ছন্দে বর্ণনা করতেন।

এমখাওয়ি আসবেন বলে সেদিন স্কুলে ছুটি ঘোষণা করা হলো। কবিকে স্বাগত জানাতে সবাই পরিচ্ছন্ন সাদা-কালো পোশাক পরে অ্যাসেম্বলি রুমে হাজির হলাম। মঞ্চ ছিল হলরুমের শেষ মাথায়। মঞ্চের পাশে একটা দরজা। ওই দরজা খুললে আমাদের প্রিন্সিপাল ড. ওয়েলিংটনের বাড়ি দেখা যেত। দরজার তেমন কোনো বিশেষত্ব ছিল না। তবে আমরা ভাবতাম, সেটা কেবল ওয়েলিংটনের জন্য বানানো হয়েছে। কারণ, তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে আমরা ওই দরজা কখনো ব্যবহার করতে দেখিনি। ওয়েলিংটন একজন শ্বেতাঙ্গ। তখন শ্বেতাঙ্গদের আমরা প্রভু বলেই জানতাম।

যাহোক, আমরা যখন হলরুমে বসে আছি, তখন হঠাৎ দরজা খুলে গেল। যথারীতি সবাই ভাবলাম, ড. ওয়েলিংটন মঞ্চে আসছেন। কিন্তু পরে দেখা গেল তিনি নন। আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে গায়ে চিতাবাঘের ছাল দিয়ে বানানো পোশাক আর মাথায় হ্যাট পরে একজন কৃষ্ণাঙ্গ লোক ঢুকলেন। তাঁর হাতে একটা বল্লম। তাঁর পেছন পেছন ঢুকছেন ড. ওয়েলিংটন। একজন উপজাতীয় আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গের পেছনে পেছনে ড. ওয়েলিংটনের মতো একজন শ্বেতাঙ্গ ঢুকছেন—এই দৃশ্য সবাইকে হতবাক করে দিয়েছিল। এটা আমাদের মধ্যে কী ভীষণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল, তা বোঝানো মুশকিল। মনে হচ্ছিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বুঝি উল্টে গেছে। আমাদের আরও অবাক করে কবি এমখাওয়ি বিন্দুমাত্র আনুগত্য না দেখিয়ে একেবারে ড. ওয়েলিংটনের গাঁ ঘেঁষে বসলেন। আমরা তখন রীতিমতো উত্তেজনা বোধ করছি। তখন তাঁকে আমাদের কাছে কোনো মহাপুরুষ বলে মনে হচ্ছিল।

কিন্তু কবি যখন উঠে দাঁড়িয়ে বক্তব্য শুরু করলেন, তখন সত্যি কথা বলতে কি, আমার আশাভঙ্গ হলো। তাঁর কণ্ঠ শুনে হতাশ হলাম। একজন খোসা নায়ক হিসেবে তাঁকে আমি একজন দীর্ঘদেহী, দৃঢ়ভাষী ও বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টিসম্পন্ন লোক বলে মনে করেছিলাম। কিন্তু তাঁকে তখন আর দশটা সাধারণ লোকের মতোই মনে হলো। খোসা ভাষায় তিনি যখন কথা বলতে শুরু করলেন, তখন আরও বিরক্তি বোধ করতে লাগলাম। তাঁর কণ্ঠ একে তো ছিল মৃদু আর মেয়েদের মতো চিকন; তার ওপর তিনি কথা বলছিলেন ধীর লয়ে। জুতসই শব্দটি ব্যবহারের জন্য সময়ক্ষেপণ করে বক্তব্য দিচ্ছিলেন।

মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় কবি মাঝেমধ্যে হাতের বল্লম ওপরের দিকে তুলে ধরছিলেন। মাথার ওপর পর্দা টাঙানোর জন্য যে ধাতব তার ঝোলানো ছিল, বল্লমটা ওই তারে গিয়ে আঘাত করছিল। রাজনৈতিক প্রসঙ্গে কথা বলার সময় তিনি কিছুক্ষণ পরপর তাঁর বল্লমের অগ্রভাগের দিকে চাইছিলেন। তারের সঙ্গে বল্লমের গুঁতো লাগায় বিরক্তিকর ঝনঝন আওয়াজ হচ্ছিল।

নেলসন ম্যান্ডেলাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন যে কবি, ক্রুনি এমখাওয়ি
নেলসন ম্যান্ডেলাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন যে কবি, ক্রুনি এমখাওয়ি



কবি হঠাৎ থামলেন। আবার বলা শুরু করলেন। এবার আমাদের অবাক করে দিয়ে তাঁর গলার আওয়াজ ধীরে ধীরে চড়তে শুরু করল। ভাষণের শব্দশৈলী দৃঢ় ও জোরালো রূপ নিতে শুরু করল। তিনি মঞ্চের এ মাথা থেকে সে মাথা পর্যন্ত পায়চারি করার মতো হাঁটতে হাঁটতে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। তিনি হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন এবং সরাসরি দর্শকের দিকে চেয়ে বললেন, তারেরসঙ্গে আমার বল্লম বাড়ি খেয়ে যে ঝনঝন আওয়াজ হচ্ছে, সেটি ইউরোপীয় সংস্কৃতির সঙ্গে আফ্রিকান সংস্কৃতির সংঘর্ষের প্রতীক।’ তিনি চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘আমার হাতে তোমরা যে বল্লম দেখছ, তা আফ্রিকান ইতিহাসের মহিমান্বিত সত্য ও সুন্দরের প্রতীক। আর এই যে তামার তার দেখছ, এটি পশ্চিমা শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের একটা আলামত। এই পশ্চিমা তার খুব চিকন কিন্তু খুব শক্ত; প্রাণহীন কিন্তু কুটিল চতুর।’

কবি ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। তিনি ঝাঁজালো কণ্ঠে বলতে লাগলেন, ‘আমি একটা লম্বা হাড়ের ওপর লোহা বসানো বল্লমের গুণকীর্তন কিংবা ধাতব তারের সূক্ষ্ম কারচুপির নিন্দা জানানোর জন্য এখানে আসিনি। আমি শুভ আর অশুভ, স্থানীয় আর বিদেশি বেনিয়াদের সংঘাতের কথা বলতে এসেছি। আমি বলতে এসেছি, যাঁরা আমাদের কৃষ্টি ও সভ্যতাকে বিনষ্ট করে তাদের সভ্যতা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়, সেই বিদেশিদের আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। আমি বিশ্বাস করি এবং এই সমবেত জনতার সামনে আজ ভবিষ্যদ্বাণী করে যাচ্ছি, আফ্রিকা একদিন জাগবেই। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসীদের বিরুদ্ধে আফ্রিকা ঘুরে দাঁড়াবে। সাদা চামড়ার নকল দেবতারা আমাদের আর বেশি দিন জুজুর ভয় দেখাতে পারবে না। আমরা আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে জাগব। বিদেশি কু ধারণাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আমরা জাগবই।’

কবির কথা শুনে নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। মঞ্চে বসা ছিলেন খোদ ড. ওয়েলিংটনসহ আরও বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক। তাঁদের সামনে একজন কৃষ্ণাঙ্গ কবি এভাবে কথা বলতে পারেন, তা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। ড. ওয়েলিংটনের মতো যে শ্বেতাঙ্গদের আমি এত দিন প্রভু বলে জেনে এসেছি, কবি এমখাওয়ির কথা শুনে আমার সে ধারণা মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেল।

বক্তব্য শেষ করে এমখাওয়ি তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা সুরে সুরে আবৃত্তি করতে লাগলেন। কবিতাটির বিষয়বস্তু হলো, তিনি আসমানের সব নক্ষত্র পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করে দিয়েছেন। তাঁর বল্লমখানা একবার মঞ্চের এদিকে, একবার ওদিকে তুলে ধরে তিনি ফরাসি, জার্মান, ইংরেজসহ সব ইউরোপীয়ের উদ্দেশে বললেন, ‘সর্বাধিক নক্ষত্রের আধার এই সুবিশাল ছায়াপথ তোমাদের দিলাম। সবচেয়ে বেশি তারা তোমাদের দিলাম। কারণ, তোমরা অদ্ভুত এক লোভাতুর জাতি। তোমাদের এত আছে তবু তোমাদের “চাই! চাই!” শেষ হয় না। তোমরা এত খাও, তবু তোমাদের খাই খাই বন্ধ হয় না।’

এরপর তিনি এশিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে তাঁর কল্পিত নক্ষত্র বণ্টন করলেন। এরপর আফ্রিকার দেশগুলোকে বিভিন্ন স্তরে ভাগ করলেন তিনি। একেকটি আফ্রিকানের দেশের জন্য একেকটি তারা বরাদ্দ করলেন। একেকটি উপজাতিকে উপহার দিলেন একেকটি নক্ষত্র।

আবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে তিনি অদ্ভুত ভঙ্গিমায় নাচতে লাগলেন। হাতের বল্লম এদিক-ওদিক নেড়ে প্রাচীন আদিবাসীদের কায়দায় দাপাতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ আচমকা থমকে গেলেন। শান্ত ও স্থির দর্শকদের দিকে মুখ বাড়ালেন। খুব নিচু স্বরে বললেন, ‘এবার এসো প্রিয় খোসা সমাজ! তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি আমার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ তারা। তোমরা অসমসাহসী এক জাতি। তাই তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি ভোরের শুকতারা। সময় গুনতে, বছর গুনতে, বয়স গুনতে রেখে যাচ্ছি অদম্য এই শুকতারা!’

কবিতার শেষ লাইনটা বলে তিনি বুকের ওপর মাথা ঝোঁকালেন। আমরা হাততালি দিয়ে হর্ষধ্বনি করে উঠে দাঁড়ালাম। একজন খোসা সম্প্রদায়ের আফ্রিকান হিসেবে আমার বুক তখন গর্বে ফুলে উঠছিল।

কবি এমখাওয়ির বক্তব্য আমার অন্তরাত্মাকে যেন জাগিয়ে দিল। আমার মতো তিনি নিজেও একজন খোসা ছিলেন। তবে তাঁর জাতীয়তাবোধ খোসা উপজাতিকে ঘিরে ছিল না। তিনি পুরো আফ্রিকাকে সংহত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর কবিতা শুনেই আমি প্রথমবারের মতো আফ্রিকার সব উপজাতি ও আদিবাসীকে এক ছাতার নিচে আনার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম।