গ্যালারি কায়ার ১৪ বছর

গ্যালারি কায়ার একটি চিত্রপ্রদর্শনীতে তিন বিখ্যাত চিত্রকর: বিজন চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম ও রফিকুন নবী। ছবি: সংগৃহীত
গ্যালারি কায়ার একটি চিত্রপ্রদর্শনীতে তিন বিখ্যাত চিত্রকর: বিজন চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম ও রফিকুন নবী। ছবি: সংগৃহীত

‘উদ্বোধন’ শিরোনামে চিত্রকলার একটি যৌথ প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে গ্যালারি কায়া আত্মপ্রকাশ করে ২০০৪ সালের ২৮ মে। উত্তরায় ৪ নম্বর সেক্টরে ১৬ নম্বর সড়কের ২০ নম্বর বাড়ির একতলায় ছিমছাম গ্যালারি কায়া। ‘কায়া’ মানে দেহ অথবা কাঠামো; বায়বীয় কিছু নয়, ছায়া নয়; বরং এমন কিছু, যার আছে শরীর, আছে উপস্থিতি। নাম থেকেই বোঝা যায়, গ্যালারি কায়া ক্ষণিকের জন্য নয়, দীর্ঘ পথচলার প্রত্যয় নিয়েই জন্মেছিল। ১৪ বছর খুব কম সময় নয়। বাংলাদেশে অনেক আর্ট গ্যালারিই দু-তিন বছরের বেশি টেকেনি।

গ্যালারি কায়ার কর্ণধার চিত্রকর গৌতম চক্রবর্তী। জন্ম ১৯৬৮ সালে; চট্টগ্রাম ও শান্তিনিকেতনে স্কুল; তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদ থেকে ১৯৯২ সালে চিত্রকলায় স্নাতক। স্বভাবে চাকরি করার মানসিকতা নেই, তাই ফ্রিল্যান্স শিল্পী এবং ২০০৪ সাল থেকে গ্যালারি কায়ার পরিচালক। গৌতম নিজস্ব ধারায় ছবি আঁকেন। তাঁর চিত্রকলায় জীবজন্তুর দেহাংশবিশেষ সম্পূর্ণ নতুন রূপ নেয়, যা দর্শকের চোখকে সুন্দর এই পৃথিবীর রহস্যময়তাকে নতুন করে দেখতে শেখায়।

গ্যালারি কায়ার আয়োজনে ওয়েস্টিন হোটেলে মকবুল ফিদা হুসেইনের ‘জার্নি ইন গ্রাফিকস’ শিরোনামের চিত্রপ্রদর্শনী, ২০১৮
গ্যালারি কায়ার আয়োজনে ওয়েস্টিন হোটেলে মকবুল ফিদা হুসেইনের ‘জার্নি ইন গ্রাফিকস’ শিরোনামের চিত্রপ্রদর্শনী, ২০১৮


গ্যালারি কায়া এ পর্যন্ত ৬০টি একক ও ৪১টি যৌথ, মোট ১০১টি চিত্রকলা প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। এ ছাড়া কায়া দেশে ও বিদেশে ৬টি আর্ট ক্যাম্প, ৪টি আর্ট কর্মশালা এবং দেশে ১টি ও বিদেশে ৬টি আর্ট ট্রিপের আয়োজন করেছে। একক প্রদর্শনীগুলোর মধ্যে মুর্তজা বশীরের ৪টি (২০০৭, ২০০৯, ২০১০ ও ২০১৪) ও রণজিৎ দাসের ৩টি (২০১০, ২০১৪ ও ২০১৭) বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মুর্তজা বশীর অত্যন্ত প্রখর, ধী-শক্তিসম্পন্ন ও বৈচিত্র্যময় শিল্পী। ২০১৪ সালের প্রদর্শনীতে ১৯৫৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তাঁর ড্রয়িং, কোলাজ, তৈল-প্যাস্টেল ইত্যাদি দুষ্প্রাপ্য কাজ দেখার সুযোগ হয় দর্শকদের। রনজিৎ দাস একজন সৃজনশীল এবং ক্র্যাফটি শিল্পী। তাঁর কাজ মূলত দ্বিমাত্রিক, ফ্ল্যাট; নাগরিক জীবনযাপনে ভোগবাদ ও নৈরাশ্য জ্যামিতিক বিন্যাসে কখনো আলোতে, কখনো অন্ধকারে তাঁর ক্যানভাসে প্রকাশ পায়। এ ছাড়া একক প্রদর্শনীগুলোতে রয়েছেন রতন মজুমদার (২০০৮), আশরাফুল হাসান (২০১১,২০১২), সৈয়দ আবদুল্লাহ্ খালিদ (২০১১) এবং মকবুল ফিদা হুসেইন (২০১৮)। এম এফ হুসেইনের (১৯১৫-২০১১) কাজের প্রদর্শনী এর আগে ঢাকায় হলেও গ্যালারি কায়ায় তাঁর একক গ্রাফিক আর্ট (শেরিগ্রাফ ও লিথোগ্রাফ) প্রদর্শনী ছিল বড় আয়োজনের। গ্যালারি কায়ায় যৌথ প্রদর্শনীগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: ভারত ও বাংলাদেশের শিল্পীদের কাজ নিয়ে ‘র‍্যাপ্সডি’ (২০০৮) ; ‘ভয়েসেজ নেক্সট’ (২০০৯) এবং ‘বাংলাদেশের আধুনিক ও সমকালীন শিল্পকলা’ (২০১৭)।

দেবদাস চক্রবর্তী
দেবদাস চক্রবর্তী

গৌতম চক্রবর্তীর বাবা ছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী (১৯৩৩-২০০৮), আমাদের দেবুদা। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার সময় (১৯৭০-৮০) শিল্পী রশীদ চৌধুরী ও মুতর্জা বশীরকে নিয়ে যৌথভাবে চারুকলা বিভাগকে বাংলাদেশের সবচেয়ে গতিময় চারুকলা শিক্ষায়তনে রূপান্তর করেছিলেন। ওই সময় চট্টগ্রামে প্রতিভাবান শিক্ষকদের মধ্যে আরও ছিলেন আবুল মনসুর, সৈয়দ আবদুল্লাহ্ খালিদ, মনসুরুল করিম, মিজানুর রহিম প্রমুখ। কিন্তু ১৯৭৯ সালে তাঁর স্ত্রীর অকাল মৃত্যু হওয়ায় দেবুদা অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। প্রথমে শান্তিনগরে (১৯৮০-৮৭) ও পরে গ্রীন রোডের ভূতের গলিতে একতলা একটি বাসা ভাড়া করে থাকেন (১৯৮৭-২০০৩)। সঙ্গে তাঁর দুই ছেলে গৌতম ও রুশো। ভূতের গলিতে থাকাকালে দেবুদার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। তাঁর বাসায় অনেক আড্ডা দিয়েছি। তিনিও আমার বাসায় আড্ডা দিতে বহুবার এসেছেন। আড্ডায় প্রায়ই থাকতেন স্থপতি রবিউল হুসাইন ও ভাস্কর আবদুল্লাহ্‌ খালিদ। দেবুদা ওই সময় একদিন আমাকে তাঁর উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের জমিতে তিন বেডরুমসম্পন্ন একটি চারতলা বাড়ির নকশা তৈরি করে দিতে বলেন। নকশা হলো, রাজউক থেকে পাসও হলো। গৌতম একক চেষ্টায় গ্রীন রোড থেকে উত্তরায় বাসে যাওয়া-আসা করেন। রাত-দিন পরিশ্রম করেন। ব্যাংক থেকে টাকা লোন নিয়ে দোতলা পর্যন্ত বাড়ির নির্মাণকাজ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেন। সেটা ছিল ১৯৯৬ সাল। তখন থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত বাড়ি ভাড়া দিয়ে, ভাড়ার টাকায় লোন পরিশোধ করেন গৌতম। দেবুদাকে কিছুই করতে হয়নি। এরপর গৌতম তাঁর স্ত্রী, এক ছেলে, ভাই ও দেবুদাকে নিয়ে ভূতের গলি থেকে চলে এলেন উত্তরায়। দেবুদা তখন অসুস্থ। এসব কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে দেখেছি গৌতমের সৎ সাহস, অদম্য কর্মোদ্দীপনা, মানসিক পরিচ্ছন্নতা ও অমায়িক ব্যবহার। ২০০৪ সালে ওই বাড়ির একতলায় প্রতিষ্ঠিত হলো গ্যালারি কায়া।

দেবুদার ইচ্ছা ছিল একটি আর্ট গ্যালারি প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৬২-৬৩ সালে ‘আর্ট এনসেম্বল’ নামে শিল্পীদের একটি গোষ্ঠী ছিল। কিছুদিন পর এ গোষ্ঠী সেগুনবাগিচা এলাকায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম আর্ট গ্যালারি হিসেবে ‘আর্ট এনসেম্বল গ্যালারি’ প্রতিষ্ঠা করে। বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ ছিলেন সভাপতি, মুর্তজা বশীর পরিচালক এবং সাধারণ সম্পাদক ফরিদা হাসান। দেবদাস চক্রবর্তী, আমিনুল ইসলাম, সাদেক খান প্রমুখ ছিলেন সদস্য। গ্যালারিটি স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই বন্ধ হয়ে যায়। দেবুদা ১৯৮৩-৮৪ সালে কে বি আহমেদকে নিয়ে ‘চারুকলা ট্রাস্ট’ নামে বেইলি রোডে সিদ্ধেশ্বরী স্কুলের পেছনে একটি আর্ট গ্যালারি চালু করেন। মাত্র বছর দেড়েক টিকে থাকে চারুকলা ট্রাস্ট। এসব জেনেশুনে বাবার স্বপ্নটাকে রূপ দিতেই সম্ভবত গৌতম চক্রবর্তী এই গ্যালারিকে নিয়ে এতটা নিষ্ঠ।

গ্যালারি কায়ার মঙ্গল কামনা করি।