ইশকুল

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

বেশ, আমরা এই বাচ্চাদের সব্বাইকে নিয়ে গাছ লাগাতে গেলাম। দেখুন, আমরা ধরে নিয়েছি এটা তাদের শিক্ষার অংশ, ওদের দেখাতে চাইছি যে জানেনই তো, কী পদ্ধতিতে শেকড়-বাকড় কাজ করে...এবং একটা দায়িত্ববোধেরও ব্যাপার আছে, যত্ন-আত্মি শেখা, ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্বশীল হওয়া। বুঝতেই পারছেন, আমি কী বলতে চাইছি এবং সব গাছ মরে গেল। ওগুলো ছিল কমলালেবুর গাছ। গাছগুলো স্রেফ মরে গেল, জানি না কেন। সম্ভবত মাটিতে কিছু একটা সমস্যা ছিল কিংবা হয়তো নার্সারি থেকে যে চারাগুলো আনা হয়েছিল তা ভালো ছিল না। এ নিয়ে আমরা অভিযোগ করেছিলাম। তখন ওখানে আমাদের তিরিশটি বাচ্চা, প্রত্যেক ছেলেমেয়ে লাগিয়েছিল একটা করে চারাগাছ এবং তিরিশটি গাছকে আমরা মৃত পেলাম। সবগুলো বাচ্চা তাকিয়ে আছে ছোট ছোট বাদামি কাঠির দিকে। ব্যাপারটা খুবই হতাশাজনক।

একে হয়তো ততটা খারাপ বলা যেত না, যদি না গাছগুলোর ক্ষেত্রে যা ঘটল তার মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগে সমস্ত সাপ মারা পড়ত। তবে আমার ধারণা, সাপগুলো, হ্যাঁ, সাপগুলো লোপাট হওয়ার কারণ ছিল, আপনার মনে পড়বে, হরতালের কারণে বয়লার বন্ধ ছিল চার দিন এবং এটা ব্যাখ্যাযোগ্য। হরতাল ছিল বলেই বাচ্চাদের কাছে ঘটনাটাকে আপনি ব্যাখ্যা করতে পারবেন। আমি বলতে চাইছি, কোনো মা-বাবাই যেহেতু বাচ্চাদেরকে পিকেটারদের বেঁধে দেওয়া সীমানা ডিঙাতে দেন না, বাচ্চারা বুঝতে পারে তখন হরতাল চলছে, আর এ-ও বুঝতে পারে যে হরতাল কী জিনিস। কাজেই যখন পুনরায় সবকিছু ঠিকঠাক চলতে শুরু করল, আমরা সাপগুলোর দেখা পেলাম, যেগুলো খুব বেশি সঙ্কটে পড়েনি।

তৃণ-গুল্মের বাগানের বিষয়টা হয়তো বেশি পানি ঢালার মামলা, কিন্তু যা হোক, তখন নিদেনপক্ষে ওরা জেনে তো গেছে যে অতিরিক্ত পানি ঢালা যাবে না। ঔষধি বাগানের ব্যাপারে বাচ্চারা ছিল খুবই কর্তব্যনিষ্ঠ এবং তাদের কেউ কেউ হয়তো...আপনি জানেন, আমরা দেখছি না এই সুযোগে বেশি পানি ঢেলে ফেলেছিল। কিংবা হয়তো...আচ্ছা, আমি অন্তর্ঘাত বিষয়ে ভাবতে চাই না, যদিও এর শিকার আমরা হয়ে থাকি। আসলে আমি বলতে চাইছি, কারণটি ছিল আমাদের ধারণার বাইরে। আমরা এভাবে ভাবছি সম্ভবত এ কারণে যে এর আগে মারা গেল মুষিক, মারা পড়ল সাদা ইঁদুর এবং গিরগিটি...বেশ। ওরা তখন জেনে গেছে, এদের প্লাস্টিক ব্যাগে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যাবে না।

আমরা ‘আশা করেছিলাম’ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মাছগুলো মারা যাবে, এতে বিস্ময়ের কিছু ছিল না। সংখ্যায় তারা এত, আপনি দেখেন, ওগুলো কুঁকড়ে যায় আর পেট-ওপরে হয়ে ভাসতে থাকে। কাজেই এ পর্যায়ে শিক্ষণ পরিকল্পনায় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মাছ যুক্ত হলো, আমাদের কিছুই করতে হলো না, প্রতিবছরই এটা ঘটে, এ প্রসঙ্গ আমরা না হয় চটজলদি ছেড়ে যাই।

কুকুরছানার ব্যাপারটি আমাদের এমনকি কল্পনাতেও ছিল না।

ভাবিনি যে একটাকে আমরা পেয়েও যাব। একদিন মারডকবাসী মেয়েটি ছানাটাকে দেখতে পায় গ্রিসটেডের এক ট্রাকের তলায় এবং তার আশঙ্কা হয় যে ট্রাকচালক মাল খালাসের পর ওটাকে চাপা দিয়ে যাবে, তাই সে ছানাটাকে ঝোলার ভেতর ঢুকিয়ে ফেলে এবং ইশকুলে নিয়ে আসে। এভাবেই আমরা একটা কুকুরছানা পেয়ে যাই। ওটাকে যখন আমি দেখলাম, ভাবলাম হা ঈশ্বর, আমি বাজি ধরতে পারি যে সপ্তাহ দুয়েকের মতো ওটা বাঁচবে এবং তারপর...। আর ঘটল সেটাই। একটা কুকুরছানাকে ক্লাসে রাখতে পারার কথা ছিল না, এ ব্যাপারে কিছু বিধিনিষেধ আছে, কিন্তু আপনি ওদেরকে বলতে পারেন না যে তারা কোনো কুকুর রাখতে পারবে না, যখন ইতিমধ্যে একটা কুকুর সেখানে আছে, একেবারেই তাদের সামনে, মেঝের ওপর দৌড়াদৌড়ি করছে আর কুঁই কুঁই করছে। তারা ওটার নাম দেয় এডগার—অর্থাৎ নামটা তারা দিয়েছে আমার নামে। ওটার পেছনে তারা দৌড়াদৌড়ি করে বিস্তর মজা করছে আর চেঁচাচ্ছে, ‘এখানে এডগার! বাহ বাহ এডগার!’ তারপর তারা হেসে নরক গুলজার করছে। নামের দ্ব্যর্থকতাকে তারা খুব উপভোগ করছিল। আমিও উপভোগ করছিলাম। বাচ্চামিতে আমি কিছু মনে করি না। ভাঁড়ার ঘরে কুকুরছানার জন্য ওরা একটা ঘর বানালো এবং এতটুকুই। আমি জানি না কিসের কারণে ছানাটা মরল। হতে পারে, ডিসটেম্পার। তাকে সম্ভবত কোনো ইনজেকশনও দেওয়া হয়নি। বাচ্চারা ইশকুলে আসার আগেই আমি ওটাকে বের করে আনলাম ওখান থেকে। প্রত্যেক ভোরবেলা ভাঁড়ার ঘরটা আমি পরখ করতাম, নিয়মিতভাবে, কারণ আমি জানতাম কী ঘটতে যাচ্ছে। আমি ওটাকে তত্ত্বাবধায়কের কাছে দিলাম।

এবং তারপর ছিল এক কোরীয় অনাথ শিশু, ক্লাসের বাচ্চারা যাকে দত্তক নেয় হেল্প দ্য চিলড্রেনের মাধ্যমে, সবাই এক মাস করে তাকে বাসায় নিয়ে রাখবে—এ রকম ছিল পরিকল্পনা। এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক, শিশুটির নাম ছিল কিম এবং হয়তো তাকে দত্তক নিতে আমরা দেরি করে ফেলেছিলাম কিংবা অন্য কিছু। আমরা যে চিঠি পেয়েছিলাম তাতে মৃত্যুর কারণ লেখা ছিল না, তারা অন্য কোনো শিশুকে দত্তক নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল এবং কৌতূহলোদ্দীপক কিছু কেস-হিস্ট্রি তারা আমাদেরকে পাঠিয়েছিল, কিন্তু ওসবে আমাদের মন ছিল না। ক্লাসের বাচ্চারা একে মারাত্মক একটা ব্যাপার হিসেবে নিল। তারা ভাবতে শুরু করল, হয়তো ইশকুলের খারাপ কিছু একটা হয়েছে (কেউ সরাসরি আমাকে বলেছে মনে হয় না)। কিন্তু আমার ধারণা ইশকুলের কিছু হয়েছে এটা ঠিক না, বিশেষত, আমি ভালো কিছু ঘটতে দেখেছি, আবার খারাপ কিছুও দেখেছি। এখন শুধু একটা দুর্ভাগ্য চলছে। যেমন বেশিসংখ্যক বাবা-মা গত হলেন। আমার মনে হয়, দুটো হার্ট অ্যাটাক এবং দুটো আত্মহত্যা, সলিলসমাধি একটা এবং গাড়ি দুর্ঘটনায় একসঙ্গে চারজন। একটি স্ট্রোক। পিতামহ-পিতামহীদের মৃত্যুর হারটাও অস্বাভাবিকভাবে বেশি, কিংবা হয়তো এ বছরটাতেই শুধু বেশি, এমনটাই মনে হয় এবং অবশেষে এই ট্র্যাজেডি।

ট্র্যাজেডিটা ঘটল ম্যাথিউ ওইন আর টনি মাভরোগর্দের খেলার সময়। তারা খেলছিল লোকেরা যেখানে নতুন ফেডারেল অফিস ভবনের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি করছিল। সমস্ত বড় বড় কড়িকাঠ জড়ো করে রাখা ছিল খুঁড়ে রাখা সেই গর্তের পাশে, আপনি জানেন। ও থেকেই মামলা-মোকদ্দমার ব্যাপার এল, মা-বাবারা দাবি করলেন, কড়িকাঠগুলো রাখা ছিল খুব অপরিকল্পিতভাবে। কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা আমি জানি না। এ ছিল এক অদ্ভুত বছর।

আমি ভুলে গেছি বিলি ব্রান্ডের বাবার কথা বলতে, তিনি তাঁর ঘরে মুখোশ পরা এক অনুপ্রবেশকারীর সঙ্গে কুস্তি লড়তে গিয়ে মারাত্মকভাবে ছুরিকাহত হয়েছিলেন।

একদিন ক্লাসে আলোচনা চলছে। ওরা আমাকে জিগ্যেস করল, কোথায় গেছে তারা? গাছগুলো, গিরগিটি, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মাছ, এডগার, আব্বু আর আম্মুরা, ম্যাথিউ আর টনি, কোথায় গেছে তারা? আমি বললাম, আমি জানি না, আমি জানি না। ওরা বলল, কে জানে? আমি বললাম, কেউ জানে না। ওরা বলল, মৃত্যু কি এমন কিছু যা জীবনকে অর্থপূর্ণ করে? আমি বললাম, না, জীবনই অর্থপূর্ণ করে জীবনকে। তারপর ওরা বলল, কিন্তু মৃত্যু, যাকে মৌলিক একটা তথ্য হিসেবে গণ্য করা হয়, তা কি এমন কিছু নয় প্রতিদিনের স্বীকৃত সংসার যার মাধ্যমে হয়তো ছাড়িয়ে যায় সেইদিকে.... ।

আমি বললাম, হ্যাঁ, হয়তো।

ওরা বলল, আমাদের এটা ভালো লাগে না।

আমি বললাম, সেটা যৌক্তিক।

ওরা বলল, এটা ভয়ানক লজ্জার।

আমি বললাম, তা ঠিক।

ওরা বলল, আমরা চাইছি হেলেনের (আমাদের শিক্ষা সহকারী) সঙ্গে তুমি যৌন সংসর্গ করো, যাতে আমরা বুঝতে পারি কীভাবে এটা করা হয়। আমরা জানি হেলেনকে তুমি পছন্দ করো।

আমি হেলেনকে পছন্দ করি কিন্তু এটা আমি করব না, আমি বললাম।

এ সম্পর্কে আমরা অনেক কিছুই শুনেছি কিন্তু কখনো এটা করতে দেখিনি, ওরা বলল।

আমি বললাম, আমাকে বরখাস্ত করা হবে এবং ব্যবহারিক প্রতিপাদনের বিষয় হিসেবে এটা কখনোই, প্রায় কখনোই দেখানো হয়নি। হেলেন জানালার বাইরে তাকাল।

ওরা বলল, প্লিজ, প্লিজ, হেলেনের সঙ্গে ওটা করো, মূল্যের স্বীকৃতি দরকার আমাদের, আমরা আতঙ্কিত।

আমি বললাম, তাদের আতঙ্কিত হওয়া উচিত না (যদিও আমি মাঝে মাঝে আতঙ্কিত হই) এবং মূল্য সবখানে আছে। হেলেন এল এবং আমাকে আলিঙ্গন করল। আমি তার ভ্রুর ওপর কয়েকবার চুমু খেলাম। আমরা জড়িয়ে ধরলাম পরস্পরকে। বাচ্চারা খুব উতলা হয়ে উঠল। তারপর দরজায় ঠক ঠক শোনা গেল। আমি দরজা খুললাম এবং নতুন একটা মুষিক ঢুকল ভেতরে। বাচ্চারা উন্মত্ত হয়ে উল্লাস করতে থাকল। 

ডোনাল্ড বার্থেল্‌ম
আমেরিকান কথাসাহিত্যিক ডোনাল্ড বার্থেল্‌মের জন্ম ১৯৩১ সালে, মারা যান ১৯৮৯ সালে। তিনি হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশোনা করেন। হিউস্টন পোস্ট-এ প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করতেন। ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ছিলেন লোকেশন ম্যাগাজিনের। হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রোগ্রামের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তাঁর গল্পের বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিরে আসুন, ড. ক্যালিগরি (১৯৬৪), শহুরে জীবন (১৯৭০), বিষাদ (১৯৭২), ষাটটি গল্প (১৯৮১), স্যামের মদের দোকান (১৯৮৭) ইত্যাদি। উপন্যাস: বরফসাদা (১৯৬৭), মৃত পিতা (১৯৭৫), স্বর্গ (১৯৮৬), রাজা (১৯৯০) ইত্যাদি।

অনুবাদ: রায়হান রাইন