আলমগীর কবিরের চলচ্চিত্র ও জাতীয় মুক্তি-ভাবনা

আলমগীর কবির পরিচালিত সীমানা পেরিয়ে ছবিতে জয়শ্রী কবির ও বুলবুল আহমেদ
আলমগীর কবির পরিচালিত সীমানা পেরিয়ে ছবিতে জয়শ্রী কবির ও বুলবুল আহমেদ

চলচ্চিত্র ও জাতীয় মুক্তি: আলমগীর কবির রচনা সংগ্রহ-১

আলমগীর কবির

সম্পাদক: আবুল খায়ের মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান ও প্রিয়ম প্রীতিম পাল

প্রচ্ছদ:
শিবু কুমার শীল, প্রকাশক: আগামী প্রকাশনী ও মধুপোক, ঢাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ৩৫৩ পৃষ্ঠা
দাম: ৯০০ টাকা। 

ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩), সূর্যকন্যা (১৯৭৬), রূপালী সৈকতে (১৯৭৯), সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭) চলচ্চিত্রের পরিচালক আলমগীর কবির চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে আমাদের কাছে বেশি পরিচিত। কিন্তু এর আগে তিনি লন্ডনের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পত্রিকা সাইট অ্যান্ড সাউন্ড-এর নিয়মিত চিত্রসমালোচক ছিলেন, অংশ নিতেন কান-বার্লিন-ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে, চিত্রসমালোচক হিসেবে। তিনি মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধ বলতেই যেমন ফ্রন্টে লড়াই করা সশস্ত্র সৈনিক বোঝায়, ঠিক তেমনভাবে নয়, তাঁর যুদ্ধক্ষেত্রের পরিধি ছিল তার চেয়ে ব্যাপক। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় হওয়ার আগে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন আলজেরিয়ার মুক্তিযুদ্ধে, সদস্য হয়েছিলেন আলজেরিয়ার মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এফএলএনের। তিনি প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতায় সাহায্য করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এসব কিছু করছিলেন লন্ডনে তাঁর প্রবাসজীবনে। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯৬৩ সালে গঠন করেন এক গোপন সংগঠন—নাম: ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট। সংগঠনের প্রচারপত্র হিসেবে বের করা শুরু করেন এশিয়ান টাইড পূর্ব বাংলা নামে দুই ভাষার দুই পত্রিকা। তখনো ছয় দফা প্রবর্তিত হয়নি, খুব কম মানুষই তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু আলমগীর কবিররা ষাটের দশকের শুরুতেই সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন, হালকা অস্ত্র চালাতে শেখেন, নাশকতামূলক কাজের জন্য ট্রেনিং নেন। প্রকৌশলী হিসেবে একটি বহুজাতিক কোম্পানির লোভনীয় চাকরি ছেড়ে তিনি ১৯৬৬ সালে লন্ডন থেকে দেশে ফিরে আসেন দেশকে স্বাধীন করার জন্য, যদিও তখন পর্যন্ত এ দেশে স্বাধীনতার কথা খুব কম লোকেরই মাথায় এসেছে। পাকিস্তান সরকার ১৯৬৬ সালেই তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায়। আর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ইংরেজি বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। জহির রায়হানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নির্মাণ করেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কয়েকটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র।

একদিকে চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব, অন্যদিকে মুক্তিসংগ্রামী—এই দুই বড় পরিচয় যাঁর, তাঁর বাংলা ভাষার লেখা পত্রকে এক জায়গায় করে, তাঁর মৃত্যুর বহু বছর পর ২০১৮ সালে যদি কিছু উদ্যমী তরুণের সুসম্পাদনায় ৩৫৩ পৃষ্ঠার কোনো বই বের হয় এবং সেই বইয়ের শিরোনাম যদি হয় চলচ্চিত্র ও জাতীয় মুক্তি, তবে একবাক্যে বলা যায়, শিরোনাম যথার্থ হয়েছে। একটি সম্পাদনা পরিষদের সাহায্য নিয়ে গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন আবুল খায়ের মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান ও প্রিয়ম প্রীতিম পাল। আর প্রকাশ করেছে আগামী প্রকাশনী ও মধুপোক যৌথভাবে। এটিকে তারা বর্ণনা করছেন ‘আলমগীর কবির রচনা সংগ্রহ ১’ হিসেবে। তারুণ্যে শক্তিমান এই সম্পাদনা পরিষদের হাত দিয়েই প্রকাশিত হবে আরও কয়েকটি খণ্ড। তাঁরা সম্পাদকীয়তে বলছেন, আলমগীর কবির দুই দশকজুড়ে দুই হাতে প্রচুর লিখেছেন। তাঁদের অনুমান, বহুদিনের অনুসন্ধানের পর মাত্র সিকিভাগ রচনাই তাঁদের হাতে এসেছে। বলার বিষয় এটা হতে পারে যে এই রচনাবলি সিরিজ প্রকাশের উদ্যোগ কোনো জাতীয় প্রতিষ্ঠান নেয়নি, আলমগীর কবিরের বন্ধুবান্ধব কিংবা চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের শিষ্যরা গ্রহণ করেননি, তরুণ এক গোষ্ঠীই এই জাতীয় দায়িত্ব হাতে তুলে নিয়েছে।



চলচ্চিত্র ও জাতীয় মুক্তি—এই দুই ক্ষেত্রেই আলমগীর কবিরের অবদান অপরিসীম। ফলে এই বইয়ে বাংলাদেশকে আশ্রয় করে আলমগীর কবিরের চলচ্চিত্রভাবনা ও জাতীয় মুক্তি-ভাবনার সন্ধান মিলবে। আবার তিনি এই দুইয়ে বসবাস করতে গিয়ে দুইকে আলাদা করে রাখেননি, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তির ভাবনাকে প্রকাশ করেছেন (ধীরে বহে মেঘনারূপালী সৈকতে স্মর্তব্য), আবার ক্যামেরাকে রাইফেল বানিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন (জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড [১৯৭১] নির্মাণে সহযাত্রী হয়েছেন, নিজে নির্মাণ করেছেন লিবারেশন ফাইটার্স [১৯৭১])। বৃহৎ কলেবরের গ্রন্থটি সম্পাদকমণ্ডলী প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন ‘প্রবন্ধ ও নিবন্ধ’, ‘বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকার’ ও ‘সংবর্ধনা’। আলমগীর কবিরকে সার্বিকভাবে মূল্যায়ন করে সলিমুল্লাহ খানের দীর্ঘ প্রবন্ধকে সম্পাদকমণ্ডলী ‘ভূমিকা’ আকারে যুক্ত করেছেন, যা আলমগীর কবিরকে ভালোমতো বুঝতে পাঠকের জন্য প্রশিক্ষণমূলক হবে।

উৎসাহী পাঠকের জন্য বিচিত্র উপাদান রয়েছে এই বইয়ে। কিন্তু পাঠক হিসেবে আমার কাছে যে কয়েকটি বিষয় আগ্রহোদ্দীপক হয়ে উঠেছে, তার মধ্যে একটি হলো আলমগীর কবিরের বয়ানে বামপন্থীরা কীভাবে জাতীয়তাবাদীদের নেতৃত্বাধীন একটি যুদ্ধে যুক্ত হতে জাতীয়তবাদীদের সঙ্গে মোকাবিলা বা দর-কষাকষি করেছেন, সেই দিকটি। আগেই বলা হয়েছে, তিনি লন্ডনে থাকতেই গেরিলাযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন এবং তাঁদের ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্টের মূল ভাবনা ছিল: ‘স্বাধীনতা আসবে অতর্কিত আঘাত আরম্ভ করে দীর্ঘায়িত গেরিলাযুদ্ধের মাধ্যমে’ (পৃ. ৯)। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তিনি সামান্য সম্বল নিয়ে ভারতে যান এবং তিনি বা জহির রায়হানের মতো সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের মানুষেরা জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদী নেতাদের অনীহার মধ্য থেকেও নিজ মেধা ও যোগ্যতায় সমাজতন্ত্রীদের জন্য যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের পরিসর তৈরিতে সচেষ্ট থাকেন। আর আলমগীর কবিরের রচনাবলিতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো জহির রায়হানকে খুঁজে পাওয়া। জহির রায়হান ছিলেন তাঁর গুরু, কমরেড-বন্ধু, পরম শ্রদ্ধার পাত্র। ঘুরেফিরে জহিরের প্রসঙ্গ এসেছে এই বইয়ে, সেই সূত্রে কিছু অজানা কাহিনিও।

কিছু মসলদার বিষয়ও এই গ্রন্থে রয়েছে। স্বাধীনতা-পূর্বকালে কড়া ভাষায় স্থানীয় চলচ্চিত্রের সমালোচনা করতে গিয়ে অনেককেই খেপিয়ে তুলেছিলেন আলমগীর কবির। ফলে স্বাধীনতার পর চলচ্চিত্র নির্মাণে তিনি নিয়মিত হলে, তাঁর ওপরও আক্রমণ এসেছে, যার জবাবও তিনি দিয়েছেন লিখে। এভাবে তিনি এহতেশাম, খান আতাউর রহমান, আমজাদ হোসেন প্রমুখের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়েছেন। আর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে বিভিন্ন সময়ে লিখিত একাধিক প্রবন্ধ এই গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে, যাতে পুনরাবৃত্তির সমস্যা রয়েছে, কিন্তু প্রতিটিতেই চিন্তাশীল পাঠক ও গবেষকদের জন্য নানান খোরাক রয়েছে।

আগেই বলেছি, গ্রন্থটি সুসম্পাদিত। সম্পাদকেরা কেবল একটি সংগতিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য সম্পাদনারীতিই অনুসরণ করেননি, গ্রন্থটি আন্তর্জাতিক মানের করে তুলতে আলমগীর কবিরের চলচ্চিত্রপঞ্জি, গ্রন্থপঞ্জি, স্বীকৃতিমালা, জীবনপঞ্জি, তথ্যসূত্র, নির্দেশিকা বা ইনডেক্স—সবকিছুই পরিশিষ্টে যুক্ত করেছেন। বাংলাদেশে এ রকম পরিশ্রমসাধ্য ও সুসম্পাদিত গ্রন্থ সত্যিই বিরল।