রোকেয়ার আন্তরিক জীবনী

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন
মালেকা বেগম
কাইয়ুম চৌধুরীর পরিকল্পনায় প্রচ্ছদ:
অশোক কর্মকার, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের পূর্ণাঙ্গ ছবি: মাসুক হেলাল
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: মে ২০১৮, ৬৪ পৃষ্ঠা
দাম: ১৫০ টাকা।

প্রথমা প্রকাশনের ‘কীর্তিমান বাঙালি’ সিরিজের সদ্য প্রকাশিত বই রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। লেখক বিশিষ্ট নারীনেত্রী ও শিক্ষাবিদ মালেকা বেগম। বইটি কলেবরে ক্ষুদ্র হলেও এই মহীয়সী নারীর জীবনের এমন কোনো দিক নেই, যা এখানে উঠে আসেনি; বরং এটি পড়তে গিয়ে আমরা জানতে পারি মালেকা বেগম সংযোজিত এমন কিছু তথ্য, যেগুলো এত দিন অজানা ছিল আমাদের কাছে।

আমরা জানি, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন মেয়েদের সাক্ষর ও শিক্ষিত করার জন্য কেবল স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং তা পরিচালনার মধ্যেই নিজের কর্মজীবন সীমিত রাখেননি। তিনি ছিলেন পশ্চাৎপদ মুসলমান বাঙালি নারীসমাজের কাছে আলোকবর্তিকাস্বরূপ। তাঁর কালে বিদ্যমান সামাজিক-সাংস্কৃতিক কূপমণ্ডূকতা, কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার মূলোৎপাটনেও ভূমিকা ছিল তাঁর। এসব কিছুর বিরুদ্ধে তিনি যেমন বলিষ্ঠ লেখনী ধারণ করেছিলেন, তেমনি গ্রহণ করেছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন উদ্যোগ। সেকালের বাস্তবতায় তাঁর ভূমিকা অভিযাত্রীর মতো। এই অভিযাত্রী মহীয়সী নারীর আদ্যন্ত জীবনী রচনা করে মালেকা বেগম আদতেই গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন।

রোকেয়ার জীবনীটি মোট ৬ অধ্যায়ে বিভক্ত করেছেন লেখক। প্রথম অধ্যায়েই রোকেয়া-চরিত্রের দৃঢ়তাকে তুলে ধরতে গিয়ে তাঁর বক্তব্য থেকে এমন একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরেছেন তিনি, যার পাঠ মনকে আলোকিত না করে পারে না; যেখানে তিনি সহকর্মী সমাজকর্মীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘যদি সমাজের কাজ করিতে চাও, তবে গায়ের চামড়াকে এতখানি পুরু করিয়া লইতে হইবে যেন নিন্দা, গ্লানি, উপেক্ষা-অপমান কিছুতেই তাহাকে আঘাত করিতে না পারে; মাথার খুলিকে এমন মজবুত করিয়া লইতে হইবে যেন ঝড়-ঝঞ্ঝা, বজ্র-বিদ্যুৎ সকলই তাহাতে প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসে।’ কথাগুলো রোকেয়া বলেছেন নিজের জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত তিক্ত অভিজ্ঞতার জারকে সিক্ত হওয়ার পর। ফলে দেখতে পাই, তাঁর সহযাত্রী যাঁরা হচ্ছেন, তাঁরা নিজেদের প্রস্তুত করেই পথে নামছেন, নারী জাগরণের কঠিন পথের পথিক হচ্ছেন নিজেদের গায়ের চামড়াকে পুরু করেই।

প্রথম অধ্যায়ে লেখক আরও তুলে ধরেছেন রোকেয়া কীভাবে তাঁর সমকালে প্রচলিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক, এমনকি রাজনৈতিক বাধা অতিক্রম করে নিজের লক্ষ্যে অগ্রসর হয়েছেন, সেই বৃত্তান্তও। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তিনি পাননি বটে, কিন্তু দুজন আত্মীয়ের সহযোগিতায় কী নিষ্ঠাবান শিক্ষাব্রতী, স্বশিক্ষিত মানুষই না হয়ে উঠেছিলেন! এ বইয়ে আছে তার প্রায় অনুপুঙ্খ বিবরণ। শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যে নিয়মিত ইংরেজি, উর্দু ও বাংলা ভাষায় যেসব বই ও রচনাবলি পড়েছেন রোকেয়া, এখানে পাওয়া যাবে তারও বিবরণ।

বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল, কলকাতা। ছবি: সংগৃহীত
বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল, কলকাতা। ছবি: সংগৃহীত



‘অবরোধ থেকে আলোয়’ শীর্ষক দ্বিতীয় অধ্যায়ে আছে রোকেয়ার বিয়ে, বিবাহোত্তর জীবন, স্বামী খান বাহাদুর সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সান্নিধ্যে তাঁর নতুন জীবন লাভ, দুটি সন্তান এবং স্বামীরও অকাল প্রয়াণ। বিশেষ করে, স্বামীর অকাল মৃত্যুর পর তাঁর নতুন জীবন ও সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু হয়। নিজেকে গড়ে তুলতে থাকেন তিনি। সফলও হন। কোনো বাধাই তাঁকে তাঁর অঙ্গীকৃত পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।

‘রোকেয়ার সাহিত্যকৃতি’ শীর্ষক অধ্যায়ে রোকেয়া-সৃষ্ট সাহিত্যের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন মালেকা বেগম। তাঁর সাহিত্যকর্মের মূল বৈশিষ্ট্য যে সমাজসংস্কার, আদর্শ জীবন গড়ে তোলা, সর্বোপরি সমাজের পশ্চাৎপদ নারী সমাজের যথার্থ মুক্তি—এ অধ্যায়ে নানা বিবরণের মাধ্যমে সেটি তুলে ধরা হয়েছে।

‘এক মোমবাতি থেকে হাজার মোমবাতি’, ‘নারী মুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ’ ও ‘স্বদেশ চেতনা’—পরবর্তী এই তিন অধ্যায়ে তুলে ধরা হয়েছে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা, সেই স্কুলটিকে নানা পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক জটিলতার কারণে কলকাতায় নিয়ে আসা প্রভৃতি। কিন্তু এসব ক্ষেত্রেও কম সংগ্রাম তাঁকে করতে হয়নি। পরিশেষে রোকেয়ার যথার্থ মূল্যায়ন করে মালেকা বেগমের অভিমত, ‘মৃত্যুর পরও রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের স্বপ্ন ও সংগ্রাম অব্যাহত থাকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত স্কুলের ছাত্রী, শিক্ষয়িত্রী ও আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম সংগঠনের সদস্যা-সংগঠকদের কর্মতৎপরতার মাধ্যমে।’

কে একমত হবেন না লেখকের এই বক্তব্যের সঙ্গে?