প্রকাশ্যের অপ্রকাশ্য জীবনের কাহিনিগদ্যকার

রমাপদ চৌধুরী (২৮ ডিসেম্বর ১৯২২-২৯ জুলাই ২০১৮)। ছবি: সংগৃহীত
রমাপদ চৌধুরী (২৮ ডিসেম্বর ১৯২২-২৯ জুলাই ২০১৮)। ছবি: সংগৃহীত

চল্লিশের দশকের কথাসাহিত্যিকদের ভেতরে রমাপদ চৌধুরী সবচেয়ে দীর্ঘজীবী। কিন্তু তিনি আমাদের বিস্মিত করেন সম্পূর্ণ অন্য কারণে। সদ্য প্রয়াত এই সাহিত্যিক ২০০৫ সাল থেকে আর কোনো সৃষ্টিশীল রচনায় হাত দেননি। বলতেন, অনেক লিখেছি, আর কত? কলম ধুয়ে রেখেছি। অথচ একসময়ে নতুন উপন্যাস লেখার আগে কিনতেন নতুন একটি ফাউন্টেন পেন। শেষ উপন্যাস পশ্চাদপট-এও তিনি বিষয়ে নতুন। প্রকাশক-সম্পাদক কি পাঠক, তাঁর লেখায় আগ্রহী। বয়স তখন বিরাশি। শরীর সতেজ। চাইলে লিখতে পারতেন। কিন্তু তাঁর ওই নিঃশব্দ ঘোষণাতেই তিনি বহাল থাকেন। রমাপদ চৌধুরী বাংলা কথাসাহিত্যের সেই বিরল লেখকদের একজন, যিনি লেখার শুরুকে জানার মতো জানতেন থামাটাও। তাঁর একটি উপন্যাসের নাম কিন্তু অভিমুন্য, যে বুহ্যে প্রবেশের কৌশল জানে, জানে না বেরিয়ে আসতে। এই অজানা বন্ধুর পথের পরিব্রাজক প্রায় সব বাঙালি লেখক, কেউই ফেরেন না; তিনি এর বিপরীত।

রমাপদ চৌধুরীর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের রেলশহর খড়্গপুরে, যেখানে ভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষের সঙ্গে বেড়ে ওঠার সুযোগ হয়েছে। তাঁর চাকরজীবী বাবা পাঠক হিসেবে ছিলেন সর্বগ্রাসী। সে গুণটা আবাল্য পেয়েছেন তিনিও। কিন্তু লেখক হবেন এমন কোনো ব্রত কখনো ছিল না। লেখালেখির শুরু চল্লিশের একেবারে শুরুতে, বন্ধুদের অনুরোধে। তখন প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। এই সময় থেকেই লিখেছেন পূর্বাশা, চতুরঙ্গ, দেশআনন্দবাজার পত্রিকায়। প্রথম গল্প ‘ট্র্যাজেডি’। প্রথম প্রকাশিত বই ও গল্পগ্রন্থ, দরবারী। বছর ঘুরতে সে বইয়ের সংস্করণ হয়ছিল। প্রথম উপন্যাস প্রথম প্রহর। উপন্যাস লিখেছেন ৫০টি। বেশির ভাগ আয়তনে ছোট। নিজে যেমন ছিলেন স্বল্পবাক, উপন্যাসেও সে রীতি মানতেন। কাহিনিগদ্য নিয়ে স্বতন্ত্র ভাবনা, লেখার কৌশল নিয়ে খুঁতখুঁতানি ছিল। বলেছেন, ‘প্রথম জীবনে তো ভাষা, আঙ্গিক ইত্যাদি নিয়ে কত কারিকুরি করেছি, পরে একেবারে সহজ-সরল। সহজ হওয়া যে কত কঠিন, জানি।’ ছিঁড়েছেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। এমনকি আস্ত উপন্যাসও ফেলে দিয়েছেন ঝুড়িতে। একটি দীর্ঘ আত্মজীবনী লেখার ইচ্ছে প্রকাশ করলেও তা লেখেননি। ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় অন্তত ৩০ বছর আগে লেখা আত্মজৈবনিক স্মৃতিকথা হারানো খাতা। সেই লেখা উদ্ধার করা হয় বাতিল কাগজপত্রের গাদাগুচ্ছ থেকে। ছাপার যোগ্য মনে হয়নি, তাই ফেলে রেখেছিলেন। সেখানে খড়্গপুরে কাটানো তাঁর শৈশব-কৈশোর আর কলকাতার জীবনের প্রথম দিকের টুকরো টুকরো ছবি পাওয়া যায়। খড়্গপুর রেলস্টেশনে রবীন্দ্রনাথকে দেখার স্মৃতি:

আমরা হেঁটে চলেছি প্ল্যাটফর্মের ওপর দিয়ে, সারি সারি বন্ধ জানালা, হঠাৎ সেই ভোরে, পরপর পাশাপাশি দুটি জানালা খোলা। [...] একটি সুপুষ্ট নগ্ন নির্জন হাত। পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে উঠে এসেছে বলেই স্বর্ণবর্ণ হাতটিই প্রথম চোখে পড়েছিল।

একেবারে সামনাসামনি হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক আকর্ষণ বোধ করলাম; কিংবা বলা ভালো, চুম্বকের মতো আমাকে আকর্ষণ করলেন তিনি।

দু-মুহূর্ত অভিভূতের মতো তাকিয়ে থেকে আবার হাঁটতে শুরু করেছি, হঠাৎ থেমে পড়লাম। আরে, ইনি তো রবীন্দ্রনাথ! চিনতে পারার সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীরে পুলকিত হয়ে উঠল। [...] আমি সাহেবপাড়া থেকে প্রতিদিনের মতো বিলিতি চাঁপা ফুল কুড়িয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরছি। [...] মোহগ্রস্তের মতো এগিয়ে গিয়ে খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লাম, ফুলগুলি নামাতে নামাতে গেলাম তাঁর পায়ের কাছে। তিনি দুহাতে তুলে নিলেন। আর সেই বিলিতি চাঁপাগুলি তুলে নিয়ে বললেন, মুচকুন্দ? কোথায় পেলে?

নাম জানতাম না ফুলটার, নামটা জানিয়ে দিলেন তিনি। একটা ফুল চিনিয়ে দিলেন।

[...] সেই মুহূর্তেই বুঝে গেলাম, এ আমার জীবনে পরম প্রাপ্তি। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছু হতে পারে না।

এই ফেলে রাখা স্মৃতিকথা খড়্গপুরের শহরের তিন কি চার স্তরের শ্রেণিকাঠামো বুঝতে খুব সহায়তা করে। এমনকি রমাপদ চৌধুরীর প্রথমিক বিকাশেও তা একধরনের সহায়কও হয়েছে। বিখ্যাত ছোটগল্প ‘ভারতবর্ষ’ লিখেছেন এরই কাছাকাছি পটভূমিতে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক-শক্তির এমন তীব্র সমালোচনা বাংলা ভাষায় খুব কম গল্পেই ধরা পড়েছে। একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জনপদের মানুষ পরজীবী হতে হতে কীভাবে ভিখিরিতে পরিণত হয়, সেই কাহিনি। সেই ছোট্ট ভূগোলই আসলে গোটা উপমহাদেশ!

ঔপন্যাসিক রমাপদ চৌধুরী একটু যেন এসবের বিপরীত। অন্তত খারিজ-এর পর থেকে, ‘প্রথম জীবনে বৈচিত্র্যের প্রতি মোহ ছিল, একই বিষয় নিয়ে দুবার লিখিনি। কিন্তু খারিজ-এর পর থেকে তিরিশ বছর ধরে একই বিষয়ের মধ্যে বৈচিত্র্য খুঁজে পেয়েছি। মধ্যবিত্ত জীবনের আত্মসমালোচনা, তা পাঠকের কাছে অস্বস্তিকর লেগেছে, কখনো মনে হয়েছে নির্মম। কিন্তু যা বলার তা না বলে পারিনি। কাহিনির বাইরেও তো এসব উপন্যাসে আমার কিছু বলার কথাও থাকে।’

রমাপদ চৌধুরীর উপন্যাস রচনার দ্বিতীয় পর্বের ক্ষেত্রে এ কথা মেনে নেওয়া যায়। কেননা, প্রথম পর্বে ‘কাহিনির বাইরে ভিতরের তল’ বিষয়টা তেমন ছিল না। প্রথম প্রহর, লালবাঈ, বনপালশির পদাবলী কিংবা দ্বীপের নাম টিয়ারং তাঁর বিস্তার দ্বিতীয় পর্ব থেকে আলাদা। ইতিহাসের পটভূমিতে রচিত লালাবাঈতে কাহিনির বাইরে সেই অন্তর্জগতের খোঁজ দেওয়া যায় না। আবার গ্রামজীবনের অভিজ্ঞতা তাঁর একদমই ছিল না। তাই বনপলাশির কিংবা দ্বীপের নাম টিয়ারং লেখা হয়েছে আধা-দেখাকে নিজস্ব কল্পনার মিশেল দিয়ে।

খারিজ-এর পরে তিনি আঙ্গিকে ভিন্ন। নামকরণেও বীজ, বাহিরি, ছাদ, পাওয়া, অহঙ্কার, জৈব, স্বার্থ। লিখেছেন পনেরো-কুড়ি দিনের মধ্যে। যদিও তিনি মনে করতেন, ‘আসলে সব উপন্যাসই হয়তো আমরা সারা জীবন ধরে লিখি।’ এ সময় উপন্যাসের আয়তন ছোট হয়ে আসে। পটভূমিও ছোট আর স্থির। কলকাতা শহরের পাড়া-মহল্লাও খুব আলাদা করা যায় না। ওদিকে চরিত্রেরা একেবারে নিকটজন। প্রতিদিনের দেখা মানুষ। তারা মধ্যবিত্ত জীবনের প্রতিমুহূর্তের সংকটে জাড়ানো। সেখানে শঠতা, অজ্ঞতা ক্রূরতা, গ্লানি, বিদ্বেষ ও ক্ষয়ের ভেতরেও যে মহত্ত্ব ও বন্ধুতা লেপে আছে, তা চিহ্নিত করেছেন খুব সহজভাবে। এতটাই সহজ যে যেন কাহিনিটাই পড়ছি। কিন্তু তলে তলে মানবিক সংকট খুব ধরা পড়ে। সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পাওয়া তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস বাড়ি বদলে যায়-এর একটা জায়গা:

ও চলে যাওয়ার পরে ধ্রুব আর অবিনাশ দুজনেরই অনুশোচনা হলো। এভাবে সুনন্দকে আঘাত দেওয়া ঠিক নয়। অথচ আঘাত তো দিল। কিন্তু কেন? ঈর্ষা? সুনন্দর একটা বাড়ি আছে বলে কি ওদের মনে কোনো ঈর্ষা আছে? [...] সুনন্দর সঙ্গে এত দিনের বন্ধুত্ব, পাশাপাশি টেবিলে বসে কাজ করে, একজনের বিপদে আরেকজন এসে দাঁড়িয়েছে কত দিন, অথচ তাকেই ওরা ভাবল বিপরীত দিকের মানুষ। কী আশ্চর্য, একজন অজ্ঞাতকুলশীল, কেমন ধরনের লোক কে জানে, ধ্রুব তাকে কোনো দিন দেখেওনি, চেনে না, জানে না, সেই লোকটাই ওদের সমবেদনা পেল। মনে হলো আপনজন, আত্মীয়! শুধু সেও একজন ভাড়াটে বলেই?

কাহিনির ভেতরে থাকা এই দ্বিতীয় স্তরের কথা নিজেই বলেছেন তিনি। একটি স্তরে থাকে শুধুই কাহিনি। আর দ্বিতীয় স্তরে থাকে সেই ব্যঞ্জনা, যা জীবনের গভীরতম তল চেনায়। তাঁর পাঠক নন, এমন কেউ মৃণাল সেনের নির্মিত খারিজ কিংবা একদিন অচনাক অথবা তপন সিংহ এক ডক্টর কি মওত দেখলে ওই প্রচলিত মূল্যবোধের আপাত অন্ধকার দিকটা খুঁচিয়ে দেখানোয় তাঁর যে সফলতা, সেটা বুঝতে পারবেন। কাহিনিগদ্যকার হিসেবে সেই প্রকাশ্য কিন্তু একই সঙ্গে অপ্রকাশ্য জীবন চিনিয়ে দিতে পারাই রমাপদ চৌধুরীর প্রধান কৃতিত্ব। বাংলা কথাসাহিত্যে সরাসরি লক্ষ্যে পৌঁছানো গদ্য তিনি ব্যবহার করছেন অনায়াস কুশলতায়, সেটা রমাপদ চৌধুরীর বড় সফলতা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বেড়ে ওঠা চল্লিশের লেখকেরা শেষ পর্যন্ত যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে ধ্বস্ত স্বদেশকেই খুঁজে ফিরেছেন সারাটা জীবন, সেখানে শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, বিমল কর আর সমরেশ বসুর সমোচ্চারিত নাম রমাপদ চৌধুরী।

আনন্দবাজার পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক রমাপদ চৌধুরী দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছেন ‘বরিবাসরী’য় পাতা। এ ছাড়া এ সময়ে বের করেছেন ইদানীংরমাপদ চৌধুরীর পত্রিকা নামে দুটো পত্রিকা। সেখানেও তাঁর কৃতিত্ব পরের প্রজন্মের লেখকেরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।