ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্র-রচনা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৫ বৈশাখ ১২৬৮—২২ শ্রাবণ ১৩৪৮), প্রতিকৃতি: সব্যসাচী মিস্ত্রী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৫ বৈশাখ ১২৬৮—২২ শ্রাবণ ১৩৪৮), প্রতিকৃতি: সব্যসাচী মিস্ত্রী

১৯২৬ সালে, মোটের ওপর একবারই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ১৯৩৬ সালে ডি লিট উপাধি প্রদান করলেও সেবার তিনি আসেননি। রবীন্দ্রনাথ ১৯২৬-এর ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল নর্থব্রুক হলে সংবর্ধনা গ্রহণ দিয়ে ঢাকা কর্মসূচি শুরু করলেও ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলের (এখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হল) কর্মসূচি দিয়েই মূলত তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক কর্মসূচির সূচনা। এরপর ১৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে তিনি ময়মনসিংহের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। মূলত ১০ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি দুপুর—সাড়ে চার দিন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়মণ্ডলীর কেন্দ্রীয় অতিথি ছিলেন। অবশ্য এর মধ্যে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় প্রায় দেড় দিন কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারেননি তিনি। যে কারণে কর্মসূচিতে থাকার পরও জগন্নাথ হলে সশরীরে আসা হয়নি রবীন্দ্রনাথের। এত অল্প সময়ে অবস্থান করলেও রবীন্দ্রহৃদয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিশেষ স্থান ছিল। এই আবেগের জায়গা থেকেই রবীন্দ্রনাথ হয়তো বেশ কিছু লেখা লিখেছেন এবং তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টদের পাঠিয়েছিলেন। সবাই জানেন, রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচির অংশ হিসেবে ‘Meaning of Art’ ও ‘The Rule of the Giant’ শিরোনামের দুটো ইংরেজি প্রবন্ধ পাঠ করেছেন এবং জগন্নাথ হলের বার্ষিকী বাসন্তিকার জন্য তাঁর ‘এই কথাটি মনে রেখো’ (পরে গান হিসেবে যা জনপ্রিয় হয়) কবিতাটি লিখে দেন। কিন্তু আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক আরও রবীন্দ্রলেখার সন্ধান পেয়েছি। এগুলো বিবেচনা করলে বলতেই হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্লিষ্ট মানুষগুলোর সঙ্গে রবীন্দ্রসংযোগ ছিল অতি ঘনিষ্ঠ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলের ছাত্রদের দেওয়া সংবর্ধনার উত্তরে রবীন্দ্রনাথ একটি চমৎকার ভাষণ দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রবক্তব্য হিসেবে সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। এই হলের ছাত্র সংসদ থেকে রবীন্দ্রনাথকে ‘আজীবন সদস্য’পদ প্রদান করা হয়। ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের মুসলিম হল বার্ষিকীর ১০ম বর্ষ-সংখ্যা দেখার সুযোগ আমি পেয়েছি। রবীন্দ্রনাথ মুসলিম হল বার্ষিকীর ইংরেজি সংখ্যার জন্য একটি ইংরেজি কবিতা পাঠিয়েছিলেন। ইংরেজি সংখ্যা প্রকাশ না পাওয়ায় অনিয়মিত বাংলা বার্ষিকীতেই পরে রবীন্দ্রনাথের সেই ইংরেজি কবিতাটি মুদ্রিত হয়। তবে মজার ব্যাপার হলো, এই ইংরেজি কবিতার শিরোনাম কিন্তু বাংলায়—‘উদ্বোধন’। বার্ষিকীর সম্পাদক একটি টীকা সংযোজন করে লিখেছেন: ‘এই ইংরাজী কবিতাটি কবিগুরু আমাদের বার্ষিকীর জন্য পাঠাইয়াছেন। তাঁহার এই আশীর্বাদ-লিপি পাইয়া আমরা ধন্য ও কৃতার্থ হইয়াছি। বার্ষিকীর ইংরাজী সংখ্যা এবার প্রকাশিত না হওয়ায় আমরা বার্ষিকীর বাংলা সংখ্যাতেই উহা প্রকাশিত করিলাম, এবং তৎসহ একটি বাংলা অনুবাদও পত্রস্থ করিলাম।’ রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটি কে অনুবাদ করেছেন, তাঁর নাম কোথাও নেই। তবে অনুমান করা যায়, অনুবাদটি মোহিতলাল মজুমদার করেছিলেন। কারণ, এ সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে অতীব সক্রিয় ছিলেন। নিচে রবীন্দ্রনাথের লেখা ইংরেজি কবিতাটির খানিক অংশ বার্ষিকী থেকে তুলে ধরা হলো:
Fear not, for thou
shalt conquer,
thy doors will open,
thy bonds break.
Often thou losest
thyself in sleep,
and yet must find
back thy world
again and again.
মুসলিম হল বার্ষিকী ৭ম সংখ্যায় (১৩৩৯) রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা প্রকাশ পায়, ‘আহ্বান’ নামে। হল সংসদের সাহিত্য সম্পাদক রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছিল। তারই প্রত্যুত্তরে কবি কবিতাটি পাঠান—এ কথা উল্লেখ করা ছিল বার্ষিকীতে। লেখা ছিল: ‘আমাদের Union-এর Honorary Life Member কবি সম্রাট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর Literary Secretary-এর পত্রের উত্তরে এই কবিতাটি মুসলিম হল ম্যাগাজিনে ছাপানোর জন্য পাঠাইয়াছেন।’ ‘আহ্বান’-এর তখন পঙ্‌ক্তিবিন্যাস এখনকার মতো ছিল না। এর প্রথম স্তবকটি এমন:
ধ্বনিল আহ্বান মধুর গম্ভীর
প্রভাত-অম্বর-মাঝে।
দিকে দিগন্তরে ভুবন-মন্দিরে
শান্তি সঙ্গীত বাজে।
কবিতাটি পরে পঙ্‌ক্তি পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে মাত্র আট পঙ্‌ক্তিতে সাজিয়ে গীতবিতান-এ পূজা পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ঢাকায় এসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় জগন্নাথ হলের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ অংশ না নিতে পারলেও তিনি ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ৩ ফাল্গুন অর্থাৎ ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৬ হল-বার্ষিকী বাসন্তিকার জন্য এই নামেই যে কবিতা লেখেন, তার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তবে এটি যথাসময় বাসন্তিকায় বের হয়নি। মূল পাণ্ডুলিপির সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, কবিতাটি পরে পঙ্‌ক্তির পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে নয়, পঙ্‌ক্তিতে নামিয়ে এনে এবং ‘আমি ত গান গেয়েছিলেম’-এর ‘ত’-এর স্থলে ‘যে’ যোজনা করে গীতবিতান-এর প্রেম পর্যায়ে স্থান দেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাসন্তিকার কেউ কেউ কখনো পত্র যোগাযোগ করেছেন; রবীন্দ্রনাথ এর উত্তরও দিয়েছেন, সে প্রমাণ মিলেছে। এমন একটি পত্রের সন্ধান পাওয়া যায় বাসন্তিকার পঞ্চদশ বর্ষে। ১৩৪৪ বঙ্গাব্দে বাসন্তিকা পঞ্চদশ বর্ষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশ পায়। এর সম্পাদক ছিলেন অরুণকিশোর চক্রবর্তী এবং সহসম্পাদক ছিলেন অক্ষয়কুমার সেনশর্মা ও গৌরপ্রিয় দাশগুপ্ত। শেষোক্তজন রবীন্দ্রনাথকে মানবজীবন কীভাবে সার্থক করা যেতে পারে মর্মে পত্র পাঠিয়েছিলেন বলে মনে হয়। এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের ‘উত্তরায়ণ’ থেকে লিখেছেন:
ওঁ
Uttarayan
Santiniketan, Bengal.
কল্যাণীয়েষু, 
মানবজন্ম কী করে সার্থক করা যেতে পারে এ প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। প্রত্যেক মানুষের প্রকৃতিতে স্বতন্ত্রভাবে তার জীবনযাত্রার মূলধন দেওয়া আছে। সেইটিকে অর্থাৎ তার আপন বিশেষ শক্তিকে ঠিকমতো খাটাতে পারলেই তার সার্থকতা। সাধারণভাবে যে কিছু হিতোপদেশ দেওয়া যায় সে কোনো কাজে লাগে না। নিজেকে একান্তভাবে প্রশ্ন করে নিজের প্রয়োজন বুঝে নেওয়া ছাড়া অন্য উপায় নেই।—আমার আশীর্ব্বাদ জানবে। 

ইতি
শুভাকাঙ্ক্ষী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিঠিতে কোনো তারিখ বা দিনাঙ্ক ছিল না। ‘মুসলিম হল’ ও ‘জগন্নাথ হলে’র সঙ্গে যে হলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালেই স্থাপিত হয় সেটি হলো ‘ঢাকা হল’ (এখন নামবদলে ‘ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হল’)। এই হলে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব ধর্মের ছাত্ররা বাস করত। ‘ঢাকা হল’-এ রবীন্দ্রনাথের কোনো লিখিত কর্মসূচি পাওয়া যায়নি। ‘ঢাকা হলে’র বার্ষিকীর নাম ছিল শতদল। ১৩৩০ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে Lotus নামে প্রথমে পত্রিকাটি প্রকাশ হয়। এটি ছিল ইংরেজি ও বাংলা দ্বিভাষিক। পরের বছরই এর নাম হয় শতদল। শতদল পত্রিকা প্রতিষ্ঠার পর পনেরো বছরের ইতিহাস-সংবলিত একটি লেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ও কৃতী অধ্যাপক আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর একটি প্রবন্ধে উদ্ধৃত করেছেন। তা থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথের ঢাকায় আগমনের ‘সমুদয় ঘটনা’ শতদল-এ লিপিবদ্ধ ছিল। সেখান থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ শতদল-এর জন্য ‘প্রার্থনার আবশ্যকতা’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখে পাঠান, যা বার্ষিকীর সপ্তম সংখ্যায় প্রকাশ হয়। আশুতোষ ভট্টাচার্যের লেখায় রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতি আছে। সেখান থেকে রবীন্দ্ররচনা খানিকটা তুলে ধরা হলো:
যে মানুষ চায় না, তাকে কেউ কিছু দিতে পারে না, দিলে দান বিফল হয়। চাওয়া এবং দেওয়া একটা চক্র, পরস্পরের যোগে পরস্পর সম্পূর্ণ। তুমি তোমার ছাত্রের কল্যাণার্থী, একান্ত মনে চাও যে তার শিক্ষা সার্থক হয়। কিন্তু তোমার ইচ্ছার পথ বন্ধ, সে যদি না চায়। আমাদের দেশে গুরুভক্তির অর্থই তাই, গুরুও নিজের জন্য ভক্তির প্রয়োজন নেই, কিন্তু তাঁর দানক্রিয়ার জন্যে তার প্রয়োজন আছে—ভক্তি দ্বারা গুরুর কাছে ছাত্র আপন দাবীকে সত্য করে—তখন গুরুর কল্যাণ-ইচ্ছার বাধা দূর হয়। পাওয়ার জন্যই পাওয়ার বাধার মূল্য আছে। বাধা দূর করতে গিয়ে পাওয়ার শক্তি সচেষ্ট হয়ে ওঠে।
শতদল প্রতিবছরই প্রকাশ হতো। আমরা দেখার সুযোগ পেয়েছি, ১৩৪৬ বার্ষিক সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের ‘উদ্বোধন’ নামে একটি কবিতা তাঁর নামের স্বাক্ষর ব্লক করে মুদ্রিত। কবিতাটি থেকে প্রথম চার পঙ্‌ক্তি উল্লেখ করা হলো:
গুরু তারকার প্রথম প্রদীপ হাতে
অরুণ আভাস-জড়ানো ভোরের রাতে
আমি এসেছিনু তোমারে জাগাব বলে
তরুণ আলোর কোলে,—
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনার পেছনে যিনি সর্বাধিক তৎপর ছিলেন তিনি ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক, পরে উপাচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদার। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, রমেশচন্দ্রের শিশুকন্যা শান্তি ওরফে সুষমার আবদারের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ তখন একটি অণু-কবিতা লিখে দেন। সেটি এই:
আয়রে বসন্ত হেথা, কুসুমের সুষমা জাগারে
শান্তিস্নিগ্ধ মুকুলের হৃদয়ের নিস্তব্ধ আগারে।
ফলেরে আনিবে ডেকে
সেই লিপি যাস্ রেখে,
সুবর্ণ তুলিকাখানি পর্ণে পর্ণে যতনে লাগারে।
রমেশচন্দ্রের লেখা থেকেই জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোর জন্য কৃতজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ রমেশচন্দ্র মজুমদারের স্ত্রীকে টেলিগ্রাম করেন এই ভাষায়:
মিসেস রমেশ মজুমদার
ঢাকা, রমনা
মেনি থ্যাঙ্কস ফর হসপিটালিটি
এন্ড ফাইন্ডনেস।
—রবীন্দ্রনাথ টেগোর

লক্ষ করার ব্যাপার, মুসলিম হল বার্ষিকীর জন্য লিখিত রবীন্দ্রকবিতার শিরোনাম ‘উদ্বোধন’, আবার শতদল-এ প্রকাশিত কবিতার নামও একই। কিন্তু কবিতা এক নয়। বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলীর ‘রবীন্দ্র-রচনাসূচী’র তালিকা অনুসারে দেখা যায় ‘উদ্বোধন’ বানানে তাঁর কোনো লেখা নেই, আছে ‘উদ্বোধন’ নামে। তা-ও আবার চারটি। লেখা চারটি যথাক্রমে শান্তিনিকেতন, নটরাজ, নবজাতক ও ক্ষণিকা গ্রন্থে আছে। শতদল-এ মুদ্রিত কোনো লেখাই ‘রবীন্দ্র-রচনাসূচী’তে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। রমেশচন্দ্রের কন্যাকে লেখা অণু-কবিতাও যথাস্থানে অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন। এই কবিতা, গান, প্রবন্ধ, বক্তৃতা, চিঠি নিশ্চয়ই, সবই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। কিন্তু এ সৃষ্টিগুলোর পেছনে আছে আমাদের প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।