ডিমে তা দিল হর্টন

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেইজি নামের ভীষণ অলস পাখিটি। বনের মধ্যে একটা গাছ। তার ওপরে নিজের বাসায় বসে ডিমে তা দিচ্ছিল সে। তা দিতে দিতে বিড়বিড় করে বলল, ‘খুব ক্লান্ত লাগছে। দিনের পর দিন ডিমের ওপর বসে থেকে পায়েও ঝিঁঝি ধরে গেছে। এটা কোনো কাজ হলো! বিরক্তিকর। একটুও ভালো লাগে না। বিরক্তিকর কাজটা না থাকলে একটু খেলতে পারতাম। আয়েশ করে ছুটি কাটাতে পারতাম। ইশ্‌! কাউকে যদি দায়িত্বটা বুঝিয়ে দিতে পারতাম! কেউ যদি ডিমটাতে তা দিত! কাউকে যদি পাওয়া যেত, তাহলে মুক্তি পেতাম...ইশ্‌!’

ঠিক সে সময় এক হাতি যাচ্ছিল গাছটার পাশ দিয়ে। নাম তার হর্টন। তাকে দেখে মুখে তেলতেলে হাসি ফুটিয়ে পাখিটি বলল, ‘এই শুনছ! তোমার তো দেখছি কোনো কাজ নেই। আমি খুবই ক্লান্ত। একটু বিশ্রাম না নিলেই নয়। তুমি কি আমার ডিমে একটু তা দিতে পারবে।’

এমন প্রস্তাবে হো হো করে হেসে হাতিটি বলল, ‘কী যে আজব কথা বলো না! আমার গায়ে তো পালক নেই, পাখাও নেই কোনো। আর আমি কিনা তোমার ডিমে তা দেব? তোমার ডিম তো পুঁচকে, আর আমি কত্ত বড়!’

মেইজি বলল, ‘জানি, তুমি ছোট নও। কিন্তু আমি নিশ্চিত তুমি পারবে। কোনো সমস্যা হবে না। ডিমের ওপর চুপটি করে বসে থাকলেই চলবে। তুমি তো খুবই ভালো আর ভদ্র। এসো না। না বোলো না।’

‘পারব না’, হর্টন বলল।

‘প্লি...জ!’, নাছোড়বান্দার মতো অনুনয় করল পাখিটি। ‘বিশ্রাম নিতে আমার বেশিক্ষণ লাগবে না। কথা দিচ্ছি, শিগগিরই ফিরে আসব। আমি কখনো কথা দিয়ে কথা রাখিনি, এমন হয়েছে? বলো?’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। এত করে যখন বলছ।’ বলল হাতিটি। ‘তুমি ছুটি চাচ্ছো। যাও উড়ে উড়ে ঘুরে এসো। তোমার ডিমে তা দেব। চেষ্টা করব যাতে সেটা না ভাঙে। কথা দিচ্ছি, বিশ্বস্ত থাকব।’

‘ওয়াও! কী মজা!’ গান গাইতে গাইতে পাখা ঝাপটাতে লাগল মেইজি। তারপর দে ছুট।

‘হুম, প্রথমেই...’, বিড়বিড় করল হর্টন, ‘প্রথমেই গাছের ডালটার নিচে শক্ত খুঁটি দিতে হবে, যাতে দেহের ভারে ডালটা ভেঙে না যায়। আমার ওজন নির্ঘাত এক টন।’

কিছুক্ষণের মধ্যে গাছের নিচে দুটো খুঁটি বসিয়ে দিল হর্টন। তারপর খুব সাবধানে গাছের ডালে ছোট্ট ডিমটার কাছে উঠে হেসে বলল, ‘যাক, সব ঠিকমতো হয়েছে...’

এরপর পাখির ছোট্ট ডিমটার ওপর সে বসে দিন কাটাতে লাগল। ডিমটা গরম রাখতে সেখানেই হাতিটি সারা দিন, সারা রাত থাকত। এমনকি বৃষ্টি, বজ্রপাত কিংবা প্রচণ্ড ঝড়েও সেখান থেকে নড়ত না। এভাবে বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লেগে গেল তার। মন খারাপ করে আপন মনে বলল, ‘কাজটা একটুও মজার নয়। আশা করি, মেইজি শিগগিরই ফিরে আসবে। মেইজি নিশ্চয়ই ফেরার কথা ভুলে যায়নি।’

ঠিক সে সময় সেই বন থেকে অনেক অনেক দূরে আরাম করছিল মেইজি। পাম বিচের এক সাগরসৈকতে আয়েশে সূর্যস্নান করতে করতে সে ভাবছিল, আর কখনোই বাসায় ফিরবে না।

তাই ডিমে তা দিতে হলো হর্টনকেই। দেখতে দেখতে বর্ষা শেষে শরৎ এল। তারপর এল হাড়কাঁপানো শীত। তুষার পড়তেও দেরি হলো না। হর্টনের পিঠ, শুঁড় আর হাত-পায়ে তুষার জমাট বেঁধে গেল। তীব্র ঠান্ডায় অসুস্থ হলো সে। কিন্তু ডিম থেকে এক চুলও নড়ল না। হাঁচি দিতে দিতে বলল, ‘আমি ডিমের ওপরই থাকব, কিছুতেই ঠান্ডায় জমে যেতে দেব না। কথা যখন দিয়েছি, কথা রাখব। হাতিরা এক শ ভাগ বিশ্বস্ত।’

পুরো শীতকাল হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে সেখানেই বসে রইল বেচারা হর্টন। তারপর এল বসন্ত। কিন্তু সঙ্গে নিয়ে এল আরেক বিপদ। শীত শেষে হর্টনের বন্ধুবান্ধবরা ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে তার চারদিকে ভিড় জমাতে লাগল। তার অবস্থা দেখে হাসিতে ফেটে পড়ল তারা। চিত্কার করে বলল, ‘দেখ! দেখ! হর্টন গাছে উঠেছে!’ চেঁচিয়ে পুরো বন মাথায় তুলে বলতে লাগল, ‘কী অদ্ভুত! হর্টনের ধারণা সে একটা পাখি!’

অবশ্য তারা একসময় সেখান থেকে দৌড়ে অন্যদিকে চলে গেল। আবারও একা হয়ে গেল হর্টন। বন্ধুদের সঙ্গে তার খেলতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু ডিম থেকে সে উঠল না। বিড়বিড় করে বলল, ‘কথা যখন দিয়েছি, কথা রাখব। যাই ঘটুক না কেন, ডিমটার যত্ন নেব আমি।’

কিন্তু হর্টন জানতও না ভীষণ এক বিপদ এগিয়ে আসছে তার দিকে। সে যখন ডিমে তা দিচ্ছিল, ঠিক তখন তিন শিকারি বন্দুক বাগিয়ে পায়ে-পায়ে তার দিকে এগিয়ে এল।

হর্টন শিকারিদের পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল। ঘাড় ঘোরাতেই দেখল, তিনটি রাইফেল তার দিকেই তাক করা। ঠিক তার হৃৎপিণ্ড বরাবর।

সে কি ভয়ে দৌড়ে পালাবে? না, কক্ষনো না। হর্টন পাখির বাসাতেই চুপটি করে বসে রইল মাথা উঁচু করে। বুক প্রসারিত করে শিকারিদের দিকে তাকাল সে। যেন বলতে চাইল, ‘যত ইচ্ছে গুলি করো, কিন্তু আমি পালাচ্ছি না। কথা যখন দিয়েছি, কথা রাখব। হাতিরা এক শ ভাগ বিশ্বস্ত।’

কিন্তু মানুষগুলো তাকে গুলি করল না। হর্টন অবাক হলো। শিকারিরা তাদের রাইফেল নামিয়ে তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। অবাক হয়ে বলল, ‘দেখ কাণ্ড! এমন ঘটনাও ঘটে? হাতি কিনা গাছে উঠেছে...’

‘আরে অদ্ভুত! মজার! চমত্কার! নতুন! ওকে গুলি কোরো না। ওকে জ্যান্ত ধরে নিয়ে যাব। কী মজার কাণ্ড! ওকে সার্কাসে বিক্রি করে অনেক টাকা পাওয়া যাবে!’ এসব বলতে লাগল মানুষগুলো।

বনের গাছ কেটে কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ওয়াগন বানাল শিকারিরা। তারপর আস্ত গাছটা তুলে ওয়াগনে রাখল। ওয়াগনের সামনে দড়ি বেঁধে সামনে টেনে নিতে লাগল তারা। ভীষণ কষ্টে হর্টন প্রায় কেঁদেই ফেলল।

মনমরা হর্টনকে নিয়ে জঙ্গল থেকে অনেক দূরে যেতে লাগল শিকারিরা। আকাশের সমান উঁচু পাহাড় ডিঙিয়ে হাতি, ডিম, পাখির বাসা আর গাছটাকে সাগরের দিকে নিতে লাগল তারা।

একে একে সবকিছু একটা জাহাজে তোলা হলো। এবার ওয়াগন থেকে বাইরে রাখা হলো হর্টনকে আর গাছটাকে। বিশাল মহাসাগরে ঢেউয়ে দুলতে দুলতে এগিয়ে যেতে লাগল জাহাজটা। হর্টন আপন মনেই বলতে লাগল, ‘কথা যখন দিয়েছি, কথা রাখব। হাতিরা কথার নড়চড় করে না। কিন্তু সমুদ্র আমার ভালো লাগে না।’

প্রায় দুসপ্তাহ সাগরের বুকে ভাসতে ভাসতে অবশেষে তারা নিউইয়র্ক শহরে পৌঁছাল।

‘কূলে পৌঁছে গেছি।’ চিত্কার করে উঠল মানুষেরা।

ডিমের ওপর স্থির হয়ে বসে থাকা হর্টনকে একটা খাঁচায় বেঁধে কূলে নামানো হলো। তারপর তাকে এক সার্কাস দলের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হলো।

দিনের পর দিন সার্কাসে হর্টনকে প্রদর্শন করা হলো। শত শত মানুষ এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখতে ভিড় জমাতে লাগল। গাছের ওপর একটা হাতি বসে আছে দেখতে পেয়ে হাসিতে ফেটে পড়তে লাগল লোকজন। কিন্তু বেচারা হর্টন দিনকে দিন আরও মনমরা হতে লাগল। লোকে সরগরম, গোলমেলে তাঁবুতে বসে সে বিড়বিড় করে শুধু একটা কথাই বলত, ‘কথা যখন দিয়েছি, কথা রাখব। হাতিরা এক শ ভাগ বিশ্বস্ত।’

একদিন দক্ষিণের এক শহরে পৌঁছাল সার্কাস দলটা। শহরটা পাম বিচ থেকে খুব বেশি দূরে নয়।

সে সময় সেই অপদার্থ পলাতক পাখি মেইজি আয়েশ করে ছুটি কাটাচ্ছিল। তখনো তার অলসতা কাটেনি। একদিন আকাশে উড়তে গিয়ে দেখে নিচে একটা তাঁবু। তার চারদিকে অনেকগুলো পতাকা উড়ছে পতপত করে। আশপাশে অনেক মানুষের ভিড়। তাঁবুর ভেতরে কী হচ্ছে দেখার লোভ হলো পাখিটির। তাই আকাশ থেকে নেমে তাঁবুর একটা খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। সামনের দৃশ্য দেখে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। হর্টনকে দেখে সে বলল, ‘আরে! আমি তো তোমাকে আগে দেখেছি।’

ওপরে তাকিয়ে পাখিটিকে দেখতে পেল বেচারা হর্টনও। মুহূর্তেই তার মুখ চকের মতো সাদা হয়ে গেল। সে কিছু বলার আগেই...অদ্ভুত একটা কান ফাটানো শব্দ শোনা গেল। যে ডিমের ওপর সে একান্ন সপ্তাহ বসেছিল, শব্দটা আসছিল সেখান থেকেই। ধুপধাপ, দুমদুম শব্দে একটা বুনো কিছু আঁচড় কাটছে ডিমটাতে। হর্টন চিত্কার করে বলল, ‘আমার ডিম। ডিমটা কি ফুটছে নাকি!’

ওদিকে চেঁচিয়ে সবকিছু মাথায় তুলে পাখিটি বলে উঠল, ‘ওটা আমার। তুমি আমার কাছ থেকে চুরি করেছ। আমার বাসা থেকে এক্ষুনি সরে যাও। আমার গাছ থেকে নামো।’

হর্টন ভীষণ দুঃখে গাছ থেকে নেমে গেল।

কিন্তু ঠিক তখনই ডিমটা ফেটে তার লাল আর সাদা খোসা চারদিকে ছড়িয়ে গেল। ডিম থেকে এক অদ্ভুত জন্তু বেরিয়ে আসতে দেখল হর্টন। দুটো কান, একটা লেজ আর একটা শুঁড় ঠিক তার মতোই। পাখা ঝাপটে জন্তুটা হর্টনের দিকেই উড়ে যেতে লাগল।

অদ্ভুত জন্তুটার দিকে হা করে তাকিয়ে রইল সবাই। তাদের চোখজোড়া যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে এমন অবস্থা। ঘটনা বুঝতে পেরে সবাই আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল। এমন কাণ্ড কেউ কোনোদিন দেখেনি। সবাই চিত্কার করে বলতে লাগল, ‘হায় ঈশ্বর! এ তো দেখি হাতি-পাখি!’

আসলে এমনই তো হওয়ার কথা! কারণ, হর্টন ছিল বিশ্বস্ত। এক শ ভাগ। সে কখনো ফাঁকি দেয়নি, কথা রেখেছিল। সে ডিম ছেড়ে কখনোই ওঠেনি। তারই এ পুরস্কার।

এরপর লোকগুলো হর্টনকে আর তার ছানাকে বাড়িতে মানে সেই বনে পাঠিয়ে দিল। বলা বাহুল্য, তাতে হর্টন খুশি হয়েছিল ঠিক ঠিক এক শ ভাগ।

ড. সুজ

ভাষান্তর: আবুল বাসার