প্রতিকূল সময়ের সাহসী রচনা

মনে রাখতে হবে সেটা ১৯৭৭ সাল। মাত্র দুই বছর আগে ঘটেছে এ দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞ ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আবেগ-আতিশয্য দূরে থাক, তাঁর সপরিবার হত্যাকাণ্ড নিয়ে ক্ষোভ বা বেদনার স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণেরও তখন অনুকূল সময় নয়। সেই বোবা সময়ে আবুল ফজল মুক্তিবাণী পত্রিকায় লিখছেন ধারাবাহিক স্মৃতিকথা শেখ মুজিব: তাঁকে যেমন দেখেছি। ১৯৭৮ সালের নভেম্বর মাসে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।

এই ক্ষীণকায় গ্রন্থটি নানা কারণে শেখ মুজিবকে নিয়ে লেখা অন্য দশটি গ্রন্থের চেয়ে আলাদা এবং বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।

১. মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর এটিই দেশের একজন বরেণ্য লেখক-বুদ্ধিজীবীর প্রথম রচনা। অবশ্য এর আগেও এই বিষয়ের ওপর সমকাল পত্রিকায় তাঁর লেখা ‘মৃতের আত্মহত্যা’ নামের একটি গল্প ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল পাঠক মহলে। তবে সেখানে ফিকশনের নানা উপাদান ছিল বলেই হয়তো হাতেনাতে ‘অপরাধ’ প্রমাণের সুযোগ ছিল না। কিন্তু স্মৃতিকথাটিতে কোনো ধরনের রাখঢাক বা আড়াল নেই। সেই দিক থেকে এটি তখনকার সময়ের জন্য একটি দুঃসাহসী রচনা বলে স্বীকার করতেই হবে। এ ধরনের লেখা বা অনুভূতির প্রকাশ সেই সময়টাতে কী রকম কঠিন ছিল তার বিবরণও পাই এই বইয়েই। এক জায়গায় তিনি খেদ প্রকাশ করছেন, ‘এত বড় একটা দ্বিতীয় কারবালা ঘটে গেল দেশে, নির্মমতায় যে ঘটনার জুড়ি নেই ইতিহাসে। সে সম্পর্কে দেশের সর্বাপেক্ষা সচেতন অংশ শিক্ষিত আর বুদ্ধিজীবী সমাজ কিছুমাত্র বিচলিত বোধ করছেন না, এ ভাবা যায় না।’—এই ক্ষোভ-দুঃখ প্রকাশের পর আবার বাস্তবতার দিকেও চোখ ফেরান তিনি, ‘এমনও হতে পারে অনেকে লিখছেন, লিখেছেন, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত পত্রপত্রিকা তা ছাপছে না। “বিবেকের সংকট” নামে আমি একটি প্রবন্ধ লিখে ইত্তেফাক-এ পাঠিয়েছি ১৫-১৬ তারিখের দিকে। ইত্তেফাক লেখাটা এখনো ছাপেনি। এখন শুনছি লেখাটা সরকারি মহলের হাতে হাতে ফিরছে।’ (পৃ. ৮৫-৮৬)।

২. স্মৃতিকথার আদলে লেখা এই বইয়ে রাজনীতিক শেখ মুজিবের চেয়ে ব্যক্তি মুজিবকে চেনার সুযোগ বেশি। সেই মুজিব, যিনি তাঁর অসাধারণত্ব নিয়েও মানবিক দোষত্রুটি বা সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নন।

আবুল ফজল এই বিশাল হৃদয় মানুষটির সান্নিধ্য লাভ করে যেমন মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন, তেমনি অকপটে বলেছেন, ‘তিনি সঠিক অর্থে শাসক হতে চাননি। সব সময় থাকতে চেয়েছেন জনপ্রিয় দলীয় নেতা। শাসক হওয়ার মতো দৃঢ়তা, মন-মেজাজ, দূরদর্শিতার ঘাটতি ছিল কী? একটা রাষ্ট্রের শাসক হওয়ার পরও দলীয় নেতার ভূমিকা তিনি ছাড়তে পারেননি। দলীয় সদস্যরা, ছোট-বড় সবাই, আর দূর কিংবা নিকট-আত্মীয়রা একজোট হয়ে যেন তাঁর দুর্বলতার সুযোগ নিতে চেয়েছিল। ষোল আনায় খুশি থাকেনি কেউ কেউ, পেতে চেয়েছে আঠারো আনা। রাষ্ট্র পরিচালক দৃঢ়চিত্ত, নিরপেক্ষ আর দূরদর্শী না হলে নিজের মানুষেরাই তাঁর প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। শেখ সাহেবের বেলায়ও তাই হয়েছে।’ (পৃ. ৮৪-৮৫)।

৩. শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন পরে তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের উপদেষ্টা পরিষদে যোগ দিয়েছিলেন বলে লেখকের এক ধরনের বিবেকের দংশন ছিল। এ প্রসঙ্গে বইয়ের পরিশিষ্ট অংশে তাঁর পুত্র বিশিষ্ট লেখক আবুল মোমেন উল্লেখ করেছেন, আবুল ফজল তাঁর আদর্শ ও চেতনার অনুসারী কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে উপদেষ্টা পরিষদে যুক্ত হয়েছিলেন কিছু শর্ত আরোপ করে। তার মধ্যে হত্যার তদন্ত ও বিচারের বিষয়টি ছিল প্রধান। কিন্তু ‘এ প্রত্যাশার মধ্যে যেমন সততা ছিল, তেমনি ছিল সারল্য। ইতিহাস আদতে তখন সরল ও সৎ পথ ছেড়ে ষড়যন্ত্র ও মিথ্যার কুটিল কুহকে ঢুকে পড়েছে।’ (পৃ. ১১৭)।

প্রতারিতের বোধ নিয়ে অবশেষে দেড় বছরের মাথায় উপদেষ্টা পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন আবুল ফজল। এ বিষয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করে নিজে তিনি কিছু লেখেননি, কিন্তু এই গ্লানির বোধ যে তাঁকে দহন করেছে, পীড়িত করেছে—এই ক্ষীণকায় বইটি যেনও তারও সাক্ষ্য।

শেখ মুজিব: তাঁকে যেমন দেখেছি বইয়ে শেখ কামালকে নিয়ে সংক্ষিপ্ত অথচ হৃদয়গ্রাহী স্মৃতিচারণাটি এই অকালপ্রয়াত যুবক সম্পর্কে তৎকালীন সমাজে প্রচলিত অনেক অপপ্রচারকে নাকচ করেছে।

আবুল ফজল লিখেছিলেন, ‘চোখ-মন বন্ধ করে থাকলে আগামী দিনের নেতৃত্বকেও ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে হবে। তাই সঠিক রাজনীতির পথ খুঁজে নেওয়ার জন্যও শেখ মুজিবের জীবনকে জানার ও অধ্যয়নের প্রয়োজন আছে।’ ১৯৭৭ সালে এ কথা লিখেছিলেন তিনি। সেই ‘প্রয়োজন’ এখনো ফুরিয়েছে বলে মনে হয় না।

শেখ মুজিব: তাঁকে যেমন দেখেছি

আবুল ফজল

প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা

প্রকাশক: বাতিঘর, চট্টগ্রাম

প্রথম প্রকাশ: নভেম্বর ১৯৭৮, বাতিঘর সংস্করণ প্রকাশ: জুন ২০১৭

১১৯ পৃষ্ঠা

দাম: ২৫০ টাকা।