সাগরতীরে

>
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
১৫ আগস্ট কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জন্মদিন। এ উপলক্ষে ছাপা হলো তাঁর প্রথম জীবনে লেখা  অগ্রন্থিত একটি গল্প


ওই দূরে ধূসর পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে যে মেয়েটি নিত্য মৃদু মন্থর গতিতে এধারের লোকালয়ে নেমে আসে, যদিও সে চেনা ও অচেনা সবারই পানে সমান স্থির ও উৎসুক দৃষ্টি মেলে তাকায় কিন্তু তার পানে তাকায় না কেউ। জানা ও অজানা প্রভেদ নেই ওর কাছে, মানুষ যেন বিস্ময়; মানুষের মাঝে সে যে সীমাহীন অক্ষয় নতুনত্ব খুঁজে পায়, সে নতুনত্ব নিত্য দেখেও যেন ফুরোতে চায় না।

মেয়েটির দেহ ক্ষীণ, ঋজু! মুখ ছোট, ঠোঁট সরু, কিন্তু ঘন পল্লবের তলায় দুটি চোখ বড় বড় এবং সেই ডাগর কালো চোখে সকল সময়ে রাজ্যের বিস্ময় যেন জড়ো হয়ে থাকে।

স্থানটি একটি ছোট বন্দর। এখানে-ওখানে বিদেশিদের ভিড়, ঘন ঘন মদের দোকান, নোংরা ছোট ছোট পান্থশালা, আর পার্সি মেয়ে-ভরা রেস্তোরাঁ। চারদিকে ব্যস্ততা, উচ্ছৃঙ্খল জনতা, ধোঁয়া আর বালি। দূরে দীর্ঘ সাগরবেলা ছাড়িয়ে নীল সমুদ্র। গভীর জলে দু-একটা রংচটা বাণিজ্য-জাহাজ। দূরে, বহুদূরে দিগন্তরেখার কোল ঘেঁষে জেলেদের নৌকা। আকাশে প্রচণ্ড সূর্য; তার উত্তাপে লোকদের মুখ বেয়ে ঘাম ঝরে, গায়ে ভ্যাপসা গন্ধ হয়, আর মজুরেরা গোঙায়। মন্থর গতিতে চলতে চলতে মেয়েটি একটা মদের দোকানে থমকে দাঁড়ানো। দরজায় দাঁড়াল একটা লোক, গায়ের রং তার হলদে, আর চোখের রং পিঙ্গল। তার হাত দুটি ট্রাউজারের দুই পকেটে ঢোকানো। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাঙা বিকৃত ইংরেজিতে অবিশ্রান্তভাবে চিৎকার করছে; কপাল বেয়ে, নাক বেয়ে ঘাম ঝরছে তার, মুখচোখ সূর্যের তাপে রাঙা হয়ে উঠেছে। সে ম্যানেজার।

দোকানের ভেতরে লোক গিজগিজ করছে। তাদের হল্লা, অসংযত হাসি, বিকৃত কণ্ঠের চিৎকার—এসব মাঝে মাঝে ম্যানেজারের কর্কশ গলা ডুবিয়ে দিতে চাইছে।

মেয়েটি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকল তাদের প্রত্যেককে, যদিও ধোঁয়া আর অন্ধকারের জন্য তাদের মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। তাদের পকেটভরা টাকা, থেকে থেকে ঝন ঝন করে উঠছে, আর মেয়েটির প্রাণের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠছে। ম্যানেজার একবারও মেয়েটির পানে তাকায়নি, কিন্তু তবু জানে যে সে সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাই মুখ না থামিয়ে দৃষ্টি না সরিয়ে সে মেয়েটিকে ইঙ্গিতে সে স্থান ত্যাগ করতে বলল। মেয়েটি দরিদ্র, তার চোখে ঔৎসুক্য, আর দোকানের লোকগুলোর পকেটভরা টাকা। ম্যানেজারের পানে চেয়ে চেয়ে মেয়েটির বিস্ময়ের ঘোর কাটতে চায় না। আর ম্যানেজার ওকে ভয় করে, সন্দেহ করে, না তাকিয়েই অনুভব করতে পারে তার উপস্থিতি, তাই না তাকিয়ে হাত নেড়ে তাকে সরে যেতে আদেশ করে। ভেতরে লোকেরা মদ খায়, আর ঝন ঝন করে টাকা ঢেলে দেয়।

পার্সি মেয়েদের রেস্তোরাঁগুলো সুন্দর পোশাক পরা সুন্দর পুরুষে ভরা। পার্সি মেয়েরা চিকন গলায় হাসে, আধবোজা আধখোলা চোখে মধুরভাবে কটাক্ষ করে, আর টাকা নেবার বেলায় আড়চোখে বাজিয়ে দেখে নেয়।

কালো ভেলভেটের পর্দার পেছনে বুড়িরা থাকে। তারা রান্না করে। অল্প বয়সী মেয়েরা বাইরে থেকে ভেতরে গেলে তারা আদর করে চুলটা ঠিক করে দেয়, ঠোঁটে কিংবা গালে রঙের দরকার হলে সে কথা বলে দেয়, তারপর ভেতরে আসার জন্য গাল পাড়ে। বুড়িরা বাইরে আসে না, এবং তারা চায় না যে মেয়েরা ভেতরে আসুক। আড়নয়নে চেয়ে যারা টাকা বাজিয়ে নেয়, তারা ভেতরে গিয়ে বুড়িদের হাতেই টাকা তুলে দেয়। কেউ কেউ আবার পর্দার অন্তরালে ঢোকাবার আগেই কিছু পয়সা এধার-ওধার সরিয়ে রাখে, হয়তো জিহ্বার তলায়, অথবা জুতোর মধ্যে। বুড়িরা কিন্তু তাদের চেয়েও চালাক, তাই মাঝে মাঝে তাদের হাতেনাতে ধরে ফেলে আর ধরা পড়ে গিয়ে তারা মাটিতে গড়াগড়ি দেয়, চিৎকার করে কাঁদবার চেষ্টা করে, গাল হতে, ঠোঁট হতে রং তুলে ফেলে।

পার্সি মেয়েদের রেস্তোরাঁর সামনেও মেয়েটি একবার থমকে দাঁড়াল। এখানে মেয়েদের গায়ের রঙে, জনকোলাহলের মধ্যে, আসবাবপত্রে, দেয়ালের ছবিতে ও কালো ভেলভেটের পর্দার ঐশ্বর্যেযর ছায়া, অর্থের ঔজ্জ্বল্য। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে মেয়েটির চোখে ঘোর লাগে, কালো কালো চোখ দুটি মোহাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। সারাক্ষণ তার ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা করে, কিন্তু তা পার্সি মেয়েরা তাকে করতে দেবে না, কোমল ও সুন্দর হাত তুলে তাকে তাড়িয়ে দেবে। মেয়েটি যেন দামী রেশমি বস্ত্রে কাদার ছিটার মতো।

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

ওখানে জীর্ণ চাদোয়ার তলে জুয়া খেলা চলে। সেখানে অসংযত ভিড়, দুর্গন্ধ, আশার অস্ফুটধ্বনি, নিরাশার দীর্ঘশ্বাস, জয়ের উৎফুল্ল চিৎকার আর পরাজয়ের কাতর আর্তনাদ। কারও পকেট ভরে ওঠে, কারও পকেট শূন্য হয়ে আসে। সেখানে উত্তেজনা আর উন্মত্ততা, তাই কে এল, কে গেল—তা দেখবার কেউ নেই। মেয়েটি নিঃশব্দ চরণে সে ভিড়ে মিশে পড়ল।

মাথার ওপর সূর্য ঝাঁ ঝাঁ করে; মানুষের শরীর চিনচিন করে, বেলাভূমি ঝিকঝিক করে, অদূরে নীল সাগর শৈত্যের নিবিড়তায় প্রশান্ত দেখায়।

ভিড়ের মধ্য হতে একসঙ্গে দুটি লোক চিৎকার করে উঠল, একজন পরাজয়ের ব্যথায়, আরেকজন জয়ের আনন্দে, জনতা একটা অস্ফুট গুঞ্জন কর উঠল, তাদের মাঝেও দেখা গেল চাঞ্চল্য।

‘হেই! হেই!’

ভিড়ের মধ্যে মেয়েটি বাঁশপাতার মতো কেঁপে উঠল, তার কালো চোখ শঙ্কায় ও ভয়ে মুদে এল। মেয়েটির ডান হাতটা একজন বিশালকায় দীর্ঘদেহ পুরুষের হাতে বন্দী, ওর হাতের মুঠোর মধ্যে মাত্র কয়েকটা সেন্ট। দীর্ঘদেহ লোকটি মেয়েটির পানে ঝুঁকে তাকালে, তার মুখের কোমলতা ও সরলতার ওপর দারিদ্র্যের রুক্ষতার অপূর্ব সুনিপুণ কীর্তি চেয়ে চেয়ে দেখল, আর সমগ্র অন্তর দিয়ে অনুভব করল ঘন কালো রেখায় নিমীলিত হয়ে থাকা দুটি ভীত চোখ। লোকটি হাত ছাড়ল না, ভিড় হতে টেনে তাকে বাইরে নিয়ে এল। আবার যখন তার পানে ফিরে চাইল, তখন দেখল ওর কৃষ্ণবর্ণ দীর্ঘ পল্লবগুলো সিক্ত হয়ে উঠেছে, আর ঠোঁট কাঁপছে মাঝে মাঝে। লোকটি তার পানে আর চাইল না, হাতও ছাড়ল না, শুধু দীর্ঘ পদক্ষেপে তাকে টেনে নিয়ে চলল।

ওদিকের কোনার রেস্তোরাঁটা ফাঁকা। কারণ লাল ঠোঁট আর আধখোলা চোখ নিয়ে পার্সি মেয়েরা সেখানে নেই। বিশালকায় লোকটি মেয়েটিকে নিয়ে সে রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করল এবং এক নিভৃত কোণে তাকে জোর করে বসাল, আর সে বসল তার সামনে।

ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে যেতে মেয়েটি এবার ভয়ে ভয়ে অতি ধীরে তার চোখ দুটি একটু ফাঁক করল, আড়নয়নে চাইল লোকটির পানে। তখন সে রাস্তার জনতার পানে তাকিয়ে রয়েছে, আর শিস দিচ্ছে মৃদু মৃদু। কয়েক মুহূর্ত আগ্রহ ভরে মেয়েটি দেখল তাকে, তারপর আবার মুদে ফেলল চোখ।

ওয়েটার এসে টেবিল ভরে খাবার রেখে গেল, তা শব্দে অনুমান করল মেয়েটি। ওয়েটারের পায়ের শব্দ মেলাতে লোকটির কণ্ঠ শোনা গেল: ‘হেই!’ মেয়েটি কিন্তু চোখ মেলে চাইল না। তার ভয় কেটে গেছে, এবার একরাশ লজ্জা যেন নিমীলিত চোখ ঘিরে নেচেছে!

‘হেই! হেই!’—লোকটি তাঁর কাঁধে মৃদু ঝাঁকুনি দিল, দিয়ে আবার ডাকল, কিন্তু উত্তরে মেয়েটি নীরবই থাকল—চোখও মেলল না, নড়লও না। তার ডান হাতটি তখনো মুঠো করা।

লোকটি এবার তার সেই হাতটি টেনে নিল, নিয়ে কোমলভাবে মুঠোটা খুলে ফেলল, তারপর সেন্ট কটা তুলে মেয়েটির এক পাশে আস্তে রাখল। অবনত মুখটির চিবুক ধরে তুলে আবার তাকে ডাকতেই এবার একটা অভাবনীয় কাণ্ড ঘটল। মেয়েটি হঠাৎ কেঁদে ফেলল ঝরঝর করে, নিতান্ত ছেলেমানুষের মতো। তার তার গাল মুহূর্তে ভিজে উঠল, আর পাতলা লাল ঠোঁট কাঁপতে লাগল আবেগে।

বিশালকায় লোকটির অন্তরটিও বিশাল। সে বিশালতায় দয়ামায়া-স্নেহ পরিপূর্ণভাবে ভিড় করে আছে। কিন্তু কোনো নিভৃততম কোণে ক্রোধও যে রয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল এবার যখন সে মেয়েটির কান্নায় রেগে গর্জন করে উঠল। তার চোখ জ্বলতে লাগল, নাকের ডগা লাল হয়ে উঠল, এবং তাতে মেয়েটির কান্না মুহূর্তে শুদ্ধতায় রূপান্তরিত হলো, আর চোখ দুটি গেল ফুলে।

কিছুক্ষণ পর মেয়েটির বাঁ হাত ধরে লোকটি রাস্তায় এসে দাঁড়াল। সেন্ট কটা অমীমাংসিত সম্পত্তির মতো রইল পড়ে রেস্তোরাঁর শূন্য টেবিলের ওপর।

তখন মাথার ওপর সূর্য। তার প্রচণ্ড উত্তাপে সমগ্র পৃথিবী যেন জ্বলেপুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছে। পথ জনশূন্য প্রায়, রেস্তোরাঁ ও মদের দোকানগুলো সব ভরে উঠেছে শ্রান্ত-ক্লান্ত মানুষের ভিড়ে। অদূরে উজ্জ্বল উত্তপ্ত সাগরবেলা, আর সেটা ছাড়িয়ে নীল সমুদ্র যেন আরও নীল হয়ে উঠেছে। তার বুকে জাহাজ কটা পুড়ছে, যেন রোদের তাপে ঝিমোচ্ছে, আর দিগন্ত হতে জেলেদের নৌকাগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে।

সাগরবেলা ধরে বাঁ দিকটায় পোয়া মাইল দূরে একটা খাড়া পাহাড়। তার এক দিকটায় ঘন গাছপালা। সে স্থানটা ছায়াচ্ছন্ন, শীতল; সেখানে বসলে নীল জলের শীতলতা যেন অনুভব করা যায়। আর তা ছাড়া জায়গাটা এত নিস্তব্ধ যে সেখানে কান পেতে বসলে হৃদয়ের কল্লোলও বুঝি শোনা যায়।

সেখানে তারা গেল। গেল লোকটি, অন্ধের মতো অনুসরণ করল মেয়েটি এবং তাদের দুজনার মাঝে ছিল হাতের গ্রন্থি।

তারা যেখানে বসল, সে স্থানটা একটু উঁচু, মাথার ওপর একটা বৃহৎ নাম না জানা বৃক্ষ, আর সম্মুখে অনন্ত সাগর। বসে লোকটি একটি সিগারেট ধরাল, তারপর মুখ ফিরিয়ে মেয়েটির পানে তাকিয়ে একদৃষ্টিতে কী যেন দেখতে থাকল। গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে দিগন্তের পানে স্থিরদৃষ্টি মেলে, আনমনাভাবে মেয়েটি ঘাসের ডগা কাটছিল। দিগন্তে যেন চিন্তার ছবি।

মেয়েটি কী ভাবছে, সে-ই জানে। কিন্তু লোকটি যতই ওর পানে চাইছে, ততই বিস্মিত হচ্ছে। অদ্ভুত ওর চোখ দুটি। সেই সরল ও গভীর চোখে সাগরের অসীমতার ছায়া পড়ে আরও অতল ও রহস্যময় হয়ে উঠেছে সে দুটো। এখন এ চোখে অতলতা, পূর্বে ছিল লজ্জা, তার পূর্বে ছিল অশ্রু, তারও পূর্বে ছিল হীনতা। সাগরের পানে তার দৃষ্টি, কিন্তু লোকটির সেদিকে তাকানোর কোনো প্রয়োজন নেই।

‘এই।’

মেয়েটি সাড়া দিল না।

‘এই শোনো।...তোমরা খুব গরিব, না?’

ও মাথা নাড়ল। হ্যাঁ, তারা গরিব।

‘তোমার নাম কী?’

‘দুলী।’

‘বাহ। বেশ নাম। তোমার কে কে আছে, দুলী? বাবা-মা, ভাইবোন—সব আছেন তোমার?’

‘উহু।’

‘কেউ নেই? তুমি একা। তোমার কেউ নেই এ পৃথিবীতে?’

‘আছে। বুড়ো জেঠা আছে। সে পঙ্গু।’

‘বুড়ো জেঠা, তা-ও পঙ্গু! ও!...তবে তোমাদের চলে কী করে?’

‘বুড়ো জুতো সেলায়। তাইতে আমাদের চলে যায়।’

‘ও।’

কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে একটু চাপা গলায় লোকটি প্রশ্ন করল, ‘তাইতে যখন চলে যায়, তবে তুমি চুরি করছিলে কেন, দুলী?’ এবার মেয়েটি কোনো উত্তর দিল না, লোকটিও আর প্রশ্ন করল না। আবার প্রশ্ন করতে তার যেন সাহস হলো না।

সামনে দিয়ে সাগরের পাখির ঝাঁক অস্ফুট উত্তেজনাময় শব্দ করতে করতে উড়ে যাচ্ছে দিগন্তের পানে। কোথায় যাবে তারা? সমুদ্রের অসীমতা কি তারা দেখতে পায় না, দিগন্তরেখাকে কি ডাঙা বলে ভ্রম করে—সবুজ বন ছেড়ে কোন ভরসায়, কোন আশায় তারা নীল সমুদ্র পাড়ি দেয়?

দ্বিপ্রহর অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় মুষড়ে রয়েছে, এবং সে নিস্তব্ধতার মধ্যে স্নেহার্দ্র কোমল মৃদু কণ্ঠে লোকটি মিনতি করল, ‘এই, একটা কথা। বলো শুনবে?...বেশ। বলো যে আর কখনো চুরি করবে না। ওপরে নির্মল স্বচ্ছ আকাশ, আর সম্মুখে অনন্ত সাগর সাক্ষী থাকবে, এ কথাটি তুমি স্বীকার করো। তুমি লক্ষ্মী মেয়ে, তুমি ভালো মেয়ে!’

মেয়েটি শুনছে কি? শুনছে। নইলে চোখের কোণটা তার অমন ছলছল করবে কেন? না, না। ছি। ব্যথিত হয়ে মুখ ফিরিয়ে লোকটি সজোরে সিগারেটে টান দিতে থাকল। ইশ্। সাগরের পাখিরা কী দ্রুত ওড়ে। এরই মধ্যে ওরা যেন দিগন্তের ধূসরতায় মিশে গেছে।

সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে লোকটি সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘যাক। তোমার সঙ্গে আলাপ হলো, আনন্দ পেলাম। কাল সন্ধ্যায় আমাকে জাহাজে উঠতে হবে। তারপর চলে যাব দেশে। সে দেশ দূরে, বহুদূরে, সে দেশের খবর তুমি জানো না। যাবই তো, যাবও চিরকালের জন্য। এ পথে এ জীবনে হয়তো আর কখনো আসব না। এ বন্দরের লাল মাটিতে কখনো পা দেব না; শুধু তোমার দেশের কথা, তোমার কথা আমার মনে থাকবে—চিরকাল থাকবে। থাকবে—আমি জানি।...আচ্ছা দুলী, আমাকে তোমার মনে থাকবে? এ বন্দরে কত শত নতুন লোক আসবে, কত বিচিত্র লোক আসবে, তাদের পানে চেয়ে চেয়ে কখনো কি আমার কথা তোমার মনে জাগবে?’

ওর চোখ ছলছল করছে, হয়তো হাওয়া বয়েছে বলে, সাগরের শান্ত বুকে ঢেউ জেগেছে বলে। কিন্তু সজলতার মধ্য দিয়ে মেয়েটি এ কী শোনাল! বলল, ‘তুমি ভালো না!’ বলল দৃঢ়ভাবে, কিন্তু সে দৃঢ়তা কম্পনের আঘাতে একটু ম্রিয়মাণ হয়েছিল বৈকি। সে বলল, আর লোকটি হাসল। অমন মধুর হাসি আবার লোকে হাসে! মেয়েটি তার হাসি দেখে আবার বলল, ‘কী তুমি?’

‘আমি? আমি একটি দুষ্টুলোক, আমি ভালো না। তুমি খুব ভালো, বড় লক্ষ্মী। আচ্ছা দুলী, আমার সে কথা তুমি শুনলে না? বলো না, আর কখনো চুরি করবে না। তোমার কাজ ও নয়। সে কাজ তোমায় মানায় না। আর, চুরি করা কি ভালো, বলো?’

দুলীর মুখ একটু কঠিন হয়ে উঠল। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে কঠিনভাবেই বলল, ‘চুরি করব।’

তারপর কয়েকবার দ্রুতভাবে চোখের পলক ফেলে, নিজের ঠোঁট কামড়ে, হঠাৎ হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ও কাঁদল, আর বিশালকায় লোকটির বিশাল মুখ ব্যথায় কেমন করুণ হয়ে উঠল।

নীল স্বচ্ছ রৌদ্রদগ্ধ আকাশে এত কারুণ্য থাকতে পারে, তা লোকটির পূর্বে জানা ছিল না। অদূরে নীল সমুদ্র যেন কারুণ্যের ঘায়ে নীরবে মুখ গুঁজে ফেনা ফেনা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। পাহাড়ের এক পাশের গাছগুলোতে অস্ফুট মর্মরধ্বনি হচ্ছে, যেন দুলীর কান্না সেখানে বাজছে। মানুষ কাঁদে কেন? কেন কাঁদে তারা? সম্মুখের এত অগাধ অনন্ত নীল জলরাশি, ওপরের অসীম আকাশ—এরা কি এর উত্তর দিতে পারে না?

বেদনায় সজল ও মৃদুকণ্ঠে আত্মবিস্মৃতের মতো লোকটি বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে, আমার ভুল হয়েছে।’

তারপর থেকে সেখানে সাগরের মৃদু আর্তনাদ আর গাছের পল্লবের অস্ফুট ক্রন্দনই দুপুরের নৈঃশব্দতা নিবিড় করে রাখল, ওদের দুজনের মাঝে আর কোনো কথা হলো না।

মেয়েটির কান্না যখন নিঃশেষ হয়ে এল, তখন আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে মৃদু পায়ে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে সে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল। যাওয়ার সময় বেদনার ছন্দে তার ঘাগড়া দুলে দুলে গেল।

***

তার পরের দিন বিশালকায় লোকটির চোখ জনতার ভিড়ে বৃথাই খুঁজে খুঁজে ফিরল, সে মেয়েটিকে কোথাও আর দেখা গেল না। সারা দিনের ব্যর্থতায় দিনের শেষে সাঝের আবছা অন্ধকারে তার সারা অন্তর একটা অসহনীয় ব্যথায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। যেন না-বলা কথা তার অন্তরজুড়ে রয়েছে। সেটাই তার অন্তরে থেকে থেকে কাঁটার মতো বিঁধতে লাগল। বন্দরের ওপর, ধূসর সাগরের ওপর—আকাশ ছেয়ে দুঃখের মতো সন্ধ্যা নামছে, ধীরে, অতি ধীরে, আর লোকটির ইচ্ছে করছে চোখ মুদে নিস্তব্ধতায় নির্জনতায় নিস্পন্দের মতো পড়ে থাকতে, কিন্তু তা তো হয় না। তাকে জাহাজে যেতে হবে, যে জাহাজ মাসে মাত্র দুবার এখান হয়ে যায়। সাগরের জলে ব্যথার ছলছলানি থাকলে কী হবে, জাহাজে তা নেই। জাহাজ নির্মম, নির্দয়।

কিন্তু এমন সময়ে আবার লোকে আসে? এত ব্যস্ততা, এত তাড়াহুড়ো, এর মাঝে কেন এল সে—! মেয়েটি চাঞ্চল্যের মাঝে শান্ত স্থিরতার মতো ধীরে ধীরে দুলী সন্ধ্যার আবছায়ার মধ্য দিয়ে এল লোকটির কাছে। যখন লোকটি তাকে চেয়েছিল, তখন সে আসেনি; এখন সে এসেছে, যখন তার কথা সে ভাবেনি। সে এসেছে, তাই তাকে কিছু বলতে হবে। কিন্তু কী বলবে, বলবার এখন কীই-বা আছে? কিছু কইবার আগে দুচোখ ভরে লোকটি দেখল মেয়েটিকে, তার সরল বড় বড় কালো চোখ, ছোট্ট পাতলা ঠোঁট, অসংযত কুন্তল, ক্ষীণ ঋজু দীর্ঘ দেহ।

‘চললাম।’

মেয়েটি কথা বলল না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

‘তোমাকে না জেনে ব্যথা দিয়েছিলাম, মাফ কোরো।’

তবু দুলী নির্বাক এবং লোকটির ভাষা শেষ হলো এখানেই। তারা নীরব, নির্বাক। মুখে তারা নির্বাক, কিন্তু অন্তরে হয়তো ঝড় বইছে তাদের।

অবশেষে দুটি বড় বড় স্যুটকেস হাতে নিয়ে যখন লোকটি উঠে দাঁড়াল, তখন মেয়েটির ক্ষীণ দেহ একটু কেঁপে উঠল। লোকটি একেবারে দুলীর সম্মুখে এসে দাঁড়াল, স্যুটকেস দুটি মেঝের ওপর নামাল, তারপর পকেট থেকে কটা নোট বের করে আস্তে মেয়েটির হাতে গুঁজে দিল, মেয়েটি আপত্তি করল না, কিছু বললও না।

সমস্ত বন্দর তখন আলোতে ভরে উঠেছে। সে আলোর বন্যার মাঝখান দিয়ে অবনত মাথায় মৃদু পায়ে চলে গেল বিশালকায় লোকটি, চিরকালের জন্য, চিরদিনের জন্য, একবারটিও আর পেছন ফিরে চাইল না। তাকাবার হয়তো সাহস নেই। যে পাত্র জলে পরিপূর্ণ ভরে রয়েছে, সেটা নাড়তে আর সাহস হয় না। দূরে কালো দিগন্তরেখা রহস্যময়, অপ্রকাশমান। আর ওপরে নিস্তব্ধ আকাশে শুধু তারা আর তারা, অগুনতি তারা, যেন পৃথিবীর যত অশ্রুকণা, সাক্ষীস্বরূপ সব আকাশের গায়ে জমা হয়ে রয়েছে, একটির পর একটি—অফুরন্তভাবে।

মেয়েটি আবছা অন্ধকারের মধ্য দিয়ে গেল সেই স্থানে, যেখানে গতকাল ওরা দুজন বসেছিল। সেখানে আলো নেই, কলরব নেই, জনতা নেই। ওপরে শুধু তারায় ভরা আকাশ, সম্মুখে অনন্ত রহস্যময় সমুদ্র, আর চারদিকে প্রগাঢ় নিবিড়তম নিস্তব্ধতা। নিচে, পাহাড়ের পায়ের ওপর সাগর ভেঙে ভেঙে পড়ছে, কোন অজ্ঞাত ব্যথায় যেন রাত্রির নির্জনতায় একাকী গুমরে গুমরে কাঁদছে।

অদূরে আবছা কালো সাগরের বুকে বিশালকায় অপরিচিত বিদেশি লোকটির জাহাজে মিটমিট করে আলো জ্বলছে, স্বপ্নের মতো স্মৃতির মতো; সে দৃশ্যে আনন্দ নেই, শুধু ফেলে আসার, হারিয়ে ফেলার নিবিড় বেদনার ঘন ছায়া।

দুলী হাতের নোটগুলো—সেই লোকটির দেওয়া নোটগুলো তুলে নিয়ে একবার গালে চেপে ধরল-অতি কোমলভাবে, সযতনে, নিবিড়ভাবে। তারপর গাল হতে তুলে নিয়ে আস্তে আস্তে নিঃশব্দে সেগুলো কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলে দিল, আর দমকা হাওয়া এসে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গেল সেগুলো!

মেয়েটি তরল তমিস্রার মধ্যে দিয়ে তাকাল জাহাজের পানে। তাকিয়ে তাকিয়ে হঠাৎ তার চোখ জ্বালা করে উঠল, একটা অদম্য অভিমানে সারা অন্তর দুলে উঠল। অনন্ত অন্ধকারের বুকে বিশালকায় লোকটির জাহাজ অমন নিস্পন্দভাবে অসাড়ের মতো পড়ে রয়েছে কেন, কেন অমন চেতনাহীনের মতো স্তিমিত আলো ছড়িয়ে আত্মকেন্দ্রিক নীরবতায় স্তব্ধ হয়ে রয়েছে?

টীকা