বঙ্গবন্ধুর বয়ানে সাহিত্য ও সাহিত্যিক

>

নিজের গ্রন্থাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৭ মার্চ ১৯২০—১৫ আগস্ট ১৯৭৫)। ছবি: সংগৃহীত
নিজের গ্রন্থাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৭ মার্চ ১৯২০—১৫ আগস্ট ১৯৭৫)। ছবি: সংগৃহীত

‘শেষ রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি’—কবি-লেখকেরা কবিতা-গল্পে কতভাবেই না স্মরণ করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আবার দেশ-বিদেশের লেখক-সাহিত্যিকদের অনেকেই তাঁকে প্রভাবিত করেছেন, অনেকের সঙ্গে স্বাধীনতার মহান এই স্থপতির ছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। নিজের নানা লেখাজোকায় তিনি লিখে গেছেন সেসব। বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং পনেরো আগস্ট জাতীয় শোক দিবস সামনে রেখে এই লেখায় থাকল সেই বৃত্তান্ত

আল বেরুনীর ভারততত্ত্ব বইটির অনুবাদ হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আলোকচিত্রটি আমাদের অনেকেরই দেখা; আর তাঁর এখন পর্যন্ত প্রকাশিত দুটি বই অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২) এবং কারাগারের রোজনামচাসহ (২০১৭) চিঠিপত্রেও আবিষ্কার করি বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের নিবিষ্ট এক পাঠকসত্তাকে।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এই নেতার অন্তুরজুড়ে। ১৭ জুলাই ১৯৬৬ তারিখে লেখা তাঁর কারালিপিতে আছে রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি না পড়তে পারারও খেদ:

আমার কতগুলি বইপত্র আই বি Withheld করেছে। আমাকে খবর দিয়েছে Reader’s Digest, টাইমস, নিউজউইক এবং রাশিয়ার চিঠি, কোনো বই-ই পড়তে দিবে না। পূর্বেও দেয় নাই।...কত অধঃপতন হয়েছে আমাদের কিছুসংখ্যক সরকারি কর্মচারীর। রাজনীতির গন্ধ যে বইতে আছে তার কোনো বই-ই জেলে আসতে দিবে না। জ্ঞান অর্জন করতে পারব না, কারণ আমাদের যারা শাসন করে তারা সকলেই মহাজ্ঞানী ও গুণী!

এর এক সপ্তাহ পর ২৪ জুলাই জেলখানায় বাবা-মায়ের কথা স্মরণে এলে তিনি সমাগত দুঃখদিনে আশ্রয় নেন রবীন্দ্রকাব্যে:

মনে মনে কবিগুরুর কথাগুলি স্মরণ করে একটু শান্তি পেলাম।

বিপদে মোরে রক্ষা করো
এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।

যৌবনে এক শান্তি সম্মেলনে চীন ভ্রমণে গিয়ে বঙ্গবন্ধু আবিষ্কার করেছিলেন বিশ্বব্যাপ্ত রবীন্দ্রনাথকে:

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ায় অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি।

আবার কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে স্মৃতি রয়েছে তাঁর। ২১ বছর বয়সের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আত্মজীবনীতে লিখছেন:

একটা ঘটনার দিন-তারিখ আমার মনে নাই, ১৯৪১ সালের মধ্যেই হবে, ফরিদপুর ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্স, শিক্ষাবিদদের আমন্ত্রণ জানান হয়েছে। তাঁরা হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইব্রাহিম খাঁ সাহেব। সে সভা আমাদের করতে দিল না, ১৪৪ ধারা জারি করল। কনফারেন্স করলাম হুমায়ুন কবির সাহেবের বাড়িতে। কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব গান শোনালেন।

ইতিহাসের আশ্চর্য কাকতাল, ১৯৪১-এ যে তরুণ শেখ মুজিব নজরুলকে কাছ থেকে দেখলেন, তাঁর গান শুনলেন; ঠিক ৩০ বছর পর ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানের মাধ্যমে বাঙালি জাতির স্বাধীন ভূখণ্ড অর্জনের পর স্বাধীন বাংলাদেশে তিনিই নজরুলকে নিয়ে এলেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে করাচি ভ্রমণের আখ্যানেও অনিবার্যত এসেছেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল:

বিকালে করাচি রওয়ানা করলাম, শহীদ সাহেব নিজে গাড়ি চালালেন, আমি তাঁর পাশেই বসলাম। পিছনে আরও কয়েকজন এডভোকেট বসলেন। রাস্তায় এডভোকেট সাহেবরা আমাকে পূর্ব বাংলার অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। বাংলা ভাষাকে কেন আমরা রাষ্ট্রভাষা করতে চাই? হিন্দুরা এই আন্দোলন করছে কি না? আমি তাঁদের বুঝাতে চেষ্টা করলাম। শহীদ সাহেবও তাঁদের বুঝিয়ে বললেন এবং হিন্দুদের কথা যে সরকার বলছে, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা তা তিনিই তাঁদের ভাল করে বুঝিয়ে দেলেন। আমার কাছে তাঁরা নজরুল ইসলামের কবিতা শুনতে চাইলেন। আমি তাঁদের ‘কে বলে তোমায় ডাকাত বন্ধু’, ‘নারী’, ‘সাম্য’ আরও কয়েকটা কবিতার কিছু কিছু অংশ শুনালাম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতাও দু-একটার কয়েক লাইন শুনালাম। শহীদ সাহেব তাঁদের ইংরেজি করে বুঝিয়ে দিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের এমন অনেক কবিতা যে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ও হৃদয়ে ছিল তা তাঁর উত্তরকালের নানা রাজনৈতিক ভাষণ-বক্তৃতায়ও স্পষ্ট হয়।

শরৎচন্দ্রের ‘আঁধারের রূপ’ প্রবন্ধটির কথা এসেছে কারাগারের রোজনামচায়। জীবনে ঘনিয়ে আসা আপাত অন্ধকারে তিনি যখন প্রিয় লেখকের অক্ষরের আলোর শরণ নেন তখন বুঝতে হয় তাঁর প্রতিটি পাঠ গভীর এবং প্রায়োগিক।

শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৫-তে, এক বছর পর ৪ জুন ১৯৬৬-তে কারাগারে বসে বঙ্গবন্ধু লিখছেন:

বন্ধু শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক বইটি পড়তে শুরু করেছি। লাগছে ভালই...।

১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের কয়েক বছর পর এক সম্মেলনে চীন ভ্রমণে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় ও সখ্য গড়ে উঠে কলকাতার প্রখ্যাত সাহিত্যিক মনোজ বসুর। সে সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি শেখ মুজিব বাংলায় বক্তৃতা করেছেন, যা মনোজ বসুকে মুগ্ধ করে। স্মৃতিচারণায় বঙ্গবন্ধু জানাচ্ছেন মনোজ বসুর প্রতিক্রিয়া:

আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষা বলা কর্তব্য। আমার বক্তৃতার পরে মনোজ বসু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ভাই মুজিব, আজ আমরা দুই দেশের লোক, কিন্তু আমাদের ভাষাকে ভাগ করতে কেউ পারে না। আর পারবেও না। তোমরা বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা দিতে যে ত্যাগ স্বীকার করেছ আমরা বাংলা ভাষাভাষী ভারতবর্ষের লোকেরাও তার জন্য গর্ব অনুভব করি।

মনোজ বসু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর স্মৃতিমধুর দিনগুলোর কথা লিখেছেন চীন দেখে এলাম নামের ভ্রমণালেখ্যে।

দুই.
১৩ জুন ১৯৬৯ ঢাকা থেকে ইতালিপ্রবাসী কন্যা শেখ হাসিনাকে লিখিত চিঠিতে ব্যক্তিগত খোঁজখবরের পাশাপাশি তিনি লেখক-সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং ভাষাবিজ্ঞানী সাহিত্যিক মুহাম্মদ আবদুল হাইয়ের প্রয়াণের খবর জানান এভাবে:

বোধ হয়, শুনেছ মানিক ভাই (তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক) পিন্ডিতে (রাওলপিন্ডি) হঠাৎ মারা গেছেন। বুঝতেই পার আমার অবস্থা। প্রফেসর হাই সাহেবও মারা গিয়েছেন। বাংলাদেশের দুইজন কৃতী সন্তান আমরা হারালাম।

এই চিঠি লেখার অত্যল্পকাল পূর্বে পহেলা জুন ১৯৬৯-এ রাওয়ালপিন্ডিতে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং এর দুদিন পর ৩ জুন মুহম্মদ আবদুল হাই ঢাকায় এক রেল দুর্ঘটনায় প্রয়াত হন। তাঁদের মৃত্যু বঙ্গবন্ধুকে কতটা বেদনাবিধুর করেছিল তা কন্যাকে লেখা চিঠির হৃদয়ার্দ্র ভাষা থেকে অনুমিত। মানিক মিয়ার ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ লেখার প্রতি তাঁর অনুরাগের কথা ব্যক্ত হয়েছে কারাগারের রোজনামচায়। আর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলছেন:

মানিক ভাই ইংরেজি লিখতে ভালবাসতেন, বাংলা লিখতে চাইতেন না। সেই মানিক ভাই বাংলায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলামিস্টে পরিণত হলেন। চমৎকার লিখতে শুরু করলেন।

তিন.
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা বাংলা সাহিত্যের কবি-লেখকদের প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গে যেমন ভাস্বর তেমনি এসেছে নানা দেশের, নানা ভাষার সাহিত্য ও সাহিত্যিক প্রসঙ্গ।

অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লাহোর সফরের বিবরণে পাই আইনজীবী খাজা আবদুর রহিমের আতিথ্যে কবি ইকবালের স্মৃতিবিজড়িত জাভেদ মঞ্জিলে শেখ মুজিবের অবস্থানের তথ্য:

‘আল্লামা শুধু কবিই ছিলেন না, একজন দার্শনিকও ছিলেন।...আল্লামা যেখানে বসে সাধনা করেছেন সেখানে থাকার সুযোগ পেয়েছি!’

কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পরিচয়ের কথা স্মরণ করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে তাঁর অবস্থানের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

ফরাসি লেখক এমিল জোলার উপন্যাস তেরেসা রেকুইন উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৮৬৭-তে। এর শত বর্ষ পর ১৮ জুন ১৯৬৬-তে বাংলার কারাবন্দি নেতা শেখ মুজিবের হাতে লেখা হচ্ছে এর পাঠ প্রতিক্রিয়া:

এমিল জোলার লেখা তেরেসা রেকুইন পড়ছিলাম। সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনটা চরিত্র—জোলা তাঁর লেখার ভিতর দিয়া। এই বইয়ের ভিতর কাটাইয়া দিলাম দুই তিন ঘণ্টা সময়।

বঙ্গবন্ধুর পাঠবিশ্ব কতটা বিচিত্র—প্রেম, দুর্বিপাক ও মৃত্যুময় এমিল জোলার এই উপন্যাস পড়ার উল্লেখে তা প্রমাণিত হয়। বঙ্গবন্ধুর পাঠপ্রতিক্রিয়ার সঙ্গে মূল বইটি মিলিয়ে পড়লে পাঠকের অনুধাবনে আসবে লঁরা, তেরেসা, ক্যামিলাস—এই তিন চরিত্রের কথাই বলতে চেয়েছেন তিনি, প্রেমের পরিণতিতে যারা জীবনের এক করুণ পরিসীমায় এসে উপনীত হয়। উল্লেখ্য, এমিল জোলার এই বিশ্বখ্যাত বইটি বাংলায় তেরেসা শিরোনামে অনুবাদ করেছেন আবদার রশীদ (বর্তমান প্রকাশক: বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা)।

এমিল জোলার তেরেসা রেকুইন ও শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক—এই দুই উপন্যাসই জেলে বসে পড়েন বঙ্গবন্ধু
এমিল জোলার তেরেসা রেকুইন ও শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক—এই দুই উপন্যাসই জেলে বসে পড়েন বঙ্গবন্ধু


অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এসেছে পঞ্চাশের দশকে চীন ভ্রমণে তুর্কি কবি নাজিম হিকমতের সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রসঙ্গ; গণমুক্তির আবাহন যাঁর কাব্যে তাঁর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্বভাবতই বোধ করেছেন আত্মিক মিত্রতা:

রাশিয়ার প্রতিনিধিদেরও আমরা খাবার দাওয়াত করেছিলাম। এখানে রুশ লেখক অ্যাসিমভের সাথে আলাপ হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এই সম্মেলনেই আমি মোলাকাত করি তুরস্কের বিখ্যাত কবি নাজিম হিকমতের সাথে। বহুদিন দেশের জেলে ছিলেন। এখন তিনি দেশত্যাগ করে রাশিয়ায় আছেন। তাঁর একমাত্র দোষ তিনি কমিউনিস্ট। দেশে তাঁর স্থান নাই, যদিও বিশ্ববিখ্যাত কবি তিনি।

মার্কিন রাষ্ট্রতত্ত্ববিদ, লেখক হেনরি ডেভিড থরোর সুবিখ্যাত রচনা সিভিল ডিসঅবিডিয়েন্স (১৮৪৯) ছিল বঙ্গবন্ধুর পাঠের আওতায়। এপ্রিল ১৯৬৭-তে তিনি লিখছেন:

মনে রেখ থরোর কথা—

‘Under a government which imprisons any unjustly, the place for a just man is also a Prison.

চার.
বঙ্গবন্ধুর লেখায় নানা প্রসঙ্গে এসেছে সাহিত্য ও সংস্কৃতিজগতের গুণীদের কথা, যেমন শাহেদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন, হবীবুল্লাহ বাহার, মুজিবুর রহমান খাঁ, মওলানা আকরম খাঁ, আবুল মনসুর আহমদ, ইব্রাহীম খাঁ, কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস, মাহমুদ নূরুল হুদা, মোহাম্মদ মোদাব্বের, কামরুদ্দিন আহমদ, রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, অজিত কুমার গুহ, মুনীর চৌধুরী, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস প্রমুখ। এসেছে পত্রিকা পড়া, পত্রিকার প্রতিবেদন ও কলামের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও গান শোনার কথা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে এক ভ্রমণে গিয়ে নৌপথে আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে ভাটিয়ালি গান শোনার অনুপম অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে এই মহান নেতার কলমে:

নদীতে বসে আব্বাসউদ্দীন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিন যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে। তাঁরই শিষ্য সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন তাঁর নাম কিছুটা রেখেছিলেন। আমি আব্বাসউদ্দীন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।’ আমি কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম।

বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য এবং বাঙালি সংস্কৃতি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রাণ। তিনি তো জানতেন এক একটি বাংলা অক্ষর এক একটি বাঙালির জীবন। বাঙালির জীবনে স্বাধীনতার আলোর জন্য তিনি নিপতিত হয়েছিলেন পাকিস্তানি কারা-অন্ধকারে। কারাকক্ষেও তিনি খুঁজে ফিরেছেন বাংলা বই ও পত্রিকা। এর বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে কারাগারের রোজনামচায়:

প্রাণটা আমার হাঁপাইয়া উঠছিল, সহ্য করা কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। বাংলা বই পাওয়ার উপায় নাই। অফিসার মেসের যে ছোট লাইব্রেরি আছে তাতে কোনো বাংলা বই নাই, সমস্তই প্রায় ইংরেজি ও উর্দুতে। হেডকোয়ার্টার লাইব্রেরি থেকে মেজর গোলাম হোসেন চৌধুরী আমাকে দু-একখানা এনে দিতেন। ভদ্রলোকও খুব লেখাপড়া করতেন। কোনো বাংলা বই বোধ হয় সেখানে নাই। খবরের কাগজ পড়া নিষেধ, তাই বাংলা কাগজ পড়ার প্রশ্ন আসে না।

এভাবেই বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের পাতায় পাতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পেয়েছেন চিরকালের মুক্তিপ্রত্যাশী মানুষের দেখা। সে মানুষেরই স্বাধীনতার অধরা স্বপ্নকে অতঃপর রূপ দিয়েছেন স্বদেশের বাস্তবে।