নাইপলের হ্যাট

২০১৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভি এস নাইপল। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
২০১৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভি এস নাইপল। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

ভি এস নাইপল তাঁর ছায়া ফেলে যান। ২০১৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকায় বাংলা একাডেমিতে বই লিস্ট ফেস্টিভ্যাল উদ্বোধন করেন ১৯৯১ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী স্যার বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নাইপল। পশ্চিমা দেশের বিশ্বখ্যাত খুব বেশি সাহিত্যিক আমাদের দেশে আসেননি। এসেছিলেন কথাসাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস, কবি টেড হিউজ, রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছিলেন সেনেগালের প্রেসিডেন্ট সেদার সেংঘর এবং আরও অল্পসংখ্যক অতিথি। ঢাকায় তাঁদের স্মৃতিসান্নিধ্য আমাদের অনেককে মুগ্ধ করে রেখেছে এখনো। হলভর্তি দর্শক অপেক্ষা করছিলেন শুধু নাইপলের কণ্ঠ শোনা এবং চেহারাটা দেখে নেওয়ার জন্য। দুম করে আয়োজকসমেত মঞ্চে নিয়ে আসা হলো তাঁকে। গাঢ় নীল রঙের কোট, মামুলি চেকে টাই এবং প্যান্ট নয়, গাঢ় নীল ট্রাউজার। পায়ে মর্নিং ওয়াকের মোকাসিন। সবকিছু দেখে আমাকে সতর্ক হতে হলো। ক্যামেরায় ফোকাস করে দেখছি, হুইলচেয়ারে বসে থাকা নিরীহ এবং ভারতীয় নাগরিকের মুখচ্ছবি, যাঁর জন্ম ১৯৩২ সালে ত্রিনিদাদে। তিনি ভি এস নাইপল উপন্যাস আত্মজীবনীতে প্রলুব্ধ করে রেখেছেন ইংরেজি সাহিত্যের পাঠকদের প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল। আমাদের দেশে তাঁর বই কিনে পড়ার পাঠকও কম নয়।

স্টেজের সামনে চলে এলেন তিনি। দুই পাশে এবং পেছনের সবাই ক্যামেরার ফ্রেমে। তিনি কী করেন, দেখছে আমার অনুসন্ধানী ক্যামেরা। লাল ফিতা ধরা হলো হুইলচেয়ারে বসা নোবেল বিজয়ীর হাতের নাগালের মধ্যে। দেওয়া হলো কাঁচি। তিনি বসে কাটলেন ফিতা। উদ্বোধন হলো ঢাকায় বই লিস্ট ফেস্টিভ্যালের। ছবি তুললাম, কিন্তু ক্যামেরা আরও কিছু পেতে চায়। দেখতে চায় নাইপল মানুষটি আসলে কেমন, কীভাবে তাঁর চেহারার ভূগোল ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। কিন্তু না, তাঁকে উদ্বোধনের পর দ্রুত স্টেজের পেছন দিক দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। যে ছবি আমি তুলতে চেয়েছিলাম, যা বাংলাদেশে তাঁর ভক্তরা দেখতে চান, সেই মুগ্ধতায় হলো না কোনো ছবি তোলা। হ্যাট পরা নাইপলের মুগ্ধতায় হলো না কোনো ছবি তোলা। হ্যাট পরা নাইপলের দেখা পেলাম না। স্টেজের পেছনে গিয়ে নাইপলের আলাদা বা একক পোর্ট্রেট করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সুযোগ হলো না।

পরদিন সুযোগটা আমার কাছে চলে আসে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাখি দেখতে যাবেন তিনি। গোপন রাখা হলো। কিন্তু আমাকে জানালেন অধ্যাপক ও কবি শামীম রেজা। চলে গেলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাংলোয়। সেখানে সেখানকার বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও কয়েকজন ছাত্র সমবেত হয়েছেন নাইপলকে দেখবেন। তিনি এলেন, গাড়ি থেকে হুইলচেয়ারে বসলেন। জাহাঙ্গীরনগরের উপাচার্য স্বাগত জানালেন নাইপল ও তাঁর স্ত্রী লেডি নাদিরা নাইপলকে ফুল দিয়ে। উপাচার্যের বাড়ির লনে নাইপলকে ঘিরে সবাই ছবি তুললেন। তাঁর পেছনে, ডানে ও বাঁয়ে যাঁরা অবস্থান নিয়েছেন, তাঁদের অনুরোধ করে ফাঁকা করে দেওয়া হলো আমার জন্য স্যার বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নাইপলকে। তিনি কয়েক মিনিটের জন্য মেলে ধরলেন আমার ক্যামেরার সামনে নিজেকে। আমার খুব কাছাকাছি কিন্তু তাঁর আসল চেহারা ধরতে পারছিলাম না। হুইলচেয়ারে বসে ক্লান্ত নাইপল কথা বলছিলেন অল্পস্বল্প। হাঁটুর ওপরে কোলে ছিল তাঁর মাথার মুকুটটি। বেশ জোরে বলে ফেললাম, আপনার মাথার হ্যাটটি পরলে আপনাকে ঠিকভাবে ধরতে পারবে আমার ক্যামেরা। তিনি আমার অনুরোধ রাখলেন। চট করে হাত চলে গেল হ্যাটে। মাথায় তুলে নিলেন তাঁর নির্ধারিত মুকুট, প্রিয় হ্যাট। তখন সবার চেহারায় স্বস্তির আভা যেন চলে এল। আমাদের সামনে বিশ্বখ্যাত নাইপল, হ্যাট পরা।

পাখি দেখতে গেলেন অনেকটা দূরে। জাহাঙ্গীরনগরের সুরক্ষিত লেকে, যেখানে সাধারণের প্রবেশ নেই। লেকের পাড়ে বসে দুরবিন দিয়ে দেখলেন ভিনদেশ থেকে আসা ভ্রমণকারী পাখি। তাদের গুঞ্জন যেন মুখরিত হয়ে উঠল। ভি এস নাইপল হ্যাট খুলে উপভোগ করলেন। সন্ধ্যা নেমে এল। তিনি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে তাঁর কাছে একজন একটি মাত্র অটোগ্রাফ চাইলেন। দিলেন না। হ্যাট মাথা থেকে নামিয়ে চলে গেলেন নাইপল।