পূর্বরাগের অসম্পূর্ণ খসড়া

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মার্টিন কোম্পানির ন্যারোগেজ ছোট লাইনের ট্রেনটা বর্ধমান থেকে ছাড়ব ছাড়ব করছে। এর গন্তব্য কাটোয়া। শনিবারের শেষ ট্রেন রাত সাড়ে নয়টায় ছাড়ে। একমাত্র শনিবারেই আছে এই ট্রেনটা। অন্যান্য দিন সন্ধের ট্রেন সাড়ে আটটায় ছেড়ে যায়। আজও গিয়েছে। সেই ট্রেনটা আমি আজ পাইনি। পাবার চেষ্টাও করিনি। হন্তদন্ত হয়ে বরং মিনিট দশেক আগে একটা ইন্টারক্লাস কামরায় উঠে বসেছি। শীতকালের মাঝামাঝি, জাঁকিয়ে বসেছে জাড়কাল। কামরা প্রায় ফাঁকা। একজন, দুজন প্যাসেঞ্জার কামরার একোণে-সেকোণে মুখে চাদর বা ধুতির খুট জড়িয়ে বসে আছে। আমি জানি, এই শীতে এর বেশি প্যাসেঞ্জার হবেও না। যারা এখানে আছে তারা কেউ কোনো কথাও বলবে না, নিজের নিজের স্টেশনে ট্রেন থামলেই টুক করে নেমে যাবে। এত ঠান্ডায় কামরায় কামরায় চেকার-টেকারও তেমন আসে না। আশপাশে যাঁদের দেখছি, এরা কেউই টিকিট কেটেছে কিনা সন্দেহ। আমি একটা স্কুলে মাস্টারি করি, অকারণ ভদ্রতার খাতিরে টিকিট একটা কেটেছি। টিকিটহীন যাত্রীদের তরফ থেকে কেনা হলো ভেবে মনে মনে একটু অহংকারও এল বোধ হয়।

আরে, ছাড়ছে না কেন ট্রেনটা? ইঞ্জিনটা ঘুরিয়ে সামনের দিকে লাগানো হয়েছে অনেকক্ষণ হলো। ফোঁস ফোঁস নিশ্বাস ফেলছে সেটা। প্ল্যাটফর্ম শূন্য—যারা যাত্রীদের, আত্মীয়স্বজনদের উঠিয়ে দিতে এসেছিল, তারা অনেক আগেই চলে গেছে। আহ, এবার মনে হয় ছাড়বে। রেলের গার্ড সাহেব দেখছি গদাই লস্করি চালে হাতে লণ্ঠন, হুইসেল, সবুজ পতাকা ইত্যাদি নিয়ে স্টেশনঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। দু-তিনজন চেকারও তাঁর সঙ্গে গাড়িতে উঠলেন।

সবাই জানে, মোটামুটি দূরপাল্লার রেলগাড়িগুলো ছাড়বার ঠিক আগের মুহূর্তে স্টেশনের মধ্যে একটা থমথমে ভাব তৈরি হয়। একটু যেন তটস্থ। ঢং ঢং করে গাড়ি ছেড়ে দেবার ঘণ্টা অনেক আগেই বাজানো হয়ে গেছে। কয়লার ইঞ্জিন থেকে হঠাৎ একটা আগুনে হাওয়ার ঝটকা এসে মুখে লাগল—গ্রীষ্মকালের দুপুরের উত্তপ্ত বাতাস যেন এই শীতকালেও হানা দিচ্ছে। ট্রেন ছাড়ার হুইসেল বাজিয়ে আর সবুজ পতাকা দুলিয়ে গার্ড সাহেব জানিয়ে দিলেন, গাড়ি এখন ছেড়ে দিতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে আরেকবার ইঞ্জিন থেকে চালক ঘাড় ফিরিয়ে পুরো প্ল্যাটফর্মটা দেখে নিয়ে গাড়ি ছাড়ার বাঁশি বাজিয়ে দিল।

ঠিক তখনই দেখতে পেলাম, দুটি যুবক এক তরুণীকে সঙ্গে নিয়ে স্টেশনঘর থেকে বেরিয়ে প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়িয়ে গার্ড সাহেবকে তক্ষুনি গাড়ি না ছাড়তে অনুরোধ করল। ভাগ্যিস, ড্রাইভারও তাদের দেখতে পেয়েছিল। যুবক দুটি তরুণীটিকে সঙ্গে নিয়ে আমি যে ইন্টারক্লাস কামরায় বসেছিলাম, সেখানেই উঠে এল। মাত্র একটাই তো ইন্টারক্লাস কামরা। মহিলাকে তারা আমার পাশে না বসিয়ে মুখোমুখি বেঞ্চে বসিয়ে দিল। আমার দিকে চেয়ে একজন যুবক বলল, ‘এই কামরা তো একেবারেই ফাঁকা, আপনি আপনার স্টেশনে নেমে যাওয়া পর্যন্ত যদি এঁর দিকে খেয়াল রাখেন তাহলে ভালো হয়।’

মাথা ঝুঁকিয়ে আমি বললাম, ‘একটুও চিন্তা করবেন না, আমি যে স্টেশনে নেমে যাব, সে পর্যন্ত যদি এই কামরায় উনি থাকেন, ওঁর কোনো বিপদ হবে না। কিন্তু তার পরের কোনো স্টেশনে যদি ওঁকে নামতে হয়, তাহলে তো আমার করার কিছু নেই।’

‘আপনি যাবেন কতদূর?’

‘আমি নিগণ স্টেশনে নেমে যাব।’

‘তাহলে তো কথাই নেই। উনিও নিগণে নামবেন। ওঁকে নিয়ে যাবার জন্যে গরুর গাড়ি অপেক্ষা করবে ওখানে।’

আশস্ত হয়ে দুই যুবক ট্রেন থেকে নেমে গেল। ট্রেন এখন চলতে শুরু করেছে। প্ল্যাটফর্মের ওপর চলন্ত ট্রেনের কামরাগুলোর ছায়া চলতে চলতে একসময় মিলিয়ে গেল। প্ল্যাটফর্ম পেরোনোর পরও ট্রেন ধীর লয়ে চলছে। কিছু দূর এগিয়ে সামনে একটা ব্রিজ এল, পার হবার সময় কানে বাজল ধাতব গুমগুম আওয়াজ। কিন্তু ট্রেনের গতি যে একটুও বাড়ছে না—দুপাশে বর্ধমান শহরের ল্যাম্পপোস্টগুলোর ম্লান আলো টিমটিম করে জ্বলছে। দুপাশের রেল কোয়ার্টার খুব ধীরে ধীরে পেছনে পড়ে যাচ্ছে। আর একটুক্ষণের মধ্যেই দুপাশে রাঢ়ের বিস্তৃত মাঠ পেছনে সরে যেতে থাকবে ক্রমশ। প্রান্তরের মধ্যে অন্ধকার আস্তে আস্তে অভ্যস্ত চোখে ফিকে দেখাবে। দূরদূরান্তের গ্রামগুলো এর মধ্যেই মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ সুষুপ্ত।

নির্জনতা যেন শরীরী রূপ নিয়ে আলোজ্বলা কামরার ভেতরটিকেও অন্ধকারের বেশ দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। যদিও, কামরার দুই দিকে দুটি পুরোনো আলো জ্বলছে, তাতে ভুতুড়েই মনে হচ্ছে সব কিছু। কামরার ল্যাজা-মুড়ো দুদিকেই মাথার ওপরে লেখা আছে ‘বারোজন বসিবেক। বিনা টিকিটে ওঠা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ’। কথাগুলোর তলে একদল কাঠপিঁপড়ে লাইন ধরে যাচ্ছে, দূর থেকে দেখলে মনে হয় সদ্য কিশোরের রোঁয়া ওঠা গোঁফ—নিয়মকে পিঁপড়েগুলো ব্যাঙ্গই করছে হয়তো। আর দেখা যাচ্ছে তার পাশে আরও বড় বড় হরফে লেখা ‘বাংলার শত্রু ম্যালেরিয়া’। এর নিচে আবার ছোট হরফে টীকা হিসেবে সংযোজন, ‘মশা জন্মাতে দেবেন না। পুকুর পরিষ্কার রাখুন। মাছ ছাড়ুন।’ সাথে একটা পুকুরের ছবি, নেহাতই কাঁচা হাতে আঁকা।

এমন সময়. হঠাৎই সম্মুখে থাকা তরুণীর মুখশ্রীর দিকে চোখ পড়ল। দুজনেই এই আকস্মিক আবিষ্কারের ঘটনায় বিব্রত। যেনবা এ না হলেই ভালো ছিল, কিন্তু এখন তো একে এড়ানোর উপায়ও নেই। কে আগে কথা বলবে বা শুরু করবে সংলাপ? দুজনেই তো দুজনকে চেনে!