'মানুষের সমগ্র চৈতন্যই আমার রচনায় গ্রেপ্তার করতে চেয়েছি'

শহীদ কাদরী (১৪ আগস্ট ১৯৪২—২৮ আগস্ট ২০১৬)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
শহীদ কাদরী (১৪ আগস্ট ১৯৪২—২৮ আগস্ট ২০১৬)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

প্রশ্ন: আপনার নিজস্ব অর্থে কবিতাকে জানতে চাই।

শহীদ কাদরী: কবিতা হচ্ছে সেই বস্তু যা বিজ্ঞানের বিপরীত। বিজ্ঞানের প্রয়াস হচ্ছে যেখানে বিশ্বপ্রকৃতির নৈর্ব্যক্তিক ও বিমূর্ত নিয়মাবলি আবিষ্কার করা, কবিতা সেখানে মনো-প্রকৃতির দাস। বিজ্ঞান সামান্যকরণে উন্মুখ, কবিতা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশেষের ব্যাপার। অনুচ্চারিতকে উচ্চারণ ও অনালোকিতকে গ্রেপ্তার করাই হচ্ছে কবিতা। কিন্তু তার আরও একটা ভূমিকা আছে (এবং এখানে কবিতা ধর্ম ও পুরাণের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়)। ভূমিকাটি আর কিছু নয়, মানুষের পরিবেশের মানবিকীকরণ বা হিউমানাইজেশন। কবিতা অতীতে বিরূপ বিশ্বপ্রকৃতিকে প্রীতির সূত্রে গ্রথিত করে বহু বিপরীতকে মিলিয়েছিল; নিরপরাধ গোলাপ এবং বাঘের চোখের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে কবিতারই দৌত্যে। খরস্রোতা নদী এবং হাঙর-ঠাসা সমুদ্রকেও বন্ধু ভাবতে শিখিয়েছে কবিতা। পরিবেশসংলগ্ন এমন অজস্র বস্তু, ঘটনা ও পরিস্থিতি রয়েছে যার স্পষ্ট উচ্চারণ খোলা চোখের কবির এবং সন্ধানকামী কবিতার অপেক্ষা রাখে।

প্রশ্ন: ‘কবি’ শব্দে চিহ্নিত ব্যক্তি কারা? প্রচলিত সাধারণ অর্থ ছাড়া এ ব্যাপারে আপনার কি কোনো বিশেষ সংস্কার আছে?

শহীদ: বলা বাহুল্য যাঁরা কবিতা লেখেন, তাঁরাই কবি। না কোনো সংস্কার নেই, তবে বিশেষ ধারণা আছে। ছন্দোবদ্ধ রচনামাত্রই যেমন কবিতা নয়, কাব্যপ্রতিম শব্দাবলির সন্নিপাতনের ক্ষমতাই কাউকে কবি করে দেয় না। যেমন ধরুন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, ছন্দ ও ভাষার ওপর তাঁর দখল ছিল অসামান্য। কিন্তু তিনি পদ্য লেখকের পঙ্‌ক্তিভুক্ত রয়ে গেলেন, কবি হতে পারলেন না। কারণ, তিনি এমন কিছু দেখেননি যা তাঁর সময়কার মানুষের পূর্ব-অভিজ্ঞতায় ছিল না। তিনিই কবি যাঁর বোধ জনসাধারণের চেয়ে ঢের বেশি তীব্র, যাঁর সংবেদনাÑআবার বলছি জনসাধারণের চেয়ে তীক্ষ্ণতর, যাঁর অভিজ্ঞতা অর্জনের স্বাভাবিক ক্ষমতা জনসাধারণের চেয়ে ঢের বেশি, যাঁর দৃষ্টি সাড়ে সাত কোটি বাঙালির চেয়ে প্রখরতর। এবং এখানেই কবিরা (কবিতা লেখকমাত্রই কবি নন) অন্যদের চেয়ে ভিন্ন, স্বতন্ত্র, একলা। এবং দারুণভাবে বিপর্যস্ত ও দুঃখের বংশানুক্রমিক দাস। আপাত সাদৃশ্য-বঞ্চিত বস্তুপুঞ্জের বিয়েও কবিরা দিয়ে থাকেন। এখন উপমা এবং উৎপ্রেক্ষা তাঁদের সহায়।

প্রশ্ন: বিষয়ে বিমূর্ততা, আঙ্গিকে নিয়ম ভাঙার ক্রমপ্রয়াসে আমাদের কবিতা কোন লক্ষ্যে এগোচ্ছে বলে মনে করেন?

শহীদ: বিমূর্ততা কবিতার বিষয় নয়। কবিরা যখন বিমূর্তকে স্পর্শ করেন, তখন তাঁদের উদ্দেশ্য হয় বিমূর্তের বিদারণ। বিমূর্ত বলতে আপনারা কী বোঝাচ্ছেন সেটা স্পষ্ট হওয়া দরকার ছিল। সেকেন্ড ল’ অব থার্মোডাইনামিক্স যেমন একটি বিমূর্ত ধারণা, ‘প্রেম’ বা ‘মৃত্যু’ বা ‘আশা’ অথবা ‘হতাশা’—এ সবও বিমূর্ত তথা ভাববস্তু। কিন্তু কবিতায় যখন এসব আসে, তখন বিশেষের ছদ্মবেশ ধরে অর্থাৎ চিত্রকল্প হয়ে আসে; প্রেম, বিরহ, শাশ্বতীর অন্বেষণ ও ইতিহাস-চেতনা বনলতা সেন নাম্নী এক কারুকার্যময় আধুনিক মহিলায় রূপান্তরিত হয়ে যায়, ধান কাটা মাঠের চিত্র ধরে রাখে শূন্যতার মতো বিমূর্ত ধারণাকে।

কবিতার আঙ্গিক ভাঙা আজ আর বড় কথা নয়। জরুরি ব্যাপার হচ্ছে নতুন আঙ্গিক তৈরি, পরিবর্তিত সময় ও পটভূমিজাত নব নব চেতনাকে উপলব্ধির সীমায় নিয়ে আসবে। নতুন আঙ্গিক অর্থাৎ শব্দধ্বনিপুঞ্জ সমাবেশের নতুন নিয়মাবলি ও ব্যাকরণ তৈরি হচ্ছে না। কবি এবং অকবি একই সঙ্গে কবিতার আঙ্গিক ভেঙেছেন। এতে কোনো লাভ হচ্ছে না। ক্বচিৎ একটি কি দুটি কবিতা লিখিত হচ্ছে বটে। আমাদের কবিতা এগোচ্ছে না, এগুলো কবিতার কাজই নয়। কবিতা বদলায়। কিন্তু বদলে যাওয়াটাই সব সময় সুলক্ষণ নয়। তবে যে অর্থে কবিতা এগোয়, তা মোটামুটি গোটা বাংলা কবিতার ব্যাপারেই প্রযোজ্য নয়। কবিতা যখন আমার অভিজ্ঞতা ও বোধের সীমা প্রসারিত করে, তখনই কবিতা এগোয়। সেই অর্থে কোনো কোনো কবির কোনো কোনো কবিতা এগিয়েছে। কিন্তু সমগ্রভাবে এগিয়ে যায়নি, না আঙ্গিকগতভাবে, না নব নব চেতনা ও অভিজ্ঞতার সংগ্রহে।

আপনারা জানতে চেয়েছেন, আমার মতে কবিতা কোনো লক্ষ্যে এগোচ্ছে কি না। কবিতার একটিমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে কবিতা হয়ে ওঠা। এটাকে এগোনোও বলতে পারেন, উত্তরণও বলতে পারেন।

প্রশ্ন: আমাদের কবিতা-কর্মের বৃহৎ অংশ নৈরাশ্য, আক্ষেপ আর ব্যক্তিহৃদয়ের ব্যক্তিগত স্পন্দনে ভরাট বলে অনেকে মনে করেন। যদি এ রকম ধারণা করার স্বাভাবিক কারণ থাকে, তবে সর্বজনীন প্রেরণা আমাদের কবিতায় প্রবলভাবে না আসার কী কারণ থাকতে পারে?

শহীদ: নৈরাশ্য, আক্ষেপ, বেদনা, হতাশা—এগুলো তো সর্বজনীন। কেবলমাত্র আশাবাদিতা, শ্রেণিসংগ্রাম, দেশপ্রেম বা নিসর্গপ্রীতিই সর্বজনীন নয়।

কবিরা তাঁদের রচনায় কোন ধরনের ভাবনা-বেদনা এবং বোধ ও আবেগের প্রাধান্য দেবেন, সেটা যেমন কবির ব্যক্তিগত প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করবে, তেমনি ইতিহাসও অনেক দূর পর্যন্ত তার ইঙ্গিত দেবে। আমি যেহেতু মনে করি বিদ্রোহ, আক্ষেপ, নৈরাশ্য ইত্যাদিও সর্বমানুষের ব্যাপার, তাই আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশের কবিতায় ‘সর্বজনীন প্রেরণা’ নেই বলে আমি মনে করি না। কবিতায় ব্যক্তিগত হৃদয়ের স্পন্দনের অভাবই আজ সবচেয়ে বেশি প্রকট। কবিতা যেহেতু ব্যক্তি লেখেন, ব্যক্তিগত হৃৎস্পন্দন তাতে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ব্যক্তিগত হৃৎস্পন্দনে বিশ্বমানবের হৃৎস্পন্দনও থাকা চাই। কিন্তু অধিকাংশ কৃত্রিম (অনেক সময় অত্যন্ত সুলিখিত কবিতাও কৃত্রিম মনে হয়) ও ব্যর্থ কবিতার লক্ষণই হচ্ছে ‘সর্বজনীন প্রেরণা’ বা ‘আবেগে’ ঠাসা, ব্যক্তিগত অনুভূতির অভাবে মৃত। যেকোনো সৎ ও উত্তীর্ণ কবিতাই একাধারে ব্যক্তিগত অনুভূতি ও ‘সর্বজনীন’ আবেগের একটি অভিন্ন অস্তিত্ব। আমার মনে হয়, অধিকাংশ অকবি সর্বজনীন ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে লিখে থাকেন—এই যেমন আমি প্রকৃতি-প্রেমিক, গাছ ভালোবাসি, নদী ভালোবাসি, নারী ভালোবাসি, আমার দেশ সব দেশের সেরা ইত্যাদি, ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, এগুলো কবিতা হয় না।

প্রশ্ন: আজকের সাহিত্য-পাঠক, যাঁরা প্রচুরভাবে অত্যাধুনিক গল্প, উপন্যাস পড়েন, তাঁরাও ইদানীংকার কবিতার প্রতি বিমুখতা প্রদর্শন করেন, যদিও পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহৃত কবিতার প্রতি তাঁদের যথেষ্ট শ্রদ্ধা রয়েছে। এ ধরনের ধারণা পরিবর্তনের জন্য আজকের কবিদের কোনো কিছু করণীয় আছে কি?

শহীদ: যে পাঠককুল কবিতার প্রতি বিমুখ, তাঁরা শুধু ইদানীংকার কবিতা নয়, সর্বকালের কবিতার প্রতিই বিমুখ। তাঁরা কবিতার পাঠক নন। তাঁরা গল্পের পাঠক, উপন্যাসের পাঠক। কোনো বিষয়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করা ও সে বিষয়কে সম্ভোগ করা এক কথা নয়। যেমন ধরুন, বিশুদ্ধ গণিতকে আমি যুগপৎ শ্রদ্ধা ও ভয় করি, কিন্তু ও বিষয়ে আমার চর্চা নেই, চর্চার সাহস নেই এবং প্রবণতাও নেই। তেমনি স্কুল-কলেজে যেহেতু আমরা শিক্ষা লাভ করি, যে শিক্ষা আমাদের পরে চাকরিতে বহাল হতে সাহায্য করে অর্থাৎ দুটো অর্থকড়ির ব্যবস্থা করে দেয়, সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যা কিছু ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাকে আমরা ভয় ও শ্রদ্ধার চোখে দেখে থাকি। আপনারা জানেন, আমাদের মতো অনুন্নত বা (আরেকটু) নরম করে বললে, উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষার প্রায়োগিক মূল্য ছাড়া অন্য কিছু নেই। পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত কবিতার প্রতি যে শ্রদ্ধা আপনারা লক্ষ করেন, আমার ধারণায়, তার উৎসে কাব্যবোধ কাজ করে না, জনশ্রুতিই তার সহায় হয়ে থাকে। আমার বিশ্বাস, মানবেতিহাসের কোনো সময়ই ব্যাপকভাবে কবিতার পাঠক ছিল না। রাজরাজড়ার পৃষ্ঠপোষকতাই একসময় কবি ও কবিতাকে বাঁচিয়েছে। গণতন্ত্র, বুর্জোয়া সামাজিক বিপ্লব, গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি আমার ধারণায়, শিল্পের শত্রু। এগুলো শিল্পকে পণ্যে পরিণত করেছে অর্থাৎ অবয়বহীন ক্রেতা-সাধারণের মুখাপেক্ষী করেছে। কিন্তু জনতা চিরকালই উত্তেজনা ও কাহিনি-শিকারি, শিল্পের ভোক্তা নয়। প্রমাণ, আমাদের অপাঠ্য পুঁথিগুলো। প্রমাণ, ধ্রুপদি সংগীতের সঙ্গে সঙ্গে লোকসংগীতের বিস্তার। ধ্রুপদি সংগীতের শ্রোতার সংখ্যা চিরকালই লোকসংগীতের তুলনায় ঢের কম। ইদানীংকার বা অত্যাধুনিক কবিতার প্রচার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমার মতে কবিদের একমাত্র করণীয় কাজ হচ্ছে ভালো কবিতা লেখা, আরও ভালো কবিতা। তবে গণসংযোগ মাধ্যমের কর্তাব্যক্তিরা কবিতাকে যদি যথেষ্ট শ্রদ্ধার সঙ্গে শ্রোতাদের সামনে নিয়মিত উপস্থিত করেন, তাহলে হয়তো কিছুটা কাজ হবে। কবিতার পাঠক না বাড়লেও, কবিতার প্রতি শ্রদ্ধা বাড়বে। যেমন ধরুন, বিজ্ঞান না বুঝেও আমরা বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীকে শ্রদ্ধা করি।

প্রশ্ন: যেকোনো একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পাওয়ার মানে আমাদের কবিতাকর্মে নতুন কিছুর সংযোজন; এই পরিপ্রেক্ষিতে একজন নবীন কবির কাব্যচর্চার কোন বিশেষ পর্যায়ে পৌঁছালে কবিতার বই প্রকাশ করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?

শহীদ: যেকোনো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হওয়া মানেই আমাদের ‘কবিতাকর্মে নতুন কিছুর সংযোজন’ নয়, তাহলে তো সমস্যা চুকেই যেত। একজন নবীন কবি যখন যথার্থ নবীন কবিতা লেখা শুরু করবেন, তখনই তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করা ঠিক হবে। এ ব্যাপারে তাঁর সহায়ক হবে নিজের দেশের কবিতার আদি-অন্ত সম্পর্কে সচেতন ও পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান।

প্রশ্ন: শুধু কবিতাকে কেন্দ্র করে নিয়মিত কোনো সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করার কোনো যুক্তিময় প্রয়োজনীয়তা আছে কি? এ ব্যাপারে আপনার খোলাখুলি মন্তব্য চাই।

শহীদ: আছে বৈকি। কবিতা পত্রিকায়, প্রথমত, কবিতা সম্মানের সঙ্গে প্রকাশিত হয় (পাদপূরণের জন্য নয়), এবং দ্বিতীয়ত, কবি এ রকম স্বস্তি অনুভব করেন যে ‘আমার কবিতা কেবলমাত্র কাব্যপাঠকের হাতেই পৌঁছাবে, যাঁরা কবিতার পাঠক নন তাঁদের উদাসীন আঙুল দ্বারা স্পৃষ্ট হবে না।’

প্রশ্ন: আপনার কবিতার স্বধর্ম সম্পর্কে আপনার নিজস্ব উপলব্ধি জানালে পাঠক হিসেবে আমরা আনন্দিত হব।

শহীদ: আধুনিক মানুষের আশা-হতাশা, প্রেম-অপ্রেম, বিক্ষোভ-বিদ্রোহ আমার কবিতার উপজীব্য। আধুনিক মানুষ বলতে আমি সেই মানুষকেই বুঝি, যার মানস বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তসমূহ দ্বারা (সচেতন বা অবচেতনভাবে) আলোড়িত, প্রায়োগিক মূল্যবোধের শিকার। সেই মানুষের সমগ্র চৈতন্যই আমার রচনায় গ্রেপ্তার করতে চেয়েছি। আধুনিক মানুষ যেখানে সর্বমানুষের সঙ্গে যুক্ত, সেখানে এবং আধুনিক মানুষ যেখানে সর্বমানুষের সঙ্গে বিযুক্ত অর্থাৎ অনন্য সেখানেও আমি পৌঁছাতে চাই। হয়তো-বা আমার কবিতা (যদি সেগুলো কবিতা হয়ে থাকে) উপমাধর্মী কিছুটা বর্ণোজ্জ্বলও বটে। আমার কবিতার প্রবণতা আমি এখন পর্যন্ত শনাক্ত করতে পারিনি। আমি যদিও সচেতন কাব্যচর্চায় বিশ্বাসী, কিন্তু ওই বস্তু এখনো আমার দাসানুদাস হয়ে ওঠেনি। কবিতা লেখার ব্যাপারে আমি ঘোরতর অনাধুনিক, দৈবের ওপর নির্ভরশীল, নিরুপায়ভাবে ‘প্রেরণা’ নামক প্রাচীন ঘটনাটির (বর্তমানে অপাঙ্‌ক্তেয়) মুখাপেক্ষী। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যদিও স্বপ্নচালিত পথিকের মতোই অনুপ্রাণিত কবিকে ডরাতেন, আমি নিজেও প্রকাশ্যে এবং সাহিত্যিক আজ্ঞায় ‘প্রেরণা’ নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতে কসুর করি না, কিন্তু গোপনে মনের ভেতরে জানি, একলা ঘরে নিজের কাছে স্বীকার করি, ওই বস্তুর অভাব ঘটলে কলাকৌশলের শিখর স্পর্শ করলেও, ছন্দ ও মিল নিখুঁত হলেও, কবিতা কোনো দিনও কবিতা হয়ে উঠবে না।

প্রশ্ন: সমসাময়িক কবিদের কি একে অপরকে প্রতিযোগী না সহযোগী মনে করা উচিত? কবিতার মানোন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রসঙ্গে আপনার বক্তব্যের প্রয়োজন অনুভব করছি।

শহীদ: সমসাময়িক কবিরা একে অপরের প্রতিযোগীও বটে, সহযোগীও বটে। সুস্থ, কণ্টকবহুল ঈর্ষামুক্ত প্রতিযোগিতা সব সময় কাম্য। তরুণ কবিকে সেটা উৎসাহ জোগাবে, উদ্দীপনা দেবে। আবার পরস্পরের মধ্যে নিজেদের রচনা নিয়ে খোলামেলা সুহৃদতুল্য আলোচনা কখনো কখনো খুবই উপকারে আসবে। দুটোই চাই।

প্রশ্ন: দেশ, কাল, পাত্র অভেদে আপনার কি কোনো প্রিয়তম কবি আছেন? কে তিনি?

শহীদ: না, নেই। তবে ইদানীং দুজন কবি আমাকে পাগল করে দিচ্ছেন নতুন করে—জীবনানন্দ দাশ ও পাবলো নেরুদা। 

সংগ্রহ ও টীকা: মাসুদুজ্জামান

প্রথমেই তথ্যটি জানিয়ে রাখি, এই সাক্ষাৎকারটিই আজ অব্দি উদ্ধারকৃত কবি শহীদ কাদরীর প্রথম প্রকাশিত সাক্ষাৎকার। এত দিন পর্যন্ত জানা ছিল যে কবি বেলাল চৌধুরী গৃহীত একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারই তাঁর প্রথম প্রকাশিত সাক্ষাৎকার। ওই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল বেলাল চৌধুরীর লেখা একটা গদ্যের অংশ হিসেবে। ‘কবি-কবিতা-ঢাকা’ শিরোনামে সেই গদ্যটি প্রকাশিত হয়েছিল শাহাদাত চৌধুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক বিচিত্রায় (১৯৭৬)। কিন্তু এখানে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি এরও আগে সম্পূর্ণ একক সাক্ষাৎকার হিসেবে ১৯৭৪ সালে জালাল আহমেদ চৌধুরী সম্পাদিত কিংশুক নামের একটি কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। জালাল আহমেদ চৌধুরী এখন স্বনামখ্যাত ক্রিকেট কোচ। স্বাধীনতার পর তিনি কবি ও কবিতার ব্যাপারে বেশ উৎসাহী ছিলেন এবং ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে কিংশুক-এর প্রকাশনা শুরু করেন। ১৯৭৫ সালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত এর কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। শহীদ কাদরীর এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় কিংশুক-এর ১ম বর্ষ পঞ্চম-ষষ্ঠ ১৩৮১ যুগ্ম সংখ্যায়। অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে এটি প্রকাশিত হয়। সেই হিসেবে এটিই শহীদ কাদরীর প্রকাশিত প্রথম সাক্ষাৎকার। পত্রিকাটির পক্ষ থেকে কবির কাছে লিখিতভাবে শুধু তাঁর নিজের কবিতা আর সাধারণভাবে কবিতা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ১০টি প্রশ্ন করা হয়েছিল, কবিও সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন লিখিত আকারেই। ফলে সাক্ষাৎকার গ্রহীতা বা প্রশ্নকর্তার নাম নেই এখানে। ‘জনাব শহীদ কাদরীকে দশটি প্রশ্ন’ শিরোনামে এই সাক্ষাৎকারে বেশ গুছিয়ে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছিলেন শহীদ কাদরী। আর এই সাক্ষাৎকারের বড় গুরুত্ব মূলত এখানে যে এটি এখনো কোনো বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।