ব্যঙ্গ কবিতা

আবুল মনসুর আহমদ (৩ সেপ্টেম্বর ১৮৯৮—১৯ মার্চ ১৯৭৯)। ছবি: সংগৃহীত
আবুল মনসুর আহমদ (৩ সেপ্টেম্বর ১৮৯৮—১৯ মার্চ ১৯৭৯)। ছবি: সংগৃহীত
>৩ সেপ্টেম্বর ছিল আবুল মনসুর আহমেদের জন্মদিন

সংগ্রহ ও ভূমিকা: ইমরান মাহফুজ
উনিশ শতকের গোড়া থেকেই বাংলা সাহিত্যে রসরচনা শুরু। বাংলা সাহিত্যে এ ধারার শক্তিমান লেখক হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন অনেকেই। এঁদের মধ্যে ঈশ্বর গুপ্ত, প্রমথ চৌধুরী, পরশুরাম, শিবরাম চক্রবর্তী, পরিমল গোস্বামী, সৈয়দ মুজতবা আলী ও আবুল মনসুর আহমদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘ব্যঙ্গ কবিতা’ নামের এই নিবন্ধে রস বা ব্যঙ্গ কবিতাকে চমৎকারভাবে ব্যবচ্ছেদ করেছেন আবুল মনসুর আহমদ। হিউমার আর স্যাটায়ারের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে এই লেখায় তাঁর মত এমন যে: হিউমার ছাড়া স্যাটায়ার হতে পারে না। একই সঙ্গে ব্যঙ্গ কবিতার ইতিহাস ও স্বরূপ প্রসঙ্গটিও অল্প কথায় খোলাসা করেছেন তিনি। দুর্লভ এই নিবন্ধটি আমার হাতে আসে ২০১২ সালে। তখন কালের ধ্বনি পত্রিকার ‘আবুল মনসুর আহমদ সংখ্যা’র কাজ করছিলাম আমি। ‘ব্যঙ্গ কবিতা’ নামে লেখাটি প্রথমে আবুল মনসুর আহমদ লিখেছিলেন কথিকার জন্য। ১৯৫৯ সালে তা রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। এর এক বছর পর ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত সাহিত্য সংগ্রহ বইয়ে এটি প্রথম মুদ্রিত আকারে বের হয়। আবুল মনসুর আহমদের কোনো বইয়ে এখন পর্যন্ত সংকলিত না হলেও ব্যঙ্গ কবিতা বোঝার ক্ষেত্রে নিবন্ধটি খুবই প্রাসঙ্গিক। অগ্রন্থিত এ লেখায় সমকালীন বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।


ব্যঙ্গ কবিতা সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলে আগে বলতে হয় ব্যঙ্গটা কী? কোনো রকম সংজ্ঞা নির্দেশ করার চেষ্টা না করে এক কথায় বলা চলে এটা কৌতুক-রস। ব্যঙ্গ, রঙ্গ, রসিকতা, শ্লেষ, ঠাট্টা, বিদ্রূপ, ভাঁড়ামি, ফাজলামি—এ সবই কৌতুক-রসের অন্তর্ভুক্ত। ইংরেজিতে উইট, হিউমার, ল্যামপুন, স্যাটায়ার, প্যারোডি, আয়রনি, ক্যারিকেচার—সবই এই শ্রেণিভুক্ত। এসবের মধ্যে অল্পবিস্তর পার্থক্য নিশ্চয়ই আছে এবং সে পার্থক্য শুধু পরিমাণগত পার্থক্য নয়, দস্তুরমতো শ্রেণিগত পার্থক্য। তবু সব কটির প্রাণশক্তি হচ্ছে রস। রস ছাড়া রসিকতা হতে পারে না।

মানুষ স্বভাবতই রসিক। রসিকতাটাই আমার মতে পশু ও মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পার্থক্য। রসিকতা মানুষের অন্যতম জীবনীশক্তি—এ রস সব মানুষের মধ্যে আছে কারও প্রকাশ, কারও অপ্রকাশ—এই যা পার্থক্য। রসিকতার রসে রসাল না হলে মানবজীবন শুকনা কাঠ হয়ে যেত। এরই জন্যই রাজা-বাদশাহর দরবারে মাইনে করা ভাঁড়-মোসাহেব রাখা হতো। রাজনৈতিক গুরুগম্ভীর ও শুষ্ক কাজে ভারাক্রান্ত রাজদরবারে এই ভাঁড়েরাই ছিলেন আঁধার রাতের বিদ্যুৎ। রাজদরবারের নীরস পরিবেশকে এঁরাই পলকে পলকে করে তুলতেন সরস ও প্রাণবন্ত। গোপাল ভাঁড় ও মোল্লা দুপেয়াজো এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ঠিক এ কারণে সাহিত্য সৃষ্টির গোড়া থেকেই রঙ্গরস সাহিত্যের একটি উপাদান বলে স্বীকৃত হয়ে আসছে। গোড়াতেই এই রঙ্গরসের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল হাসির উদ্রেক।

তখন রঙ্গরসিকতা শুধু ব্যক্তির দোষত্রুটি ও অ্যাবনর্মালিটাকে কেন্দ্র করেই করা হতো। ক্রমেই এই রঙ্গরস সাবলাইমে উদ্দেশ্যমূলক হয়ে ওঠে এবং ব্যক্তিকে ডিঙিয়ে শ্রেণি বা জাতির দোষত্রুটি ও অ্যাবরর্মালিটিকে নিজের বিষয়বস্তু করে তোলে। এই স্তরে ওঠার পর রঙ্গ-কৌতুক হয়ে দাঁড়ায় ব্যঙ্গ-কৌতুক। উইট ও হিউমার উন্নত হয়ে দাঁড়ায় স্যাটায়ারে। তাই বলে রঙ্গ-কৌতুক ও উইট হিউমার যে উঠে গেছে তা নয়। তারা নিজ নিজ স্থানে চালিয়ে আনন্দদানের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কারকের কাজ করছে। স্যাটায়ার আসলে উপদেশ-সুগার-কোটেড কুইনাইন মাত্র। বিখ্যাত রস-সাহিত্যিক এডিসন বলেছেন, স্যাটায়ার থেকে হিউমার বাদ দিলে তা হয়ে দাঁড়াবে গির্জার সারমন, অর্থাৎ ধর্মীয় নসিহত। বস্তুত হিউমার ছাড়া স্যাটায়ার হতে পারে না। স্যাটায়ারে থাকবে বটে ত্রুটি-বিচ্যুতির গায়ে চিনি মাখানো চাবুক। কিন্তু তার পেছনে মহত্তর আদর্শের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত। তার আক্রমণের বিষয়বস্তু হবে দুর্বলেরা নয়, সবলেরা; ক্ষমতাহীনেরা নয়, ক্ষমতাশালীরা। কারণ দুর্বলের দোষ দোষই নয়, তার দোষে সমাজ বা জাতির কিছু আসে-যায় না। এ কারণেই স্যাটায়ারের বিষয়বস্তু প্রধানত শ্রেণি বা জাতি—ব্যক্তি নয়। ব্যক্তিকে আক্রমণ করলে সেটা হয়ে পড়বে ক্যারিকেচার, যদি না সে ব্যক্তি হন রিপ্রোজেনটেড। স্যাটায়ারের টার্গেট ব্যক্তিই হোক, আর জাতিই হোক, তার উদ্দেশ্য ছোটই হোক, আক্রমণটা হতে হবে বিদ্বেষ বা ‘ম্যালিস’ মুক্ত। আক্রোশ, বিদ্বেষ বা ম্যালিস থাকলে তা হিইমার হবে না। সুতরাং স্যাটায়ার হবে না যে রসিকতায় আক্রান্ত ব্যক্তি বা জাতি স্বয়ং হাসতে বাধ্য হবে—সেটাই হবে খাঁটি রসিকতা।

রসিকতা একটি আর্ট। বিষয়ী লোকেরা বরাবরই আর্টকে সময় ও শক্তির অপচয় মনে করে আসছেন। গুরুগম্ভীর গুরুজনেরাও রঙ্গ-ব্যঙ্গকে দুষণীয় ভেবে আসছেন। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপকে তাঁরা ছিদ্রান্বেষণ বা পরচর্চা আখ্যা দিয়েছেন। তাঁরা বলেন, লোকটার স্বভাবই হচ্ছে পরের দোষ ধরা, যেমন—মক্ষিকা ব্রণমিচ্ছন্তি।

কিন্তু দুনিয়ার ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, গুরুজনের এই নিন্দা অগ্রাহ্য করে যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপকে কাব্য, সাহিত্য ও শিল্পের অঙ্গ করে নিয়েছেন। প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যের হোমার, ফারসি সাহিত্যের ফেরদৌসি থেকে শুরু করে জার্মান গ্যেটে, শিলার, ফরাসি রুশো, ভলতেয়ার, ইংরেজ শেক্‌সপিয়ার, পোপ, সুইফট, ডিফো, বায়রন, মুর, মার্কটোয়েন এবং সর্বশেষে জর্জ বার্নার্ড শ প্রভৃতি কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার সবাই রঙ্গ-ব্যঙ্গকে তাঁদের শিল্পে উঁচু দরের আর্টের সম্মান দিয়েছেন। চিত্রকরেরাও এ ব্যাপারে পেছনে পড়ে নেই। কার্টুন সাহিত্য আজ খুব উন্নত সাহিত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানচ নামক কার্টুন ম্যাগাজিন আজ দুনিয়ায় খ্যাতি লাভ করেছে। মোট কথা, ব্যঙ্গ সাহিত্য আজ সভ্যজগতে এতটা সম্মান পেয়েছে যে অনেক মনীষী বলেছেন রুশো ভলতেয়ারের স্যাটায়ারের চাবুকই ফরাসি জাতিকে বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

আমাদের বাংলা সাহিত্যেও উনিশ শতকের গোড়া থেকেই রসরচনার প্রাচুর্য দেখা যায়। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নববাবু বিলাস, প্যারীচাঁদ মিত্র ওরফে টেকচাঁদ ঠাকুরের আলালের ঘরের দুলাল, কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার নকশা, বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের দপ্তর ও লোকরহস্য, মীর মশাররফ হোসেনের গাজী মিয়ার বস্তানী রাজশেখর বসুর গড্ডলিকা বাংলা গদ্যসাহিত্যে ব্যঙ্গ রচনার ক্রমোন্নত ধারা বজায় রেখেছে। এর পেছনে আমার আয়না ও ফুড কনফারেন্স-এর নামও বলতে পারেন।

কিন্তু আজকের আলোচনা শুধু ব্যঙ্গ কবিতা নিয়ে। ব্যঙ্গ কবিতার চর্চাও বাংলা সাহিত্যে উনিশ শতক থেকেই দানা বেঁধেছে। ঈশ্বর গুপ্ত, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলাম—সবাই কমবেশি ব্যঙ্গ কবিতা লিখেছেন। এর মধ্যে ইন্দ্রনাথের ভারত উদ্ধার উল্লেখযোগ্য ব্যঙ্গ কাব্যগ্রন্থ। বাংলা সাহিত্যের সমগ্র ব্যঙ্গ কবিতারাশির মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলাল ও নজরুল ইসলামের স্যাটায়ারই উচ্চাঙ্গের। রবীন্দ্রনাথের ‘হিং টিং ছট’ অর্থহীন শব্দালংকারবাদী পণ্ডিতদের বিরুদ্ধে সরস বিদ্রূপ। অথচ এতে ম্যালিস নেই। অনেকে বলেন বটে যে এটা চন্দ্রনাথ বসুর পাণ্ডিত্য-বিলাসিতাকে আক্রমণ করেই লেখা হয়েছিল। কিন্তু তাহলেও এতে ব্যক্তিগত আক্রমণের কোনো ছায়াও নেই। দ্বিজেন্দ্রলালের ব্যঙ্গ রবীন্দ্রনাথের চেয়ে উন্নত। ভাটপাড়ার নৈয়ায়িকদের বিরুদ্ধে লেখা দ্বিজেন্দ্রলালের ‘পাত্রাধার তৈল কি তৈলধারা পাত্র’, একটি নিটোল উচ্চাঙ্গের ব্যঙ্গ কবিতা। সমগ্র ইংরেজি সাহিত্যে এর জোড়া মেলা ভার। দ্বিজেন্দ্রলালের তীক্ষ্ণ কলমের মুখে বহু তীব্র ব্যঙ্গ কবিতা বেরিয়েছে। এসব ব্যঙ্গ কবিতার সংকলন হাসির গান বাংলা সাহিত্যের একটি অপূর্ব সম্পদ। এসব কবিতায় হিন্দু সমাজের সংস্কার ও রাজনৈতিক নেতাদের ভাঁড়ামিকে তীব্র ঝাঁজালো অথচ ম্যালিসমুক্ত আক্রমণ করা হয়েছে। দ্বিজেন্দ্রলালের পরে উল্লেখযোগ্য ব্যঙ্গ কবিতা লিখেছেন নজরুল ইসলাম। তাঁর চন্দ্রবিন্দু বইয়ে অনেক ভালো ব্যঙ্গ কবিতা স্থান পেয়েছে। তার মধ্যে ‘সিভিকগার্ড’, ‘শ্রীচরণ ভরসা’, ‘প্যাক্ট’ প্রভৃতি কবিতা সত্যিকারের মিছরির ছুরি। যেমনি তীব্র কশাঘাত, তেমনি হিউমার রসে রসাল।

সাধারণ ব্যঙ্গ কবিতা ছাড়া আরেক বিশেষ প্রকারের ব্যঙ্গ কবিতা আছে। এদের বলা হয় প্যারোডি। রবীন্দ্রনাথ এই শ্রেণির কবিতার নাম দিয়েছেন লালিকা। গুরুগম্ভীর বিষয়ে লেখা কোনো বিখ্যাত কবিতার ছন্দ ও ভাষার অনুকরণে হালকা বিষয়ে লেখা বিদ্রূপাত্মক কবিতাকে বলা হয় প্যারোডি। মাইকেলের ‘একাকিনী শোকাকুলা’, রবীন্দ্রনাথের ‘আমার মাথা নত করে’ ও ‘সে আসে ধীরে’, দ্বিজেন্দ্রলালের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ ও ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’, নজরুল ইসলামের ‘বল বীর’ ও ‘কার নিকুঞ্জে রাত কাটিয়ে’ প্রভৃতি বিখ্যাত কবিতার অতি চমৎকার হাস্যরসে ভরপুর প্যারোডি লোকমুখে শোনা যায়। এসব প্যারোডির মধ্যে শ্লীল ও অশ্লীল দুরকমের জিনিসই আছে বটে, কিন্তু সব কটিতেই অসাধারণ আর্টজ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। আমার লেখা ‘ছহি বড় তৈয়বনামা’ ও ‘ছহি বড় ওজার নামা’, সে-ও মোটামুটি প্যারোডি বলা চলে। বিখ্যাত ‘সোনাভান’-এর পুঁথিরই ওটা সংক্ষিপ্ত প্যারোডি।

অন্যান্য ভাষার সাহিত্যের মতো বাংলা সাহিত্যেও ব্যঙ্গ কবিতার বিশেষ মর্যাদা আছে। এ কথা সব ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে।