সমকালীন শিল্পকলার ভাষা

কান্দন জির িচত্রকর্ম ‘কনটেম্পরারি সোসাইটি ১৯৯৮’
কান্দন জির িচত্রকর্ম ‘কনটেম্পরারি সোসাইটি ১৯৯৮’

এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনী—দেশের এই একটি আয়োজনই এশিয়ার পরিধি ছাড়িয়ে ইউরোপ-লাতিন আমেরিকায়ও ঢুকে পড়েছে। কোথায় স্পেন, কোথায় আর্জেন্টিনা—সেখানকার শিল্পীদের কাজও এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীর দেয়ালে ঝুলছে। শুরু হয়েছিল ১৯৮১ সালে। দুই বছর পরপর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে প্রদর্শনীটি হয়ে আসছে। ৬৮টি দেশের শিল্পীদের অংশগ্রহণে শুরু হয়েছে এবার ১৮তম আসর। চলছে ১৮তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী। মাসব্যাপী প্রদর্শনীটি হচ্ছে একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার এক থেকে চতুর্থ তলা ভবনের হাফ ডজন গ্যালারিজুড়ে। এ কথা তর্কাতীতভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে চিত্রকলা প্রদর্শনীর এটিই সবচেয়ে বড় উৎসব এবং উৎসবটি হয়ে আসছে সরকারি ব্যবস্থাপনায়। এটি খুবই আশান্বিত করার মতো ঘটনা যে, বাংলাদেশের মতো এমন পিছিয়ে পড়া দেশেও আধুনিক চিত্রচর্চার পরিপ্রেক্ষিতে এই উৎসব ক্রমশ বিস্তৃতি পাচ্ছে। সে অর্থে বলা যায়, ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীটি চারুচর্চার দুনিয়ায় একটি জায়গা পেয়ে গেছে।

গত কয়েকবারের দ্বিবার্ষিক আসর দেখে বেশ কিছু প্রবণতা লক্ষিত হচ্ছে। দ্বিমাত্রিক ক্যানভাসে যে চিত্র রচিত হয়, সে তো হয়ই, হচ্ছেও, হবেও। চিত্রগুলো গ্যালারির দেয়ালে ঝুলবে। ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্য প্রদর্শনী হয়, হচ্ছে, হবেও। কিন্তু গত কয়েকবারের দ্বিবার্ষিক আসর থেকে আমরা দেখছি স্থাপনাশিল্পের (ইনস্টলেশন আর্ট) একটা বিকাশ ঘটছে। বিকাশ ঘটছে ভিডিও আর্টের। স্থাপনাশিল্প প্রচলিত ক্যানভাস ধারণাকে এড়িয়ে গিয়ে বিকশিত হচ্ছে। কারণ হয়তো এই যে, এটা অনেকটা পরিবেশ-সংক্রান্ত শিল্পকলার দাবি মিটিয়ে দিচ্ছে। এবং ভিডিও আর্টের মধ্যে মিশ্র হয়ে দর্শককে জড়িয়ে নিতে যুক্ত হচ্ছে শব্দ, সংগীত, এমনকি সবাক চলচ্চিত্রের মতো সংলাপও। এর ফলে চারুকলা প্রদর্শনীর প্রচলিত ধারণাটি ভেঙে যাচ্ছে, ভেঙে গেছে। হচ্ছে নানা রকম নিরীক্ষা।

সালমা জাকিয়া বৃষ্টির স্থাপনা িশল্প ‘দ্য সুপার হিউম্যান সিনড্রোম’
সালমা জাকিয়া বৃষ্টির স্থাপনা িশল্প ‘দ্য সুপার হিউম্যান সিনড্রোম’

নিরীক্ষাই নবতর আর্ট। নিরীক্ষা করতে করতে শিল্পী একটা স্তরে পৌঁছে থিতু হয়ে ওঠেন। তখন নিরীক্ষা করে তরুণ শিল্পীর দল, কেননা নিরন্তর নিরীক্ষার ভেতর দিয়েই জীবন ও শিল্প নতুন দিনের সংকট ও সম্ভাবনাকে মোকাবিলা করে। আমরা দেখি, শিল্পকলা জীবনের মতোই প্রতিনিয়ত বদলে বদলে যাচ্ছে। পরিবেশ প্রতিনিয়ত বদলে বদলে যাচ্ছে। মানুষ বদলে যাচ্ছে। মানুষের ভাষা বদলে যাচ্ছে। মানুষ কথা বলতে চাইছে নতুন ভাষায়। যদিও সমস্ত বদলের মধ্যেও সনাতনের শিকড়-বাকড় প্রোথিত থেকেই যায়। তাই বদলপ্রয়াসী শিল্পকলার শিকড়েও থাকে রূপসনাতন, থাকে মানবতার বিপর্যয়ে হাহাকার, থাকে বিরূপ রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি শৈল্পিক কটাক্ষ, থাকে শ্রেয়তর অভিপ্রায়। দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর গ্যালারিগুলো একনজর চোখ বুলিয়ে একটা সাদামাটা সমীকরণে পৌঁছানো যায়: এখনকার এই শিল্পকলা প্রদর্শনী শুধু দর্শক মনোরঞ্জনই আর নয়, দর্শকের সঙ্গে শিল্পীর একটি রাজনৈতিক বোঝাপড়াও বটে। যেমন চারদিকে যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধে নিহত, আহত সৈনিকেরা কিংবা এককথায় মানুষ, ক্ষতবিক্ষত হয়ে তারা ক্যানভাসে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। প্রাকৃতিক যুগ পেরিয়ে এসে মানুষ যে ক্রমশ যন্ত্রযুগের অধীনে নিজেদের ন্যস্ত করছে, ফলে প্রাণের সঙ্গে সংঘটিত ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সংঘর্ষহেতু অস্থিরতা দৃশ্যমান হচ্ছে ছবিতে, শিল্পে। সুকুমারকলার সেই দিন আর নেই। ছবি এখন আর শুধু ক্যানভাসেই নিহিত নয়। বড় পরিসরের এশীয় চারুকলার দর্শক হতে গিয়ে বারবার পার্শ্ববর্তী দর্শকের স্বগতোক্তি কিংবা যেন কৈফিয়ত শোনা যায়, ‘ভাষা বুঝতে পারছি না’।

ছবির ভাষা বদলে যাচ্ছে। মানুষের ভাষা বদলে যাচ্ছে। কেউ একজন মুখে যা বলল, অপরজন তা যতটুকু বুঝতে পারল বা বুঝতে পারা দেখাল, মনে মনে সে কি বুঝে নিয়েছে? কিংবা প্রথমজনের বলাটা কতখানি সত্য হয়ে থাকতে পারছে—কেউই আমরা তা পরিষ্কার বলতে পারব না—এটা এমন এক সময়। এই সময়ের তরিতে বসে শিল্পীও যাচ্ছেন নদীর ওপারে, তিনি তাঁর আরাধ্যে কীভাবে সময়কে ধরছেন—হতে পারে সেটাই প্রকাশিত দেয়ালে দেয়ালে, চিত্রশালা ভবনের বিস্তৃত পরিসরে। এককথায় যন্ত্রযুগের মানুষের মুখ ধরা পড়ছে শিল্পকলায়। তার ভাষা মানে যন্ত্রের ভাষা মানুষ বুঝতে চাইছে কিংবা যন্ত্রের ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে মানুষের ভাষা, স্বপ্ন, আশা-ভালোবাসা, বেঁচে থাকার লড়াই বা ইত্যকার জীবনপ্রবাহ। ফলে ফিলিস্তিনি শিল্পীটি তাঁর ক্যানভাসে ফটোগ্রাফিক ইমেজে দেখাচ্ছেন, বিস্তৃত জমিনে মাটি থেকে আকাশ বরাবর উঠে গেছে দীর্ঘ উচ্চ এক দেয়াল, এক লোক সেই দেয়াল বেয়ে উঠছে মাথার ওপরের আকাশের দিকে। তার গায়ে যে পোশাক-আশাক, তা সীমান্তদেয়ালের অসংখ্য তারকাঁটা চিহ্নিত। সনাতনি রংতুলি-ক্যানভাসে নয়, একটা ফটোগ্রাফিক ইমেজে প্রকাশিত। আবার সৈয়দ মোহাম্মদ জাকিরের করা ভিডিওচিত্রে দৃশ্যমান ঢাকা কমলাপুর রেলস্টেশনের একাংশ, যেখানে চরিত্রটি স্টেশনের সিগন্যাল পিলার বেয়ে পিলারের মাথায় উঠে বসে, স্টেশনে প্লাটফর্মে ঘোরাফেরা করা লোকেরা তা দেখতে থাকে, ট্রেন আসে ট্রেন যায়। এই ভিডিও দৃশ্যটি অপরাপর ভিডিও আর্টের মতোই প্রজেক্টর মেশিনে দৃশ্যায়িত। একবার এই দৃশ্যকলার সামনে দাঁড়ালে পুরো কার্যক্রম পর্যন্ত না দেখে সরে যাওয়া মুশকিল। এই দৃশ্যেও, দর্শক হিসেবেও শোনা গেছে, ‘ভাষা বোঝা যায় না।’

আতিয়া ইসলাম এনির ছবি ‘নান সেল ব্লো দ্য সাইরেন বিফোর ডেস্ট্রাকশন’ দেখছেন একজন দর্শক। ছবি: সাইফুল ইসলাম
আতিয়া ইসলাম এনির ছবি ‘নান সেল ব্লো দ্য সাইরেন বিফোর ডেস্ট্রাকশন’ দেখছেন একজন দর্শক। ছবি: সাইফুল ইসলাম

আবার প্রথাগত ক্যানভাসে প্রথাগত ব্রাশিংয়ের পাশাপাশি ক্যানভাসও দিন দিন হয়ে উঠছে নিত্যনতুন নিরীক্ষার পটভূমি। ভাস্কর্যেও তৈরি হচ্ছে নানা রকম নিরীক্ষা। স্থাপনাশিল্পেও তৈরি হচ্ছে নানা রকম ভঙ্গি। এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনী দেখতে দেখতে এ কথাও ভাবা যায় যে সমকালীন মানুষের জীবনযন্ত্রণা, অমীমাংসার দগ্ধ ছবি যে শিল্পীরা এঁকেছেন কিংবা মনের মাধুরী মিশিয়ে যে সৌন্দর্য রচেছেন, তার সঙ্গে গ্যালারিতে ঢুকে পড়া বাংলাদেশের সাধারণ দর্শকের যে স্বাভাবিক দূরত্ব, তা কি কোনো বিবেচ্যই নয়?

‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই’ বলার মধ্যে যে ঔপনিবেশিক গরিমা নিহিত, শিল্পকলা নিজেও গণমানুষের পাশে থাকার কথা বলে কতিপয় অভিজাতের কৃপাপ্রার্থী নয়? সব সময়ই? এই অমীমাংসার ভেতর থেকেই কি তৈরি হয় তথাগত ব্যর্থতা, ‘ভাষা বুঝতে পারছি না!’ যদিও কেউ বুঝেছে কি না, কে কী জানল, তা জানাটা শিল্পীর প্রত্যক্ষ কাজ হতে পারে না। রসকলা অনুভবের ভেতর দিয়ে ধরার বিষয়। বাজারি ফর্দের হিসাব মেলানো নয়। সংগত কারণেই শিল্পী ও দর্শককে একধরনের এপাড়া-ওপাড়ার বাসিন্দা মনে হয়।

এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীতে এশিয়ার বাইরে ইউরোপ ও লাতিনের কাজ দেখা যাচ্ছে। সব মিলে ৬৮টি দেশের শিল্পী এই প্রদর্শনীতে তাঁদের কাজ মেলে ধরেছেন। এতে করে সমকালীন ভিয়েতনামি শিল্পীর পাশাপাশি স্পেনীয় শিল্পীর কাজ দেখা যাচ্ছে। চীন-জাপানের শিল্পীদের পাশাপাশি ভারত কিংবা ইরানের কাজ দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ প্রদর্শনীর আয়োজক হওয়ায় অবশ্যই এককভাবে বাংলাদেশের শিল্পীদের কাজের পরিমাণগত প্রাধান্য বেশি। এতে করে একটা তুলনামূলক বিচারের সুযোগ সাদামাটাভাবেই দর্শকের সামনে চলে আসে। দেশে-দেশে, সমাজ-সংসারে শিল্পীতে-শিল্পীতে চিন্তার ঐক্য-অনৈক্য, সৌন্দর্যের ভেদরেখা ধরা পড়ে। আলাদা আলাদা ঐতিহ্য বৈশিষ্ট্য উঠে আসে। এক সংস্কৃতির মানুষ অন্য সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে মিলিত হতে পারে। বহু বৈচিত্র্যের মানুষের মেলবন্ধন তৈরি হয়। মানবিকতার বিকাশ লাভ করে। বহু বিচিত্র সংস্কৃতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যেতে হয় দর্শককে। এ ধরনের প্রদর্শনী শিল্পকলার দর্শককে সমৃদ্ধ করার সুযোগ করে দেয়।

ফিলিস্তিনের মুন্তাহের আল জাবেরির িশল্পকর্ম ‘এলিভেশন–১৫’
ফিলিস্তিনের মুন্তাহের আল জাবেরির িশল্পকর্ম ‘এলিভেশন–১৫’

বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যে দেশের সব ছেলেমেয়ে স্কুলে যায় পড়াশোনা শেষ করে একটি চাকরি পেয়ে জীবন কাটানোর আশায়। জীবন বলতে দাম্পত্য জীবন শুরু করে, সন্তান উৎপাদন করে, বাচ্চাদের বড় করে তাদেরও বিয়ে দিয়ে নিজেরা মরে যাওয়া—এই হলো চক্র। এ রকম একটি দেশে শিল্পকলার জন্য কতখানি ছাড় দেওয়া সম্ভব, কত বেশি নিরীক্ষা করা সম্ভব—সে প্রশ্ন তো থাকেই। প্রশ্ন থাকুক প্রশ্নের মতো। এটাই সত্য যে বাংলাদেশ যত দরিদ্রই হোক, বাংলাদেশই এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীর উদ্যোক্তা ও আয়োজক। ৩৬ বছর ধরে এই প্রদর্শনীটি সক্রিয় আছে; এবং দিন দিন এশিয়ার বাইরেও এর পরিধি বাড়ছে। বাড়ছে শিল্পী, দর্শকও। বাড়তে বাড়তেই যে ‘ভাষা বোঝা যায় না’ সেই ভাষাও বোঝা যাবে একদিন। সে সময়ও হয়তো তখনকার তরুণদের ‘ভাষা বোঝা যাবে না’। না গেলেই বা কী? এ তো মিথ্যা নয় যে শিল্পীরা সমকাল থেকে এগিয়ে চিন্তা করেন, তার পরিপ্রেক্ষিত সাধারণের সীমানায় সহজে ধরা পড়বে না। আবার একদিন ধরাও পড়বে। জীবদ্দশার সুলতানের চেয়ে প্রয়াণের পর সুলতান অধিক মূল্যায়িত। সবকালে, সব দেশেই। ডাচ শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যানগঘকে আমাদের মনে পড়ে। আমরা বুঝতে পারি, আমাদের মা-খালারা সেলাই কর্মে নিজের মনের যে দুঃখ অন্তরে লুকিয়ে রেখে সুচ-সুতোর প্রতিটি ফোঁড়ে-ফোঁড়ে কাঁথা সেলাই করেছেন, রুমাল সেলাই করেছেন, টেবিল ক্লথে ছবি এঁকেছেন, তা-ও এক সুনিপুণ শিল্পকলা। মা-খালাদের আমরা শিল্পী বলেছি কখনো? জীবন পুড়িয়ে-ক্ষয়ে সৃজিত মা-খালাদের শিল্পকর্মের ‘ভাষা বোঝা যায়’। উপনিবেশের দাস হয়ে আমরা এর মূল্যায়ন করতে শিখিনি। মা-খালারা তো আর প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পী নয়, এই জন্য?

প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পকলার জয় হলে হোক, অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পকলারও জয় হোক।