হিরোশিমা-নাগাসাকি ট্রাজেডির আদ্যন্ত

পারমাণবিক বোমা িবস্ফোরণের পর হিরোশিমা
পারমাণবিক বোমা িবস্ফোরণের পর হিরোশিমা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায়ে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর দুটির ওপর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের আণবিক বোমা হামলা, তাৎক্ষণিকভাবে শহর দুটির শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে দেড় লাখ মানুষের মৃত্যু, ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও আণবিক বিক্রিয়াজনিত সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ার বিবরণ তুলে ধরে বিক্ষিপ্তভাবে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখা হলেও অন্তত বাংলা ভাষায় এ-সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ কোনো বই ছিল না। এই প্রেক্ষাপটে জাপান প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদ মনজুরুল হকের লেখা হিরোশিমা নাগাসাকির কথা সত্যিকার অর্থেই একটি তাৎপর্যপূর্ণ বই হয়ে উঠেছে।

একজন প্রকৃত গবেষকের মতোই লেখক হিরোশিমা ও নাগাসাকি ট্রাজেডির আদ্যন্ত তুলে ধরেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, লেখক মনজুরুল হক এ বইয়ের কোথাও একপেশে দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয় নেননি। বইয়ের সুলিখিত ভূমিকা মারফত যখন তিনি বলেন, বিংশ শতাব্দীর তিনের দশকের শুরু থেকে পরবর্তী পনেরোটি বছর এশিয়াজুড়ে জাপানের ভূমিকা ছিল খুবই নিন্দাজনক, তখন বুঝে নিতে কষ্ট হয় না যে লেখক সমস্যার গোড়ায় হাত দিয়েছেন। জাপানের সেই কথিত ‘নিন্দাজনক’ ভূমিকার কথা তুলে ধরতে গিয়ে লেখক আমাদের সোজাসুজি জানাচ্ছেন, জাপান অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আধুনিকতার পথে যাত্রা শুরু করে। এই যাত্রা শুরু করার ভেতর দিয়ে অর্জিত দ্রুত সাফল্য দেশটির সেই সময়কার নেতাদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন ঘটায়। পাশ্চাত্যের সমপর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার ভাবনা থেকে তাদের মনে পরদেশ দখল করে উপনিবেশ স্থাপনের যে আকাঙ্ক্ষার উত্থান, তা-ই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দেশটিকে এশিয়ার মূল ভূখণ্ডের দিকে আগ্রাসী দৃষ্টি নিক্ষেপে প্রবলভাবে প্ররোচিত করে। বিশৃঙ্খল চীন দেশ হয় জাপানের প্রথম লক্ষ্যবস্তু। এটাই জাপানকে এক সর্বনাশা পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই লক্ষ্য থেকেই জাপানকে ফ্যাসিস্ট জার্মানির সহযোগী করে তোলে।

মনজুরুল হক এই ইতিহাসটুকু তুলে ধরার পরপরই জানাচ্ছেন, জাপানের এই ঔপনিবেশিক আকাঙ্ক্ষা এবং তার বাস্তবায়নে এশিয়াজুড়ে দেশটির বলদর্পী অভিযান বা তার তৎপরতার সঙ্গে হিরোশিমা-নাগাসাকির ট্র্যাজিডিকে মিলিয়ে ফেলার কোনো অবকাশ নেই। তিনি এ–ও বলছেন, সেটা যৌক্তিকও হবে না। যদিও পাশ্চাত্যের অনেক লেখক-সাংবাদিক, এমন কী অনেক গবেষকও এই অযৌক্তিক কাজটিই করে থাকেন। মনজুরুলের বিশ্লেষণ পরিষ্কার, হিরোশিমা-নাগাসাকির আণবিক ধ্বংসযজ্ঞ মানবতার আত্মবিধ্বংসী প্রবণতাকেই অনেক পরিষ্কারভাবে মানবজাতির সামনে তুলে ধরেছে। ধ্বংসের খেলায় আমরা কতটা পারদর্শী, প্রথমবারের মতো ইতিহাস তা প্রত্যক্ষ করেছে। তিনি বলেছেন, যুক্তি-প্রমাণ সহযোগে, এই আণবিক বোমা হামলা যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দুর্বল জাপানকে অচিরেই নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। এশিয়ায় নতুন এক যুগের সূচনা হয়। কিন্তু হিরোশিমা ও নাগাসাকির ওপর আণবিক হামলার কি কোনো প্রয়োজন ছিল? প্রশ্ন তুলেছেন লেখক এবং জবাবে তিনিই আবার বলছেন, যে শহর দুটির নাগরিকদের ওপর আণবিক বোমা হামলা করা হয়েছে, তারা যুদ্ধ পরিকল্পনার সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত ছিল না। অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের ভেতর দিয়ে কাটছিল তাদের দিন। অথচ তাদেরই চরম মূল্য দিতে হয়েছে।

লেখক এই বোমা হামলার পেছনে আমেরিকার কূটনৈতিক কৌশলের স্বরূপটিকেও তুলে ধরেছেন প্রায় বিস্তারিত বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে। শুধু তাই নয়, তিনি হিরোশিমা ও নাগাসাকি ট্র্যাজিডির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া এবং এখনো বেঁচে থাকা সেসব নাগরিকের যে সরেজমিন সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তুলে ধরেছেন এই বইয়ে তার বিবরণ। শহর দুটির স্মৃতি রক্ষায় সেখানকার নাগরিকেরা এখনো যে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন, তারও বিবরণ তুলে ধরেছেন তিনি আন্তরিকভাবে।

মোট ১৮টি অধ্যায়ে বিভক্ত এ বইয়ের পাঠ হিরোশিমা ও নাগাসাকি ট্র্যাজিডিকে চোখের সামনে যেমন জীবন্ত করে তোলে, তেমনি আমাদের এই ভাবনারও সঙ্গী করে, দুটি শহরের ওপর আণবিক বোমা হামলার পরিণতি যদি এই হয়, তাহলে ভবিষ্যতে পৃথিবীর কোনো প্রান্তে তার চেয়ে বহুগুণে শক্তিশালী পারমাণবিক বোমা হামলা হলে তার পরিণতি কতটা ভয়াবহ হবে!

মনজুরুল হকের এ বই বহুল পঠিত হোক, এই কামনা করি।



হিরোশিমা নাগাসাকির কথা

মনজুরুল হক

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: মার্চ ২০১৮, ১৪৪ পৃষ্ঠা, দাম: ২৮০ টাকা।