অপ্রকাশিত প্রেমপত্র

[লেখালেখিতে ভীষণ মার খেয়ে জান্নাতুল মাওয়া নিশির মতো আমিও যখন সুইসাইডাল হয়ে উঠি, কবি সাহেব বললেন, এটাই তোমার সুযোগ, তাড়াতাড়ি সম্পাদক হয়ে যাও।

আমার মেধা এবার সম্পাদনার দিকে ঘুরিয়ে দিলাম। বিভিন্ন জাতের সেলিব্রিটির চিঠিপত্র সম্পাদনা করে বাজারে নিজের টাকায় গোটা তিনেক বই ছেপে অকাতরে সেই বই (সামনের প্রচ্ছদে পত্রলেখকের ছবি আর পেছনের প্রচ্ছদে আমার গালে হাত দেওয়া ভাবুক টাইপের ছবিসহ) বিলিয়ে কিছুটা নামধাম করেছি, মননশীল সাহিত্যে দেশের দু-একটি বড় পুরস্কার পাব পাব করছি। সেই কবি সাহেবের তিনটি প্রেমপত্র হস্তগত করে একটি ভূমিকাসহ ঈদসংখ্যা রূপান্তর-এ দিয়েছি। তিনটি চিঠিই প্রয়াত শাফকাত হাশিমের লেখা। নিশি ছাড়া প্রায় সবাই তাঁকে কবি সাহেব বলেন, তাঁর স্ত্রী নূরজাহান হাশিমও; আমিও তা-ই বলি।

এটা সত্য, সেলিব্রিটিদের যে চিঠিপত্র আমার বইয়ে ঠাঁই পেয়েছে, সেগুলোর অন্তত গোটা দশেক আমার নিজেরই লেখা। সম্পাদক হলেও লেখক হওয়ার বাসনা তো আর জলাঞ্জলি দিইনি, তাই এসব করি।

শাফকাত হাশিমের বেলায় কি তা করা ঠিক হবে? ধেৎ কত কিছুই তো হয়, পকেটে মাল কিংবা বড় সরকারি চেয়ার থাকলে আত্মজীবনীও ফরমায়েশ দিয়ে লেখানো যায়। প্রেতলেখক হিসেবে আমি একজন প্রতিমন্ত্রীর আত্মজীবনী রচনা কেবল শেষ করেছি, একজন পদস্থ সাহিত্যিককে তাঁর স্মৃতিকথা লিখে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছি।

সেই জান্নাতুল মাওয়া নিশি আমাকে মূল চিঠি দেখিয়েছেন, ফটোকপি করার সুযোগ দিয়েছেন এবং প্রকাশের অনুমতি দিয়েছেন। আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।]

প্রথম চিঠি

নিশি সুকল্যাণীয়েষু,

তোমার চিঠি পেয়েছি কি না, অবশ্যই তা লিখে জানাতে হবে, এটাই তোমার দাবি।

চিঠি অবশ্যই পেয়েছি, নতুবা ঠিকানা পেলাম কেমন করে? আমার জবাব না পেলে তুমি অবশ্যই এটা ভাবতে না যে আমি তোমাকে উপেক্ষা করছি। ভাবতে ডাক বিভাগ তোমার চিঠি হারিয়ে ফেলেছে। তারপর তুমি আমাকে আবার লিখতে। এবারও জবাব না পেলে ভাবতে ঠিকানায় একটা গণ্ডগোল নিশ্চয়ই আছে। তৃতীয়বার লিখে যখন জবাবের অপেক্ষায় থাকতে, অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলে ভাবতে, মনভোলা কবি কিনা, হয়তো তোমার কথা ভুলেই গেছি। তারপর আমাকে চিঠি লেখা বন্ধ করে দিতে। দান দান তিন দান। ব্যস।

কিন্তু তা হওয়ার নয়। কারণ, তুমি যে নিশি, তুমি অন্য কেউ নও। তোমার চিঠি ডাকপিয়নের পাঠ্য নয়, অন্য কোথাও হারানোর নয়। আমার কাছে অবশ্যই পৌঁছেছে।

প্রকাশকের জোর দাবি, একুশের বইমেলায় অন্তত শুক্রবারগুলোতে বিকেল-সন্ধ্যায় ঘণ্টা দুয়েক স্টলে বসবেন। আপনার কারণে অন্তত এক শ বই বেশি বিক্রি হবে।

আমি বলি, আমি কি হুমায়ূন আহমেদ নাকি?

আমি মেনে নিই। মেলার দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শুক্রবার এবং মেলার শেষ দিন স্টলে বসব।

তুমি নিজেই তো দেখলে ছেলেমেয়েরা বই হাতে নিয়ে অটোগ্রাফের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। কাকে অটোগ্রাফ দিচ্ছি আমি, চোখ তুলে দেখার সময়ও পাই না।

কিন্তু তুমি যখন বইটা বাড়িয়ে দিলে, আমি নিশ্চয়ই একটা সুগন্ধ পেয়েছি—নতুবা চোখ তুলে কেন তাকালাম।

তুমি বললে, আমার নাম নিশি।

আমি বইয়ের খোলা সাদা পাতাটিতে সই করতে যাচ্ছি, কিন্তু কলম সরছে না। আমি আবিষ্কার করি, তোমার ঘ্রাণ আমার শরীরে একধরনের কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। আরও একবার তোমাকে দেখার জন্য আমি চোখ তুলতে চেষ্টা করি। কিন্তু হঠাৎ চোখের পাতা দুর্বার হয়ে ওঠে, চোখ তুলতে পারি না। আমার শরীর ঘামতে শুরু করে। একটি পার্থিব বিষয়ই তখন মনে জাগে, আমার কি হার্ট অ্যাটাক হতে যাচ্ছে?

সই করার আগে আমি কিছু লিখতে চাই, কিন্তু নিজস্ব কোনো পঙ্‌ক্তি আমার মনে আসছে না। আমি বুড়ো রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে একটি পঙ্‌ক্তি ধার নিই এবং দেখি, কলম চলতে শুরু করেছে। কলমই লেখে: নিশিদিন বসে আছি শুধু পথপানে চেয়ে—তারপর পুরো নামটাই লিখি—শাফকাত হাশিম। আমি তোমার দিকে আর তাকাইনি। অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য লাইন ধরে আরও কজন দাঁড়িয়ে।

বুকস্টলের একজন সেলসম্যান তোমার ওপর রুষ্ট হয়ে থাকতে পারে। তুমি যখন ফিরে যাচ্ছ, সে আমাকে শুনিয়ে বলল, শালার মাইয়া মানুষ! বেহুদা বেশি সময় নিল, এতক্ষণে দশটা বইতে সই করতে পারতেন।

কিন্তু আমি তাকে কেমন করে বলি, দেরি তুমি করোনি, করেছি আমি। কারণ, আমি তখন নিশি-পাওয়া মানুষ। এমন মানুষের নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।

তুমি নিজের সম্পর্কে কয়েকটি কথা লিখেছ: তোমাদের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। তোমার হাজব্যান্ড (তার নাম, পেশা, বয়স কিছুই উল্লেখ করোনি)—তুমি লিখেছ, আনকালচার্ড, খাসপিশাচ এবং ইন্ডিফারেন্ট। তুমি সুইসাইডাল হয়ে উঠেছ, ব্রেকআপই করতে হবে।

বিলেতের একটি পত্রিকায় ‘এগানি আন্টি’ এ ধরনের সমস্যার সুন্দর জবাব ও সমাধান দিয়ে থাকেন। আমার কয়েকটি অকাব্যিক জবাব ও সমাধান তুমি সাময়িকভাবে মেনে নিলে আমার ভালো লাগবে। আমি এটাও জানি, তুমি চাইবে আমার ভালো লাগুক।

ক. ব্রেকআপ অবশ্যই করবে না। সেকেন্ড হাজব্যান্ড আরও খারাপ হলে আফসোস করবে—আগেরটাই ভালো ছিল।

খ. স্ত্রী সুন্দরী হলে স্বামীকে তো সন্দেহবাতিক হতেই হয়। তোমাকে কেয়ার করে বলেই সন্দেহ করে। প্রতিটি নতুন নতুন সন্দেহে ভিন্ন ভিন্ন ঢঙে সে তোমাকে বলছে: আই লাভ ইউ, জান।

গ. তুমি বললে, আনকালচার্ড। ঠিক বলোনি। সত্যিটা হচ্ছে, সে ভিন্ন ঘরানার কালচার্ড, তোমার ঘরানার নয়।

ঘ. সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না—এটাই তো স্বাভাবিক। তুমি যখন জীবনানন্দ পড়বে, তোমার হাজব্যান্ড দেখবে রেসলিং। দুটি পেপারওয়েট, দুটি সাইকেলের চাকা, কাঁটাচামচ ও ছুরি, ইট ও পাথর—এদের সম্পর্ক নিয়ে কেউ তো টুঁ শব্দটিও করে না। কিন্তু তোমরা দুজনই যে মানুষ। সত্যিকারের দুজন মানুষের সম্পর্ক খারাপ হতেই হবে।

ঙ. সুইসাইড? অবশ্যই করবে। আমাকে বলে ভালো করেছ। তোমারটা যে সুইসাইড, হত্যাকাণ্ড নয়, এটা বলার মতো একজন সাক্ষী তো হলো। আমার যেহেতু কিছু নামডাক আছে, কোর্ট আমার সাক্ষ্য গ্রাহ্য করবে।

তবে সুইসাইড করার আগে তোমাকে যে আমার সঙ্গে অবশ্যই দেখা করতে হবে। তোমাকে প্রথম এবং শেষ বিদায়ী আলিঙ্গন করব।

এবার আমার সমস্যার সমাধান দাও।

তোমার বইয়ে অটোগ্রাফ দিতে গিয়ে আমি হঠাৎ ফ্রিজড হয়ে গেলাম কেন? তখন সুরসহ একটি পঙ্‌ক্তি আমার মাথার ভেতর ঢুকে যায়: ‘নিশিদিন বসে আছি শুধু পথপানে চেয়ে’—কেবল এটুকুই। আমি এই সুরের ঘোর থেকে বেরোতে পারছি না। কিন্তু বেরোতে চাই।

কেমন করে? তুমি জানো?

নিত্য শুভকামনায়

শাফকাত।

দ্বিতীয় চিঠি

নিশি,

অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপিটি সমাপ্ত হয়েছে। এখন ছাপাখানায়। উৎসর্গ তোমাকেই করেছি। উৎসর্গপাতায় বুড়োর একটি গান বসিয়ে দিয়েছি। আমার কাব্যবিনাশী স্ত্রী এর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝবে না। তুমি তোমাকে আবিষ্কার করতে পারবে:

নিশি না পোহাতে জীবন-প্রদীপ

                          জ্বালাইয়া যাও প্রিয়া,

তোমার অনল দিয়া।।

কবে যাবে তুমি সমুখের পথে দীপ্ত শিখাটি বাহি

আছি তাই পথ চাহি।

পুড়িবে বলিয়া রয়েছে আশায় আমার নীরব হিয়া

আপন আঁধার নিয়া।।

আমার এই নিশিঘোর কখনো কাটার নয়।

আমার আলিঙ্গনে তোমাকে বেঁধে তোমার আত্মহননের ইচ্ছেটাকে যখন আরও উসকে দিই, তুমি এলিয়ে পড়লে আমার ওপর।

তারপর কত কিছু যে ঘটে গেল।

তুমি বললে, ডেঞ্জার পিরিয়ড চলছে। যদি একটা বাবু হয়ে যায়।

আমি বললাম, বাবুটা বেরিয়ে আসুক। যখন হাঁটতে শিখবে, তখন তুমি সুইসাইড কোরো।

তুমি বোকা মেয়ের মতো হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলে। তোমার বাইশ আর আমার চৌষট্টি। ব্যবধানটা বড্ড বেশি।

তুমি বললে, ধেৎ, বয়স আবার কী? ওটা তো একটা নাম্বার।

খালিদ আবদুল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কটা প্যাচআপ করে খুব ভালো করেছ। অন্তত দু-এক দিনও তার সঙ্গে শুয়ে থাকলে বাবুটাকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠবে না।

তুমি বললে, তোমার প্রেগন্যান্সি খালিদ আবদুল্লাহকে খুশি করেছে। এখন সে তোমার এক্সট্রা কেয়ার নিচ্ছে। তার কাছে আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। কবিতা ভালো না বাসুক, কবিতার বই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলুক, আমার রচনাবলি ইটের ভাটার গনগনে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলুক, তবু বাবুটাকে নিজের সন্তান ভেবে ভালোবাসুক। আর সেটা আরও বড় কবির কাজ, আমার চেয়েও বড়।

তুমি শরীরের যত্ন নিয়ো। ভারী কোনো কিছু তুলতে যেয়ো না। কোনো পুরোনো রাগ খালিদ আবদুল্লাহর ওপর ঝাড়তে যেয়ো না।

আমার ধারণা (এটা আমার চাওয়াও), বাবুটা মেয়েই হবে। আমি মেয়ের নাম নিয়ে ভাবছি।

আমেরিকার আইওয়াতে রাইটার্স ওয়াকর্শপে ডেকেছে। আমি যাব জানিয়ে দিয়েছি।

বিয়াল্লিশ বছর আগে একবার আমেরিকা হয়ে কিউবায় গিয়েছিলাম। তখন ফিদেল কাস্ত্রোর জন্য খুব টান অনুভব করতাম। টানটা কমে গেছে।

টাকার অঙ্কে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাহিত্য পুরস্কারটি এবার আমাকেই দেবে। উপলক্ষ তোমাকে উৎসর্গ করা বই। বাবুটা নেমে আসার আগেই বইটা নামবে।

তোমার সুইসাইড করার ইচ্ছেটা কি কমে যাচ্ছে?

তোমার চাপে বাধ্য হয়ে টিউমারটার বায়োপসি করিয়েছি। ডাক্তার বলেছেন, ম্যালিগন্যান্ট নয়, বিনাইন—মানে নিষ্কলুষ; কোনো সমস্যা হবে না। তুমি আশ্বস্ত হও।

ভালো থেকো।

তোমার কবি।

তৃতীয় চিঠি

(এই চিঠিতে কোনো সম্বোধন নেই এবং কোনো ইতিও নেই।)

কী আশ্চর্য! তুমি এমন রহস্যজনক আচরণ করছ কেন? আমি তোমার সঙ্গে যোগাযোগের আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি, তুমি কোনো সাড়াই দিচ্ছ না।

আমি আমেরিকা থেকে ব্রাসেলস হয়ে ফেরার পথে আমাদের বাবুটার জন্য একটা বেবি-কিট নিয়ে এসেছি, কয়েকটি জামাও। প্রশ্নের মুখোমুখি হতে পারি, এ জন্য এগুলো বাড়িতেও নিতে পারছি না।

একটু কঠিন মনে হবে, তবু নাম রেখা শ্রাবস্তী।

তোমার সাথে আর যোগাযোগ হবে কি না, বুঝতে পারছি না।

একটুখানি খারাপ খবর দিই—কেটে ফেলা টিউমারের জায়গাটা আবার ফুলে ওঠায় (কোনো যন্ত্রণা হয়নি) আইওয়ার হাসপাতালে যাই। সেখানে ডাক্তারেরা আবারও পরীক্ষা করে। বলে, এত দিন কী করেছেন? এটা তো ম্যালিগন্যান্ট। ক্যানসার তো ছড়িয়ে পড়ছে। তাড়াতাড়ি অপারেশন করাতে হবে। তারপর রেডিওথেরাপি, কেমো—এসব লাগবে।

এ ধরনের রোগীর আয়ু বড়জোর তিন বছর।

ফিরে এসেছি। কালই ক্যানসার হাসপাতালে যাচ্ছি। দুশ্চিন্তার কারণ নেই। তিন বছর কম সময় নয়।

তোমার সাড়া চাই।

দুই.

আইওয়া থেকে ফেরার এক বছরের মধ্যে শাফকাত হাশিমের মৃত্যু হয়। দেশের এক নম্বর কবির মৃত্যুতে ঢাকা একটি শোকের শহরে পরিণত হয়।

তাঁর পঞ্চদশ মৃত্যুবার্ষিকী সামনে রেখে রূপান্তর ঈদসংখ্যা শাফকাত হাশিমের প্রেমপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়, বিজ্ঞাপনে বেশ রসিয়ে রসিয়ে লেখে: শাফকাত হাশিমের গোপন অধ্যায়। আজই আপনার হকারকে বলুন।

মিসেস নূরজাহান হাশিমও হকারকে বলেন, রূপান্তর হাতে পান এবং ৫২০ পৃষ্ঠার ঈদসংখ্যা হাতে নিয়ে তিনি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর মনে হয়, পাতা ওলটালেই বিস্ফোরণ ঘটবে। পলিথিন ব্যাগে ঢুকিয়ে স্টিলের আলমারিতে রেখে তালা মেরে দেন। বছর পাঁচেক আগে সোনা মালতী নামের একটি মিষ্টি মেয়েকে লেখা কবি সাহেবের পাঁচটি প্রেমপত্র ছাপা হয়েছিল, তিনি যথেষ্ট কষ্ট পেয়েছেন। একটি চিঠিতে কবি সাহেব সোনা মালতীকে বলেছেন, আমার নূরজাহান তো সাইবেরিয়ার বরফের মতো শীতল।

নূরজাহান বিড়বিড় করেন, দোজখের আগুনের মতো গরম হলে কি ভালো হতো? কবি সাহেব, তাহলে তো তুমি পুড়ে ছাই হয়ে যেতে।

বোমাটা আলমারিতে। নূরজাহান খবরের কাগজে পড়েছেন, ব্যাবের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট কেবল এসব বোমা অকার্যকর করতে পারে।

তিনি ভাবেন, সোনা মালতীর পর আবার কোন নারী?

টুপুর অস্ট্রেলিয়া থেকে ফোন করে, মা, পত্রিকায় নাকি বাবার প্রেমপত্র বের হয়েছে?

নূরজাহান বলেন, কিসের আবার প্রেমপত্র? কবর থেকে পত্রিকায় পাঠিয়েছে নাকি? তোর থিসিসের কী হলো?

টুপুর বলল, রাখো তোমার থিসিস, একবার যখন নাম লিখিয়েছি, ডক্টরেট হবেই। আমার জন্য তো তোমাকে আর টাকা পাঠাতে হচ্ছে না। তাহলে চিন্তা কিসের? শোনো মা, রূপান্তর পত্রিকার ঈদসংখ্যার একটা বিজ্ঞাপন স্ক্যান করে নওশাদ আমাকে মেইল করেছে। সে জন্যই তোমাকে বলছি। লিখেছে: কবি শাফকাত হাশিমের অজ্ঞাত জীবন, অজ্ঞাত প্রেমিকা। এবারের সেনসেশন সেই প্রেমিকাকে লেখা কবির তিনটি চিঠি। তুমি ঈদসংখ্যাটা কিনে রেখো তো, মা।

নূরজাহান হাশিম হঠাৎ বলে উঠলেন, ভালো থাকিস, আল্লাহ হাফেজ।

টুপুর বলল, ফোন রেখে দেওয়ার জন্য এত অস্থির হয়ে উঠেছ কেন? তোমার কি বাথরুম পেয়েছে?

না, মানে এমনিই।

তাহলে এমনিই রাখবে কেন? শোনো মা, বিজ্ঞাপন আমাকে পাঠিয়েছে নওশাদ। আমাকে এটাই বোঝাতে চেয়েছে, তোর বাপ প্রেম করলে দোষ নেই, আমি করলেই দোষ!

নূরজাহান জিজ্ঞেস করেন, তোর সাথে তুই-তোকারি করে?

শুধু তুই-তোকারি করলে তো ভালো ছিল। আমাকে অনেক নোংরা কথা বলে। সব ধরনের জন্তু-জানোয়ারের বাচ্চা বলে তো গাল দেয়ই, আমি তা-ও সহ্য করি। কিন্তু যখন ঠান্ডা মাথায় আমাকে কবির বাচ্চা বলে, তখন আর সহ্য করতে পারি না, মাথায় রক্ত উঠে যায়।

নূরজাহান হাশিম বলেন, এটা একটা কথা হলো? কবির বাচ্চা আবার কী?

হ্যাঁ মা, এটাই কথা। এটাই আমার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য ও নোংরা গালি। চিন্তা কোরো না মা, আমি পিএইচডি হওয়া পর্যন্ত নওশাদকে ছাড় দিয়ে যাব। তারপর আমিই ডিভোর্স নোটিশ দিয়ে দেব।

নূরজাহান হাশিম বলেন, আমি এ জন্যই বলেছিলাম, তাড়াতাড়ি একটা বাচ্চা নিয়ে নে। বাচ্চারা সংসার ধরে রাখে। তুই, নূপুর, ধ্রুব—তোরাই তো সংসারটি ধরে রেখেছিস। আমার কি একটুও রাগ হতো না? হতো, কিন্তু যখন দেখলাম, কবি সাহেব প্রাণ দিয়ে তোদের ভালোবাসেন, আমার রাগটা মিলিয়ে যেত।

টুপুর বলল, মা, তোমার ভিক্টোরিয়ান ডায়ালগ রাখো তো। আচ্ছা মা, যাদের বলে নিগ্রো—কালো ছেলেদের সম্পর্কে তোমার কী ধারণা?

তিনি বললেন, খুব খারাপ ধারণা। ছোটবেলায় শুনেছি কোঁকড়া চুল এবং কুচকুচে কালো যারা—ওই যাদের কথা বলছিস—তারা নাকি গোসল করে না, দাঁত মাজে না, মাথায় উকুন।

টুপুর বলল, মা, তুমি নেলসন ম্যান্ডেলার নাম শুনেছ? মোহাম্মদ আলী ক্লে, বব মার্লে, ওয়াঙ্গারি মাথাই, হুইটনি হিউস্টন, মার্টিন লুথার কিং, ল্যাঙ্গস্টোন হিউজেস কিংবা অপরাহ উইনফ্রে?

কেন? মোহাম্মদ আলী ক্লের নাম শুনেছি। বাংলাদেশে এসেছিলেন।

শোনো মা, এঁদের সবাই ব্ল্যাক, তোমার ভাষায় নিগ্রো। মা, আমি একটা কালো ছেলেকে পছন্দ করতে শুরু করেছি। ওর নাম ড্রুমান্ড পেটার্সন। দাঁত মাজে, মাথায় উকুন নেই, ভালো করে দুবেলা গোসল করে, খুব ভালো কি-বোর্ড বাজায়।

পিএইচডি করেছে?

না, মা। ড্রুমান্ড লিরিসিস্ট। গান লেখে।

নূরজাহান হাশিম বললেন, তাহলে তো একই কথা—কবি।

টুপুর বলল, এখন থাক মা। আমি স্কাইপে তোমার সঙ্গে ড্রুমান্ডের কথা বলিয়ে দেব, তুমি নিজেই দেখবে কেমন হ্যান্ডসাম। শুধু একটু সমস্যা আছে, মার্থা ওকে ঝুলিয়ে রেখেছে। দুটো বাচ্চা আছে কিনা—ফ্রিডা আর ন্যান্সি। খুবই সুইট।

মানে দুই বাচ্চার বাবা?

সেটা তেমন সমস্যা নয়। এবার ঈদে আমি আর ড্রুমান্ড নিউজিল্যান্ড যাচ্ছি। একসাথে কয়েকটা দিন থাকলে ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং হবে, তাই।

নূরজাহান হাশিম বললেন, মানে একসাথে থাকবি? এক ঘরে, এক বিছানায়? আস্তাগফিরুল্লাহ।

টুপুর বলল, থাক মা, তোমার না বাথরুম পেয়েছে। যাও। টেক কেয়ার মা। বাই।

টুপুর লাইন ছেড়ে দেয়।

নূরজাহান হাশিম আলমারি খোলেন। একটা পুরোনা ওড়না দিয়ে রূপান্তর ঈদসংখ্যাটি প্যাঁচান, তারপর আলমারির ডাবল-লকে ঢুকিয়ে দেন। এখানে কিছু অলংকার, কিছু ডলার এবং বাড়ির দলিল রাখা আছে।

তিনি লকার বন্ধ করেন, আলমারি বন্ধ করেন। এবং টুপুরের সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলার পর তাঁর মনে হয়, বোমাটাকে যতটা বিস্ফোরক ভেবেছিলেন, ঠিক ততটা বিস্ফোরণ ঘটাতে পারবে না। নূরজাহান হাশিম স্বস্তি বোধ করেন, যাক, চিঠিগুলোতে যা-ই থাকুক, আর কারও চোখে পড়ছে না।

অনেক দিন পর সেই রাতে তাঁর বেশ ঘুম হলো।

ফোনটা পেলেন সকাল সাড়ে আটটায়। বারিধারা থেকে নূপুর ফোন করেছে এবং হাসতে হাসতে বলছে, মা, দারুণ খবর! বাবার প্রেমপত্র পড়েছ? না পড়লে একটা রূপান্তর এখনই আনিয়ে নাও। দারুণ খবর আছে। তোমার জামাই, মানে টুইয়ের বাবা হাসনাত খুব স্টিমুলেটেড হয়ে আছে। আমি তোমাদের ছোট মেয়ে হওয়ায় হাসনাত শালী পায়নি। বাবার প্রেমপত্র পড়ার পর নিশ্চিত হয়েছে, বাবার আর একটা মেয়ে আছে, শ্রাবস্তী নাম।

নূরজাহান হাশিম জিজ্ঞেস করলেন, কিসের শ্রাবস্তী?

নূপুর বলল, বাবার মেয়ে, হাসনাতের শ্যালিকা শ্রাবস্তী, হিসাব করে বের করেছে, এখন বয়স ষোলো বছর। সুইট সিক্সটিন।

নূরজাহান হাশিম আলমারির দিকে তাকান। বন্ধই তো। তাহলে প্রেমপত্র পেল কোথায়? ঈদসংখ্যা রূপান্তর যে মাত্র এক কপি ছাপা হয়নি, কেন যেন এটা তাঁর মনেই ছিল না; কিন্তু যখন বিষয়টি মনে পড়ল, গলা শুকিয়ে এল তাঁর।

তাঁর চোখ চলে গেল শাফকাত হাশিমের পোর্ট্রেটের ওপর। অনেকটা উত্তমকুমার ধাঁচের চেহারা, রংটাও ফরসা। কিন্তু চশমা আছে। টুপুর, নূপুর—একজনও বাবার মতো সুন্দর হয়নি। মায়ের ধাঁচটা পেয়েছে।

বিড়বিড় করে তিনিই বলেন, শ্রাবস্তীটা নিশ্চয়ই কবি সাহেবের মতো হয়েছে।