আউট বই

এই ‘আউট বই’গুলো এখন আর চোখে পড়ে না সেভাবে।  ছবি: সংগৃহীত
এই ‘আউট বই’গুলো এখন আর চোখে পড়ে না সেভাবে। ছবি: সংগৃহীত
>পাঠ্যবইয়ের বাইরের বইপত্রকে একসময় বলা হতো ‘আউট বই’। খণ্ডস্মৃতির ভেতর দিয়ে এ লেখায় আছে সেই সব আউট বইয়ের খোঁজখবর, যেগুলোর বেশির ভাগই এখন আর পাওয়া যায় না।

গ্রামের পাশেই নদী। ছোট, কিন্তু ‘বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে’ মার্কা নদী নয়। সব মাসেই ডুবোজল।

নদীর ছোট ছোট ঢেউ, যাকে বলে হিল্লোল, তার ওঠা–নামা দেখতে ভালোই লাগত। কখনো বিকেলে বসে বন্ধুদের সঙ্গে ঢেউ গোনার চেষ্টা করতাম। কারোর সঙ্গে কারোরটা মিলত না। হিসাব না মেলার আনন্দে ঘাসের ওপর গড়াগড়ি দিতাম।

নদী প্রতিদিনের নিত্য দৃশ্যমান চিত্র। তবু নদীতে যে স্রোত বয়, সে খবর আমাদের তখনো অজানা। ফোটা ফুলের কচুরিপানাদের ভেসে যাওয়া দেখতে ভালো লাগত। তবে সে যে স্রোতে ভাসা, তা জানা ছিল না।

সাঁতার শিখলাম সম্ভবত ১৯৫৩ সালে, ক্লাস থ্রিতে উঠে। মাটির ‘খোলা’ নিয়ে পুকুরঘাটে বসে ‘ছিনিমিনি’ খেলতাম সে পুকুরে। নিরীহ এই খেলাটি কী করে যে বাগধারায় পরিণত হলো, ভাবলে বিস্ময় মানতে হয়।

পুকুর ছেড়ে নদীতে একদিন সাঁতার কাটতে গিয়ে মাঝনদীতে হাবুডুবু খেয়ে জানলাম ঢেউ আর স্রোতের রহস্য। নদীর ঢেউ ওঠে আর পড়ে, স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

আমাদের সাগরখালী নদী এখন আর নিজের খাতে নয়, প্রবাহিত হয় আমাদের হৃদয়ে। এখন সে মৃত।

১৯৫৬ সালে ভর্তি হলাম হাইস্কুলে, ক্লাস সিক্সে। হাইস্কুল বলে কথা। মনে হলো বড় হয়ে গেছি। ভাবনাটা আরও পোক্ত করে দিলেন বাবা। সিক্সের বই কিনতে নিয়ে গেলেন গ্রাম থেকে জেলা শহর কুষ্টিয়ায়।

বই কেনার আগে রক্সি সিনেমা হলের মর্নিং শোতে বাবার পাশে বসে দেখলাম জীবনের প্রথম ছবি আজাদ। ঘোর লেগে গেল। নায়ক-নায়িকাকে দেখে নয়। নায়ক-নায়িকা ব্যাপারটা বাবাই আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আমার কিন্তু ঘোর লাগল ‘আপলাম চাপলাম’ গান আর নাচে। সে ঘোর এ বয়সেও কাটেনি।

কুষ্টিয়ায় লতিফ বুক স্টল তখন বেশ বড় এবং বিখ্যাত। বুকলিস্ট ধরে বাবা আমার বই কিনতে শুরু করলেন। এদিকে আমার চোখ চলে গেল অন্য শেলফে, যেখানে সব রং–বেরঙের বই।

‘ওসমানিয়া পকেট পঞ্জিকা’ বলে তখন একটা বাংলা পঞ্জিকা বের হতো। তাতে থাকত ওসমানিয়া বুক ডিপো থেকে বের হওয়া বইয়ের বিজ্ঞাপন। আর সেই বিজ্ঞাপনের বইয়ের সামনে এসে আমার তো চক্ষুস্থির! দ্য কাউন্ট অব মন্টি ক্রিস্টো, ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড, ডন কুইকসোটের অভিযান আমাকে উতলা করে তুলল। সংবিৎ ফিরল বুক স্টলের মালিক লতিফ চাচার কথায়। জানালেন, ওগুলো সব ‘আউট বই’। আরও বড় হলে ওগুলো তখন পড়বে। চুপসে গেলাম। চমকেও উঠলাম। আউট বই—সে আবার কেমন ধারার বই?

ইংরেজি ও বাংলায় মিলে আউট বই শব্দবন্ধটি কীভাবে তৈরি হয়েছিল, কে–ই বা তৈরি করেছিলেন, তার হদিস পাওয়া দুষ্কর। গত শতকের পাঁচ কিংবা পঞ্চাশের দশকের দিকে কথাটার বেশ চল ছিল। পরে তা চলেছিল কি না, জানি না। অভিভাবকেরা লক্ষ রাখতেন, সন্তানেরা আউট বই পড়ছে কি না।

স্কুলব্যাগ বলে কোনো জিনিস তখন চোখে দেখিনি। নামও শুনিনি। বই–খাতা আমরা নিতাম ডানহাতের কনুই ঘুরিয়ে কাঁধে। আরও একটা কায়দা ছিল, এখন মনে করতে পারছি না।

সিক্সের প্রথম ক্লাসে ঢুকলাম। ক্লাস টিচার সেনমশাই হাইস্কুল নিয়ে অনেক কথা বললেন। শেষের কথাগুলো শুনে ভড়কে গেলাম। তাঁর কথাতেই বুঝলাম, আউট বই সম্পর্কে তাঁর প্রচণ্ড বিরক্তি। তিনি জানালেন, এখন আউট বই চোখে পড়তে পারে, আর সেই বই পড়লে তোমরা উচ্ছন্নে যাবে।

আউট বই সম্পর্কে আগ্রহ তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। হঠাৎ হাতেও এসে গেল একটা।

আমাদের গ্রামে সমৃদ্ধ একটা লাইব্রেরি ছিল। দেশভাগের অভিঘাতে তা তছনছ হয়ে যায়। বেশির ভাগ বই যায় স্কুলের লাইব্রেরিতে। কিছু যায় হাটবাজারে। কিছু যায় লেখাপড়া জানা লোকদের বাড়ি বাড়ি। অল্প কিছু বই ও পত্রিকা থেকে যায় লাইব্রেরিতে।

তো, আমাদের বিখ্যাত মুদি দোকানে বাতাসা, জিরা, দারুচিনির মোড়ক হওয়ার অপেক্ষায় পড়ে থাকা কাগজপত্রের স্তূপে পেয়ে গেলাম একটা আস্ত বই। নিশ্চয় আউট বই। গ্রামের লাইব্রেরির সিল। নাম-পৃষ্ঠাগুলো আগেই উধাও। পাতা উল্টে ওপরে নাম পেলাম—রমলা। লেখকের নাম আগেই বাতাসার আধার হয়ে চলে গেছে। তাঁর নাম অজানা থেকে গেল।

জীবনের প্রথম আউট বই। উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছি। পড়া শুরু হতেই উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে এল। আসলে আমি ভুল সময়ে ভুল বই পড়েছিলাম। তবু পড়ে গেলাম। চমকে উঠলাম শেষ দুটি পৃষ্ঠায় এসে। আগের পৃষ্ঠার মাঝখানটা শুরু হয়েছে এভাবে: রজতের ডায়েরি হইতে—; পরের লাইনে পরম রহস্যময় একটি বাক্য: ‘জীবনের স্রোত বহিয়া চলিয়াছে...’।

সবে এগারোয় পা দিয়েছি। আর সেই সময় জীবন, জীবনের স্রোত, তা–ও আবার বয়ে চলেছে—এমন কথায় মাথার মধ্যে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। বিহারীলাল চক্রবর্তীর কবিতার লাইনের মতো তখন ‘আমি যেন কী হয়ে গেলাম।’ জীবনের স্রোত বয়ে চলল মাথার মধ্যে। কখনো মৃদু। কখনো তীব্র।

বনফুলের এক ছোটগল্পের নাম ‘পাঠকের মৃত্যু’। এক কি দেড় পৃষ্ঠার গল্প। তবে কীভাবে যেন পাঠকের মৃত্যু প্রায় বাংলা বাগধারায় পরিণত হয়ে যায়। যাঁরা গল্পটি পড়েননি, তাঁরাও তাক বুঝে পাঠকের মৃত্যু কথাটি ব্যবহার করেন।

রমলার লেখকের নাম খুঁজে পাই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। নিছক সহজ–সরল প্রেমের উপন্যাস। নায়িকা রমলা আর নায়ক রজত। লেখকের নাম মণীন্দ্রলাল বসু। তিরিশের দশকের নামকরা ঔপন্যাসিক।

তখনকার দিনের উপন্যাসের দুটো মজার ব্যাপার এখনো মনে পড়ে। নায়িকারা তখন প্রায়ই অজ্ঞান হয়ে পড়ত। তখন তাদের নাকের সামনে ধরা হতো স্মেলিং সল্টের শিশি। আর নায়ক অসুস্থ হলে তাকে খাওয়ানো হতো এক চামচ ব্র্যান্ডি।

ইতিমধ্যে বেশ কিছু বিখ্যাত উপন্যাস পড়া হয়ে গেছে। নতুন করে রমলা পড়তে গিয়ে মনে পড়ল পাঠকের মৃত্যুর কথা। কিন্তু সেই যে ‘জীবনের স্রোত বহিয়া চলিয়াছে...’—তা নিয়ে বিহ্বলতা থেকেই গেল।

যা হোক, আউট বই নিয়ে তখন যে উৎসাহ জেগেছিল, তা উবে গেল। ক্লাস সিক্সটা এভাবেই কাটল। ক্লাস সেভেনে উঠে হাতে পেলাম সত্যিকারের আউট বই, ‘স্বপনকুমার সিরিজ’। তখনকার মুখের কথায় সিরিজটির প্রজাতি ছিল ‘ডিটেকটিভ নভেল’। সে সময় আউট বই পড়তে হতো গোপনে। পড়া শেষে আমার বন্ধু আখতারের স্বগতোক্তি, ‘আউট বই পড়ার মজাই আলাদা।’ তখন থেকে মজে গেলাম আউট বইয়ে।

স্বপনকুমার সিরিজের বই আসত কলকাতা থেকে। দাম আট আনা। বাটা দিয়ে আমাদের দেশে দাম পড়ত নয় আনা। বড়জোর তিন ফর্মার বই। বইগুলো ছিল পেপারব্যাক। বাটা শব্দটা তো এখন উঠেই গেছে।

একটাতে ডিটেকটিভের নাম থাকত দীপক। রতন তার সহকারী। অন্যটাতে ডিটেকটিভের নাম দীলিপ। সহকারীর নাম মনে নেই। দারুণ জনপ্রিয় ছিল স্বপনকুমার সিরিজ। দস্যু মোহনের আদলে নারী দস্যু নিয়ে স্বপনকুমারের আরেকটি সিরিজ ছিল ‘বিজয়িনী তন্দ্রা’। এ সিরিজের বই তিনটি কি চারটি মাত্র পড়েছি।

স্বপনকুমারে আচ্ছন্ন ছিলাম কয়েক মাস। হঠাৎ দেখা দিল ‘দস্যু বাহরাম সিরিজ’। শক্ত মলাট। একটু মোটা আকার। স্বপনকুমার সিরিজ ত্যাগ করে ভিড়ে গেলাম দস্যু বাহরাম সিরিজে। লেখকের নাম আবুল কাশেম। ওসমানীয়া বুক ডিপো থেকেই মনে হয় সিরিজটা বের হতো।

বড় ভাইদের মুখ থেকে শুনলাম, দস্যু মোহনের কাছে দস্যু বাহরাম নস্যি। আমাদের আউট বই পড়া যখন শুরু হলো, তত দিনে দস্যু মোহনের কাল শেষ। দস্যু মোহন সিরিজের বই পরে পড়ে দেখেছি। মনে হয়েছে দস্যু বাহরাম দস্যু মোহনেরই ছায়া।

দস্যু বাহরামের পরপরই কিংবা একই সময়ে এসেছিল ‘কুয়াশা সিরিজ’। ভালো লেগেছিল। গ্রীনভিলা হত্যা রহস্য নামে একটি বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা ছিল: ‘গভীর রাতে একা একা কেউ এই বই পড়বেন না।’ শিহরিত হয়েছিলাম। আমি আর আমার আউট বই পড়ার নিত্যসঙ্গী আখতার ভয় পেয়ে বইটা পড়েছিলাম দিনের বেলায়। গভীর রাতে পড়লে ভীত হতে পারি—এমন লক্ষণ পাওয়া গেল না। নিরাশ হয়েছিলাম। দস্যু বাহরাম সিরিজের একটিতে ঠিকানা ছিল ১০ নং পরেশ দত্ত লেন, বেহালা। এখনো মনে আছে।

নীহাররঞ্জন গুপ্তের কিরীটী রায়ের সঙ্গে স্কুলজীবনে পরিচয় হয়নি। দাম বেশি হওয়ার জন্য এ সিরিজের বই গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছাত না। ব্যোমকেশের নাম তখন একেবারেই শুনিনি। তবে শার্লক হোমস সিরিজের বাংলা অনুবাদ কয়েকটা পড়েছি।

ডিটেকটিভ নভেল পড়ার নেশা ছুটে গেল ১৯৫৮ সালে ক্লাস এইটে ওঠার পর, স্কুল লাইব্রেরিতে ঢোকার অনুমতি মিললে। প্রথমেই পরিচয় হলো হেমেন্দ্রকুমার রায়ের সঙ্গে সেনমশাইয়ের মাধ্যমে। তিনিই ইস্যু করে দিলেন দুটি বই—যখের ধনদেড় শ খোকার কাণ্ড। বললেন, আউট বই হলেও বই দুটি পড়তে পারো। অসম্ভব মুগ্ধ হই। পরে জানতে পারি, দুটি বই–ই বিদেশি বইয়ের রূপান্তর। দেড় শ খোকার কাণ্ড বইটির মূল লেখক জার্মান। বইটি পরে ইংরেজিতে অনূদিত হয়। এ কাহিনি থেকেই বাংলাদেশে বাদল রহমান তৈরি করেন তাঁর ছায়াছবি এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী

স্কুল লাইব্রেরিতে দুটি পত্রিকার সঙ্গে পরিচয় হয়—মৌচাক ও পাঠশালা। এই পাঠশালাতেই পড়ি হাসিরাশি দেবীর একটি অনুবাদ কাহিনি। ভৌতিক কিছু ব্যাপার ছিল কাহিনির মধ্যে। হাসিরাশি দেবীর নাম আর শোনা যায় না। শোনা যায় না প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর নামও। কেন জানি না, সন্দেশ পত্রিকা আমাদের স্কুলে ছিল না।

মন কেড়ে নিয়েছিল কলকাতার দেবসাহিত্য কুটির থেকে প্রতিবছর প্রকাশিত ‘পূজাবার্ষিকী’ নামে সচিত্র সুবৃহৎ সংকলন। প্রতিবছর ভিন্ন ভিন্ন নামে বের হতো এই বার্ষিকী। মনে পড়ে, ১৯৫৮ সালের সংকলনটির নাম ছিল পরশমণি

তখনকার বিখ্যাত সব লেখক লিখতেন কিশোরদের এই সংকলনে। থাকত মূল লেখা এবং অনুবাদও। সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের বিদেশি কাহিনির সংক্ষেপিত অনুবাদ ও রূপান্তর পড়ি এই বার্ষিকীতেই। ক্লাস নাইনে উঠে আশ্চর্য একটি অনুবাদ গ্রন্থ পড়ি। ন্যুট হামসুনের ক্ষুধা। তখন ন্যুট লেখা হতো ‘কয়ে নয়ে হস্যু ট’ দিয়ে। অনুবাদক ছিলেন নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। অন্য কেউও হতে পারেন, মনে পড়ছে না এখন। এই বইটি পড়ার পর থেকে পৃথিবীকে শুধু চোখ দিয়ে নয়, মন দিয়েও দেখতে শুরু করি।

পূজাবার্ষিকীর সুবাদে নতুন এক ধরনের রচনার সঙ্গে পরিচয় ঘটে। আর তা হলো রম্য ও রসরচনা। সবই কিশোর বয়সের উপযোগী। ফলে তাতে নির্মল হাস্যরসই বেশি থাকত।

১৯৫৬ সালে লতিফ বুক ডিপোতে দেখা আউট বইগুলো ১৯৫৮-তে পেয়ে যাই স্কুলে। সবই বিখ্যাত উপন্যাসের কিশোর সংস্করণ। আমাকে মুগ্ধ করেছিল ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড। ১৯৫৮-তেই হাতে আসে পথের পাঁচালী। বন্ধু আখতার বলেছিল, এ তো আমাদেরই কথা!

১৯৫৮ সালেই এল আইয়ুব খানের মার্শাল ল। অনেক ঘটনা ঘটতে থাকল। আমরা গ্রামের ছেলে, সাহেব–মেমের কথা বইয়ে পড়েছি, চোখে দেখিনি, সে সৌভাগ্যও হলো। একজন–দুজন নয়, অনেক।

আমাদের গ্রামের কাঁচা রাস্তার ওপর দিয়ে কালেভদ্রে চলত সরকারি উইলিজ জিপ। পেট্রোলের গন্ধে মোহিত হয়ে আমরা দৌড়াতাম তার পিছু-পিছু। হঠাৎ এল ঝাঁ-চকচকে নতুন চেহারার এক গাড়ি। ভেতরে সব সাহেব-মেম। দেখে ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। ফরসা, কিন্তু এ রকম ফ্যাকাশে ফরসা গায়ের রং তখনো দেখিনি।

বড়দের কাছে শুনলাম, গাড়িটার নাম ল্যান্ড রোভার। আমেরিকার। সাহেব-মেমরাও তা–ই। পরে এল জীবনে প্রথম দেখা পিকআপ ভ্যান। তাতে এল গুঁড়ো দুধ, সয়াবিন তেল আর বাটার অয়েল—টিন ও বাক্সের গায়ে হ্যান্ডশেক করা দুটো কবজি।

গ্রামে এলেন দুজন পুরুষ ও দুই নারী। গ্রামেই থাকবেন। তাঁরা হলেন ভিলেজ এইড ওয়ার্কার। বিভিন্ন সম্পর্কের বোনদের বাইরে প্রথম অচেনা সুবেশ যুবতী দেখা। রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। তাঁরা পাশ দিয়ে গেলে নাকে সুগন্ধি আসত। তাঁদেরই তত্ত্বাবধানে তৈরি হলো নানা ধরনের ক্লাব। ছোটদের। বড়দের। মেয়েদের।

তারপর একদিন এল পিকআপভর্তি বড় বড় কাগজের বাক্স। তার মধ্যে বই। বিনে পয়সায় দেওয়া হবে ক্লাবগুলোকে, কিছু স্কুলকে। কী অপূর্ব রং ও চেহারার সব বই। প্রকাশক ফ্রাঙ্কলিন বুক পাবলিকেশনস। বইয়ের কাগজ আমেরিকান। কী যে সে কাগজ! বইগুলো আমেরিকার বিখ্যাত লেখকদের। বাংলায় অনূদিত।

আমাদের চাঁদতারা ক্লাব ছোটদের। তাই পেলাম ছোটদের বই। তার মধ্যে এডগার অ্যালান পোর গল্প অসম্ভব ভালো লেগেছিল। আতঙ্কিতও হয়েছিলাম। আরেক লেখকের বই বিজন বনের রূপকথা আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল বহুদিন। বহুরঙা প্রচ্ছদ, ভেতরে বহুবর্ণিল ছবি। আর, অনুবাদের কী ভাষা! অনুবাদক ছিলেন শিশুসাহিত্যিক হাবীবুর রহমান। বইটি বীরদের কাহিনি।

হাবীবুর রহমানের লেখা পড়ি আজাদ পত্রিকার ‘মুকুলের মহফিল’–এর পাতায়। গ্রামে তখন ডাকযোগে আসত দুটি পত্রিকা—আজাদমর্নিং নিউজ মর্নিং নিউজ আসত মাত্র একটা। তা–ও স্কুলে। তার মধ্যে ছিল গেট-এ-ওয়ার্ড নামে শব্দপূরণের খেলা। সে খেলা খেলে আমাদের স্কুলের ৪ জন শিক্ষক পেয়ে যান সাড়ে ১২ হাজার টাকা। তাতে হঠাৎ বেড়ে যায় সে পত্রিকার গ্রাহকসংখ্যা।

বীর হিসেবে রাম, ভীম, অর্জুনদের নাম জানতাম। বিজন বনের রূপকথায় পেলাম নতুন বীর—হারকিউলিস, পার্সিউস, জ্যাসন, ইউলিসিসদের। বই পড়ে প্রায় দিশেহারা অবস্থা। এই বীররা কোন দেশের, সে দেশের আরও বীরের কথা আছে কি না, তা জানার জন্য জানটা ব্যাকুল হয়ে উঠল। হাতে আর বই পাই না। অনেক দিন অপেক্ষার পর অবশেষে নিজেই একদিন লিখে ফেললাম একটা বই। বের হলো ১৯৮৪ সালে।

ক্লাস এইট ও নাইনে তিনটি বই পড়তে পাই আমার এক চাচার কল্যাণে। ভিন গ্রামে থাকেন। তবে প্রতিবারই আসেন আমাদের বাড়িতে। তিনি বইপ্রেমী। বই হাতে করে আসতেন। একে একে তাঁর আনা তিনটি বই পড়লাম—দেশে বিদেশে, সাহেব বিবি গোলাম আয়না—যেটিতে ‘আয়নার ফ্রেম’ নামে ভূমিকা লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিন ধরনের বই। চিত্ত ও চিন্তার শাখা–প্রশাখা গজাতে শুরু করল বইগুলো পড়ে।

স্কুলের লাইব্রেরিতে নতুন বই কেনা হতো না অনেক দিন। আমেরিকানদের দেওয়া মিনি-মাগনার বই পেয়ে পরিবর্তন এল। ১৯৫৮ সালেই স্কুলের পয়সায় এল নতুন বই। বেশি এল শরৎচন্দ্রের। বিশ্বভারতীর বইয়ের মতো ম্যাড়মেড়ে হলুদ রঙের প্রচ্ছদ—পেপারব্যাক। আমরা পড়ার জন্য পেলাম রামের সুমতি, বিন্দুর ছেলে, পণ্ডিত মশাই, মেজদিদিঅরক্ষণীয়া। আকবর হোসেনের অবাঞ্ছিত উপন্যাস নিয়ে গুঞ্জন শুরু হলো। সেনমশাই আমাদের সাবধান করে দিলেন। চরিত্র খারাপ হবে। আমরা চরিত্র কী, তা নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করলাম।

দারুণ এক আউট বই হাতে এল ক্লাস টেনে। যাযাবরের দৃষ্টিপাত। কী যে সেই বই! সে বইয়ের আধারকার অধ্যায়ের বহু কোটেশন মুখস্থ হয়ে গেল অনেকের।

আমাদের যেগুলো আসল বই—সেই বাংলা ও ইংরেজি বইও তখন ছিল রত্নের খনি। ক্লাস নাইন-টেনের বাংলা-ইংরেজি বই এবং সেই সঙ্গে ‘ব্যাপিড রিডার’ নামের বইয়ে বাংলা সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্যের রথী-মহারথীদের রচনা ও রচনাংশের মাধ্যমে আমরা প্রবেশ করি নতুন জগতে।

স্কুলে তখন বছর শেষে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হতো। নানান কাজের জন্য পুরস্কার দেওয়া হতো। আমরা অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করতাম, গদ্য পাঠ করতাম। কেউ গাইত গান। কবিতা আবৃত্তির জন্য ক্লাস নাইনে পুরস্কার পাই ইকবালের আসরারে খুদী। অনুবাদক কবি সৈয়দ আবদুল মান্নান। শুনতে পাই, তাঁরই জন্য নাকি কবি-প্রাবন্ধিক-গল্পকার আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর সৈয়দকে সামনে থেকে পেছনে নিয়ে যান।

আসরারে খুদীর দুটি লাইন এখনো মনে আছে: ‘দুর্বার তরঙ্গ এক বয়ে গেল তীব্রতীর বেগে। বলে গেল, আমি আছি, যে মুহূর্তে আমি গতিমান।’

আমার জীবনের স্রোত বয়ে চলতে চলতে এখন মোহনায়। জীবনের স্রোত, গতি—সবই জেনেছি জীবনের কাছ থেকেই। সাহায্য করেছে সেই আউট বই, যা এখনো নিয়ত পড়ে চলেছি।