ক্ষয়িত ও পরাজিতের গল্প

সেরা দশ গল্প
সেরা দশ গল্প

মাটি খুঁড়ে এখন পর্যন্ত ৪০ হাজার ২৩০ ফুট গভীরে নামতে পেরেছে মানুষ। বিশ্বজিৎ চৌধুরীর সেরা দশ গল্প পড়তে পড়তে প্রশ্ন জাগল, মানুষের মনের কতটা গভীরে যেতে পেরেছে মানুষ? কোনো পরিমাপক তো নেই। আছে অনুভব, বিশ্লেষণ, দর্শন আর সাহিত্যের বিশ্বভান্ডার।

বিশ্বের কথা যদি বলি তাহলে এই অঞ্চলের ইতিহাসের কথাও বলতে হয়। নানা জাতের মানুষের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে বাঙালি। ইতিহাসের দীর্ঘ যাত্রায় সমুদ্রবেষ্টিত এই অঞ্চলের মানুষগুলো কেমন? তাদের মনোজগৎ, বহির্জগৎ কি লেখকেরা ধরতে পেরেছেন? নাকি তাদের অবস্থা রুস্তম সিংয়ের তরবারির মতো!

‘রুস্তম সিংয়ের তরবারি’ গল্পের নীলকমলের বাড়িতে ঢোকার মুখে দুপাশে আস্তর খসে পড়া হাঁ করা দুটি সিমেন্টের সিংহ আছে। বিরাট বাড়ির ভেতর ভাঙাচোরা ক্ষয়ে যাওয়া ঘর, এর মধ্যে দমবন্ধ জীবন। বিধ্বস্ত জমিদার বংশের শেষ সন্তান নীলকমলও অনেকটা তেমন, ক্ষয়ে যাওয়া। সেই ক্ষয়িত জমিদার নন্দন পাল্টে যান, যখন তিনি জমি বিক্রি করেন। কাঁচা টাকা এলেই হাতে ফিরে আসে কাল্পনিক তরবারি। ক্ষয়িষ্ণু মানুষ তো ওই তরবারির মতো। নীলকমল জমিদার থাকতে চান। আবার স্বাভাবিক সংসারের স্বপ্ন দেখেন, তা হারিয়েও ফেলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর কী হবে?

গল্পটা পড়ছিলাম খোলা আকাশের নিচে। সামনে বড় পুকুর। টলটলে তার জল। ভাবছিলাম, জলের বা জীবনের কত কিছুই তো জানি না। মানুষের যতটুকু জ্ঞান হয়েছে তার চেয়ে ঢের বেশি সে অজ্ঞান। অজ্ঞানতা থেকেই যেন গল্পের শুরু।

জগদীশ গুপ্তের ‘দিবসের শেষে’ গল্পে রতি নাপিতের ছেলে পাঁচু সকালে ঘুম ভেঙেই মা নারানীকে বলে, মা, আজ আমায় কুমিরে নেবে। শেষ পর্যন্ত তাকে কুমিরেই খায়। বিশ্বজিতের ‘কৃষ্ণগোপালের ভবিষ্যৎ’, ‘একটি খুনের বিবরণ’ বা ‘নূর আলী লেডিস টেইলার্সও অনেকটা নিয়তিতাড়িত মানুষের গল্প। পরাজিত, স্বপ্নভঙ্গ কিছু জীবনের দেখা পাই তাঁর গল্পে। অভয়মিত্র ঘাটের কাঠচেরাইয়ের কারখানার ম্যানেজার শাহজাহান কোনো দিন অভয়মিত্র ঘাট, কোনো দিন ব্রিজঘাট যায়। কিন্তু সেদিন সে কেন ব্রিজঘাটে গিয়েছিল? খুনের আসামি হতে নিয়তিই কি তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল! ‘একটি খুনের বিবরণ’ অদ্ভুত দুঃখের গল্প। এই গল্পে ধরা পড়ে পুলিশি ব্যবস্থার ফাঁকফোকর। পড়ে হাহাকারে ভরে যায় মন।

‘কৃষ্ণগোপালের ভবিষ্যৎ’-এর হরিকিশোর, শ্রীমা লন্ড্রির মালিক সারা জীবন কালো মানুষ থেকে দূরে থাকতে চেয়েছেন। আশপাশে সবাই কালো, তার ছেলে গৌর। গৌরগোপাল প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বড় হয়। তবে ফরসা-আক্রান্ত হরি শেষ জীবনে আবার কালোর মুখোমুখি।

মানুষকে কোনো সীমায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না। ‘সায়রা বানু সিনড্রম’ গল্পের বুড়োও তেমন। তিনি যৌন তাড়নায় নাজেহাল। নিজেকে নিয়ে কোথায় যাবেন ভেবে পান না। মানুষের অসহায়ত্ব চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পকার।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী চমৎকার কথক। সহজ করে গল্প বলেন। অতল থেকে তুলে আনেন মানুষের দীর্ঘশ্বাসের অনুভূতি। এই কথকতা, সহজতা পাঠককে কাছে টানে, গল্পের সঙ্গে জোড় বেঁধে নেয়। তাঁর সাম্প্রতিক গল্পে এই অন্তরঙ্গতা আরও বেশি করে গড়ে উঠছে।

‘আত্মজ ও একটি নীল মনিটর’ গল্পটি শৈশবকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। ১০ বছরের ছেলের মনিটরে এক পুরুষকে ঘিরে আছে তিন কামার্ত নগ্ন নারী। তা দেখে দুলে উঠেছিল এক মায়ের পৃথিবী। মায়ের পৃথিবীটা নীল মনিটরে ঢেকে যায়। সেই মা কীভাবে মনিটরের মোকাবিলা করবেন?

লেখকের কাজ তো অবিরাম পথ চলা। পথ চলায় অপ্রাপ্তির বেদনাটুকু, দীর্ঘশ্বাসের মতো আড়ালে থাকা সময়, পরকীয়া, জয়-পরাজয়, ভালোবাসা বা বঞ্চনা, স্বপ্ন, সম্ভাবনা তার সঙ্গী হয়। সেই সঙ্গ থেকেই বিশ্বজিৎ চৌধুরীর সেরা দশ গল্প। ‘সেরা’ বলে আগ্রহটাও বেশি।

লেখকের আকাঙ্ক্ষা থাকে, গল্প শেষ হওয়ার পরও তার রেশটুকু অনুরণিত হবে পাঠকের মনে। মূর্ছনা ধরে রাখার জন্য সেতারে ৯ থেকে ১৩টি তার থাকে। আমাদেরও আকাঙ্ক্ষা, বিশ্বজিৎ চৌধুরীর গল্পের তারে বহুবিস্তারী এক কথককে সুরের মূর্ছনায় আরও গভীর করে পাওয়ার।

সেরা দশ গল্প

বিশ্বজিৎ চৌধুরী

প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ, প্রকাশক: অন্যপ্রকাশ, ঢাকা

প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৪৩ পৃষ্ঠা

দাম: ২৮০ টাকা