উত্তর আধুনিকতা ও ঔপনিবেশিকতা

‘মাল্টিলিনিয়ার ন্যারেটিভস–১’, সুমন ওয়াহিদের িশল্পকর্ম
‘মাল্টিলিনিয়ার ন্যারেটিভস–১’, সুমন ওয়াহিদের িশল্পকর্ম

শিল্পকলাবিষয়ক পাঠপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আমাদের দেশে যে শিল্পশিক্ষার ধরন প্রবর্তিত হয়েছে, তা এখনো পর্যন্ত চালু আছে। বাংলাদেশের শিল্পকলা শিক্ষার মধ্যে যে ধারাবাহিক পাঠপ্রক্রিয়া রয়েছে, তার সঙ্গে যুক্ত ইউরোপীয় শিল্পকলার চর্চা। এই দুইয়ে মিলে যে ভার তৈরি হয়, সেটি দেখা যায় সুমন ওয়াহিদের নানা মাত্রার শিল্পকর্মে।

কাজগুলো তিন রকমের। এগুলো কোনো আয়েশি ফুরফুরে মর্জি তৈরি হওয়ার শিল্পকলা নয়। এ কথা বলা এখানে শোভন নয় যে, ‘এই ছবিগুলো দেখে একজন নাগরিকের সমুদয় যন্ত্রণা উপশম হবে।’ সুমন ওয়াহিদের নিরীক্ষার অনেক অংশজুড়ে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের উপস্থিতি দেখা যায়।

জয়নুলকে নানারূপে নিজের ক্যানভাসে হাজির করেছেন সুমন। সাধারণত দেখা যায় শিল্পী প্রত্যক্ষ উদ্দীপনা থেকে স্মৃতি, ধ্যান থেকে ধারণা, ধারণা থেকে বিমূর্ত উপলব্ধির জগতে পৌঁছান। সুমন কিছু কাজের শুরুতেই বিমূর্ততায় যাননি। ১৯৪৩-এর মন্বন্তরকে ঘিরে জয়নুলের কালি-তুলির রেখাপ্রধান কাজগুলোতে হুবহু অনুসরণ করে যুক্ত করেছেন রঙিন নিসর্গ। এতে যে কথাটি তিনি সামনে তুলে আনেন তা হলো: আমাদের শিল্পপাঠ শুরু এ অংশ থেকেই। প্রদর্শনীর শুরু এবং শেষ পর্যন্ত কয়েক ধাপ অতিক্রম করে শেষে ইতিহাসনির্ভর একটি সমাপ্তি দেখা যায়।

সুমন স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেন তাঁর শিল্প নির্মাণ-প্রক্রিয়া নিয়ে। তাঁর বয়ান, ‘শিল্পের ইতিহাস আমাকে অনুপ্রাণিত করে। ইতিহাসকে আমি পাঠ করতে চাই আত্মপরিচয় অন্বেষণের প্রক্রিয়া হিসেবে।’

‘মাল্টিলিনিয়ার ন্যারেটিভস–১’, সুমন ওয়াহিদের িশল্পকর্ম
‘মাল্টিলিনিয়ার ন্যারেটিভস–১’, সুমন ওয়াহিদের িশল্পকর্ম



ইমেজ সুমনের শিল্পের মূল কেন্দ্রে থাকে। কিছু কাজে ইমেজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা প্রতীক। যেমন একটি কাজে দেখা যায় জয়নুল আবেদিন ও তাঁর সঙ্গে আরও তিনজন সঙ্গী। ক্যানভাসের উপরিভাগে বিল্ডিংয়ের দরজা, জানালা, একপাশে দূরে আরেকজন মানুষ দেয়ালে মাথা ঠুকছে। দেয়ালের নিচের দিকে জ্যামিতি রেখা একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত হয়ে আছে।

এ ধরনের ইতিহাসনির্ভরতায় সুমনের বাস্তবধর্মী কাজে খুঁজে পাওয়া যায় উদ্দীপনা ও ভাব-ভাবনা। এগুলোর সব অংশ যুক্ত হয়ে এক অখণ্ড অস্তিত্বে পরিণত হয়।

এই শিল্পীর ক্যানভাসের ওপর অ্যাক্রিলিক ও হ্যান্ডমেইড পেপারের কাজের করণকৌশল ভিন্ন। শিল্পের মাধ্যমেও রয়েছে অনুসন্ধিৎসা। কোনো কোনো কাজের মধ্যে দেখানো হয়েছে স্পষ্ট ও অস্পষ্টতা । অতীত বোঝাতে ক্যানভাসের কিছু অংশে ছায়া তৈরি করেছেন। প্রদর্শনীর ক্যানভাসগুলো ছাড়িয়ে পূর্বের দেয়ালে পৃথিবীর বিখ্যাত সব শিল্পকর্মের প্রতিচিত্র পরপর সাজিয়ে রেখেছেন।

‘মাল্টিলিনিয়ার ন্যারেটিভস–৩’
‘মাল্টিলিনিয়ার ন্যারেটিভস–৩’

প্রদর্শনীতে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়, শিল্পকর্মগুলোর বিশেষ কিছু অংশ কালো আকৃতি দিয়ে চিহ্নিত করেছেন শিল্পী। আমাদের চলতি শিল্পকলা শিক্ষায় পশ্চিমা শিল্পকর্ম পাঠকালে এমন ইতস্তত অবস্থা শিল্প–শিক্ষার্থীদের মধ্যে অহরহ দেখা মেলে। এই শিল্পকর্মে তিনি যেন মনের এ ক্ষয়কে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন।

ইমেজনির্ভর কাজের পরপরই অতিবাস্তবধর্মী কাজের দেখা পাওয়া যায়। প্রিন্ট স্টুডিওতে জয়নুল আবেদিন অন্য শিল্পীর সঙ্গে আলাপচারিতায় ব্যস্ত। বাস্তবর্ধী এ ছবিতে রং নির্বাচন করেছেন অতিদূর সময়ের রং ধূসর ও বান্ট সিয়েনা।

শক্ত বোর্ডের দুই পাশে মানুষের সঙ্গে মানুষের নানা সময়ের সখ্য আর বিতণ্ডা দেখান সুমন, তাতে কিছু অশুভ হাতিয়ার দেখা যায়। চলতি সময়ের মাঝে দেখতে থাকা বিষয়াদি তুলে আনেন সাবলীলভাবেই।

কলাকেন্দ্রের এই প্রদর্শনীর শিরোনাম: ‘মাল্টিলিনিয়ার ন্যারেটিভস’: ‘ড্রয়িং থিংকিং, থিংকিং অ্যান্ড ড্রয়িং এই ভাবনার এটি চতুর্থ আয়োজন।’ প্রদর্শনীর সঙ্গে তিনটি আলোচনাপর্ব অনুষ্ঠিত হবে। প্রথমটি শিল্পীর সঙ্গে দর্শকের; দ্বিতীয়টি শিল্পী, দর্শক, কিউরেটর; তৃতীয়টি দর্শক, শিল্পী ও শিল্পী শিক্ষকের।

রাজধানীর কলাকেন্দ্রে ৬ অক্টোবর শুরু হওয়া প্রদর্শনী চলবে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত।