অপরিকল্পিত নগরায়ণের এক্স-রে চিত্র

‘ফল আউট/বিপর্যয়-২০’, শিল্পী: কাজী সালাউদ্দীন আহমেদ
‘ফল আউট/বিপর্যয়-২০’, শিল্পী: কাজী সালাউদ্দীন আহমেদ

বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগ হলে ঢাকা শহরের কী ঘটবে, আমরা কি অনুমান করতে পারি? শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আবাসকক্ষ, আলোকশয্যা, সুদৃশ্য ইমারতের এমন জৌলুশের মধ্যে থেকে কেউ কি এক্স-রে করে দেখবেন, কত ক্ষতে ভরে আছে এ নগরের ভিত? অনিয়ম-দুর্নীতি আর পরিকল্পনাহীনতায় আমাদের জীবননাশকগুলো দিন দিন জড়ো হয়েছে এ শহরের চাকচিক্যময় অবকাঠামোর ভেতর।

নিজের চিত্রকর্মে বিপর্যয়ের সম্ভাবনাগ্রস্ত ঢাকা শহরের সেই ভয়াল সৌন্দর্য অনেকটা এক্স-রে চিত্রের আদলে উপস্থাপন করেন কাজী সালাউদ্দীন আহমেদ। পেশাগত জীবনে তিনি স্থপতি; আর দীর্ঘ সময়ের শিল্পচর্চায় শহরের নানা জটিলতা, অসৌন্দর্য, কাল্পনিক বীভৎসতা—এসব দেখাতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ, নিমতলী অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি আর ১৯৭১ সালে আগুনে পোড়া পুরান ঢাকার ঘরবাড়ি সালাউদ্দীনের স্মৃতিতে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। অসচতনতা আর মানুষের অপরিকল্পিত নগরায়ণে শহরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে বিপর্যয়ের জীবাণু সঞ্চিত হয়ে আছে, তা–ই যেন তিনি দেখাতে চান শৈল্পিক ভাষায়।

এসবের বাইরে জীর্ণতার মধ্যে সৌন্দর্য খোঁজার পিপাসাও আছে তাঁর কাজে। শৈশবে দেখা উড়ন্ত ঘুড়ি এখন আর সূর্যের আলো ও মেঘের ছায়ায় মাটি স্পর্শ করতে পারে না। এই পরিবর্তনের, এই বিপর্যয়ের সংবাদই এ শিল্পীর কাজের মূল ভাষা। কাগজের ওপর অ্যাক্রেলিক রঙে তুলির টানটোন, তার মাঝখানে স্প্যাচুলার গতিপথে সাদা রেখাপাত একধরনের ধাতব অবকাঠামো জটিলতার আভাস দেয়। জ্যামিতিক ফর্মগুলো প্রায়ই ভাঙা, কখনো ক্ষীপ্র, কম্পমান, তীর্যক। বিমূর্ত, অর্ধ-বিমূর্ত ইমেজ হলেও আণুবীক্ষণিক স্থির দৃষ্টিতে প্রাসঙ্গিক বিষয় কল্পনা করে নিলে বাস্তবানুগ পাঠ নেওয়াও সম্ভব। বহুতলের মধ্যস্থ যে শূন্যতা, তা আরেকটি তল সৃষ্টি করে। এভাবেই অপরিকল্পিত নগরায়ণের জটিলতাকে প্রতীকী করে তোলেন সালাউদ্দীন।

‘ফল আউট/বিপর্যয়-৪’
‘ফল আউট/বিপর্যয়-৪’

কাজগুলোয় একাডেমিক অনুশাসন প্রয়োগের ধার ধারেননি এ শিল্পী। অবশ্য তাঁর শিল্পজগৎ তৈরিও হয়েছে একাডেমিক শিক্ষার বাইরের বলয় থেকে। উদাহরণস্বরূপ চিত্রে সেন্টার পয়েন্ট বা চুম্বক অংশের প্রসঙ্গটি অনেক কাজেই অনুপস্থিত। চিত্র-উপাদান বিন্যাসেও সুপরিকল্পিত নকশার গুণাবলি যথাযথভাবে উপস্থিত হয়নি। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ফর্মগুলো ঘিঞ্জি আবহ তৈরি করে। চিত্রজমিনে দাবি করা স্পেসের কমতি আছে। মোটকথা, স্বাধীনভাবে তুলি চালানোর বিষয়টি সহজেই অনুমেয়। কিন্তু এসবের মধ্য থেকেই নদী, নৌকা, যান্ত্রিক কাঠামো ধসে পড়া বহুতল ভবনের বীভৎসতা কিংবা সৌন্দর্য খুঁজে নেওয়া যায়।

সব মিলিয়ে সালাউদ্দীন তাঁর কাজে যে গভীর বৈজ্ঞানিক সত্যের কথা বলে যাচ্ছেন, তা অপরিকল্পিত নগরায়ণের বিরুদ্ধে একরকম প্রতিবাদও বটে।

লালমাটিয়ায় নব–উন্মোচিত ‘দ্বীপ গ্যালারি’তে মোস্তাফা জামানের কিউরেটিংয়ে ‘ফল আউট’ বা ‘বিপর্যয়’ শিরোনামের সালাউদ্দীন আহমেদের চিত্র প্রদর্শনীটি শুরু হয়েছে ১৩ অক্টোবর, চলবে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত।