শামসুর রাহমান অনূদিত মাও সে-তুংয়ের কবিতা

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

লিউপান পাহাড়ে

আকাশ অনেক উঁচু, মেঘমালা কেমন বিবর্ণ,
আমরা দেখছি বুনো রাজহংসীগুলি হচ্ছে অদৃশ্য দক্ষিণে।
যদি ব্যর্থ হই ওই মহাপ্রাচীরে
পৌঁছাতে তাহলে আমরা পুরুষ নামের যোগ্য নই,
আমরা যারা ইতিমধ্যে শত শত মাইল করেছি অতিক্রম।
লিউপান পাহাড়ের সুউচ্চ চূড়ায়
লাল পতাকারা
পশ্চিমা হাওয়ায় তরঙ্গিত, কী স্বাধীন।
আমরা ধরেছি হাত আছে দীর্ঘ দড়ি
আমরা কখন কক্ষে বাঁধব ধূসর ড্রাগনকে?

শাওশানে ফেরা

মনে পড়ে যাওয়া কোনো আবছা স্বপ্নের মতো
অনেক আগেকার পলাতক অতীতকে আমি অভিশাপ দিই—
আমার দেশের মাটি, কেটে গেছে বত্রিশটি বছর।
যখন স্বেচ্ছাচারী শাসকের কালো নখগুলি
ওপরে তুলে ধরছিল ওর চাবুক,
লাল পতাকা জাগ্রত করেছিল ভূমিদাসকে, হাতে যার টাঙ্গি,
তিক্ত বলিদান দৃঢ় অঙ্গীকারকে করে শক্তিশালী,
যা নতুন আকাশে চাঁদ আর সূর্যকে জ্বালিয়ে রাখার সাহস জোগায়
কী সুখী! আমি দেখছি ধান আর মটরশুঁটির তরঙ্গিত খেত,
আর দেখছি চতুর্দিকে সন্ধ্যার কুয়াশায় বীরদের ঘরে ফেরা।

পরির গুহা

গোধূলির গাঢ় দীর্ঘ ছায়ায়
দাঁড়ানো কী দৃঢ় পাইনের শ্রেণি।
বর্ণিল মেঘ উড়ে যায় দূরে, প্রশান্ত, দ্রুত।
অপরূপ রূপে প্রকৃতি নিজেকে
ছাড়িয়ে গিয়েছে পরির গুহায়।
বিপজ্জনক পাহাড় চূড়ায় সুন্দরীতমা
অনন্ত তার বৈচিত্র্যে করে বসবাস।
কমরেড কুও মোজোকে জবাব
চরাচরে ফেটে পড়ল দুরন্ত বৃষ্টি ঝড়,
তাই শাদা হাড়ের স্তূপ থেকে উঠে এল এক শয়তান।
বিভ্রান্ত সন্ন্যাসী ছিলেন না আলোর পরপারে,
কিন্তু বিদ্বেষপরায়ণ অপদেবরা ধ্বংসলীলায় মেতে উঠবেই।
সোনালি বানর দারুণ রোষে
ঘোরালো তার অতিশয় ভারী লাঠি
আর ফিরোজা পাথরের মতো আকাশ থেকে মুছে গেল ধুলো।
আজ, যখন আবার দূষিত কুয়াশা উঠে আসছে,
আমরা অভিবাদন জানাই সেই বিস্ময়কর্মা সুউচ্চ কুংকে।

টাপোটি

লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, নীল, নীলচে-বেগুনি, বেগুনি—
এই রঙিন ফিতে আকাশে দুলিয়ে নাচছে কি?
বৃষ্টির পরে রোদ ফিরে আসে তেরসা হয়ে
এবং পাহাড় আর গিরিপথ হয়ে যায় আরও গাঢ় নীল।
একদা এক উন্মত্ত যুদ্ধ বেধেছিল এখানে,
গ্রামের দেয়ালগুলি, বুলেটে বিক্ষত,
এখন পাহাড় আর গিরিপথটিকে দিয়েছে সাজিয়ে
এবং ওদের করেছে দ্বিগুণ সুন্দর।

মাও সে–তুং
মাও সে–তুং

সংগ্রহ ও টীকা: মাসুদুজ্জামান

১৯৭৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর চীনের সমাজতন্ত্রী নেতা মাও সে–তুং মারা যান। সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীজুড়ে সমাজতন্ত্র মতাদর্শী মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। তিনি কবিতাও লিখতেন। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে চীনের ভূমিকা বিরূপাত্মক হলেও মাও সে–তুং তখনো শ্রদ্ধেয় নেতা হিসেবে এ দেশের কবি-লেখকদের কাছে গুরুত্ব পেতেন। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন কবি শামসুর রাহমানও। সম্ভবত এ কারণেই মাও সে–তুংয়ের মৃত্যুর পর তাঁর পাঁচটি কবিতা তিনি অনুবাদ করেন। আর ওই অনূদিত কবিতাগুলো ছাপা হয় মাওয়ের মৃত্যুর তিন দিন পর, ১৯৭৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর, দৈনিক বাংলার সাহিত্য পাতায়।

অনুবাদক হিসেবেও শামসুর রাহমানের খ্যাতি অনন্য। তিনি সাধারণত তাঁর পছন্দের কবিদের কবিতাই অনুবাদ করেছেন। রাহমান অনূদিত কবিদের তালিকায় আছেন রবার্ট ফ্রস্ট, খাজা ফরিদ, পাবলো নেরুদা, হোর্হে লুই বোর্হেস, পল এলুয়ার, তাদেউশ রোজেভিচ, ই ই কামিংস, কাইফি আজমি এবং আরও অনেকে। শামসুর রাহমানের এসব অনুবাদের সমন্বয়ে ২০১১ সালে অনুবাদ কবিতাসমগ্র শিরোনামে প্রথমা প্রকাশন থেকে একটা বই বেরিয়েছে। তবে ওই বইতে মাও সে–তুংয়ের এই কবিতাগুচ্ছ সংকলিত হয়নি। সেই হিসেবে তাই কবিতাগুলো এখনো অগ্রন্থিতই রয়ে গেছে।

মাও সে–তুংয়ের এই কবিতাবলিতে তাঁর রাজনৈতিক বোধের সঙ্গে নন্দনবোধও অটুট। আবার শামসুর রাহমানের মতো কবির হাতে অনূদিত হওয়ার কারণে এগুলো হয়ে উঠেছে কাব্যগন্ধীও।

কবিতার বানানের ক্ষেত্রে সমকালীন বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।