ঠিকানা আমার চেয়েছ বন্ধু

>

আজকাল আর কেউ কাউকে চিঠি লেখে না, আকাশের ঠিকানায় মেইল করে। তবু একসময় তো ছিল ডাকযুগের সুবর্ণকাল। চিঠি লিখে সবাই প্রিয়জনকে মনের কথা বলত তখন। বিখ্যাত বিপ্লবী–লেখক–গায়ক–শিল্পীদের অন্তরঙ্গ কয়েকটি চিঠি নিয়ে এই লেখা।

অলংকরণ: শামীম আহমেদ
অলংকরণ: শামীম আহমেদ

কত চিঠি লেখে লোকে, অল্প বয়সে রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র পড়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়নি এমন কজন আছে! নিস্তরঙ্গ নদীতে ফুটফুটে জোছনা, বজরায় একাকী থাকতে থাকতে কবির স্বরক্ষয়, নেপথ্যে একলা দাঁড় টেনে যাওয়া মাঝির গানে অন্তরনিরুদ্ধ আবেগ আর এর সঙ্গে তাঁর বহুদিকাভিমুখী দার্শনিক ভাবনা। এরপর ডাকযুগের সুবর্ণকালে ইন্দিরা আর প্রমথ চৌধুরীর প্রেমপত্র। মন শান্ত করার জন্য লোকে আগে লিখত, মন উত্তাল হলে লিখত, হাতের লেখা দেখে বোঝা যেত উদ্বেগ, বোঝা যেত পরিশীলন, বোঝা যেত অশ্রুর দাগ। কত রহস্য ভেদ করে ফেলেছিল শার্লক হোমস হাতের লেখা দেখে, কোন লেখা ট্রেনে বসে লেখা (স্টেশনে আসামাত্র লেখার ভঙ্গি সুস্থির—দ্য নরউড বিল্ডার), কোন লেখা তড়িঘড়ি করে লেখা (কালির দাগ না শুকোতেই লেফাফায় ঢোকানো) ...আজকাল আর কেউ চিঠি লেখে না। আকাশের ঠিকানায় মেইল করে।

চিঠির বই খুলে বসেছিলাম কদিন আগে, শন আশারের সংকলিত লেটারস অব নোট। গ্রাউচো মার্ক্সের (কমেডিয়ান মার্ক্স ব্রাদারসদের অন্যতম) অসাধারণ চিঠি উডি অ্যালেনকে, হাস্যরস যাঁদের মধ্যকার সেতু। উনিশ শতকের ‘এলিফ্যান্টম্যান’কে নিয়ে তাঁর ডাক্তারের চিঠি, আমৃত্যু যিনি লন্ডন হাসপাতালের কক্ষে নির্বাসিত থেকে মায়ের ছবি এঁকে গেছেন, নিজের জীবন অর্থবহ ছিল এই আশ্বাস নিজেকে দেওয়ার জন্যই হয়তো। এলিফ্যান্টম্যানকে নিয়ে একটি মর্মান্তিক চলচ্চিত্র আছে, যার মূলমন্ত্র কত সহজে এবং সসম্মানে জীবনের তাবৎ গ্লানি বহন করে বেঁচে থাকা যায়, আমার খুব প্রিয় ছবি। টাইটানিক ডুবে যাওয়ার আগে পাঠানো শেষ বার্তা, ‘আমরা দ্রুত ডুবে যাচ্ছি, যাত্রীদের নৌকায় তোলা হচ্ছে।’ আত্মহত্যা করার আগে ভার্জিনিয়া উলফের হৃদয়বিদারক শেষ চিঠি, লেনর্দকে। ‘মারি দ্য কুইন অব স্কটস–এর শিরশ্ছেদের আগের রাতে লেখা শেষ চিঠি। ‘জ্যাক দ্য রিপার–এর কথিত চিঠি, ভাসমান পতিতার রক্তাক্ত বৃক্কসমেত, অজস্র ভুলভাল ঠাসা। ক্লেমেনটাইনের চিঠি চার্চিলকে। ক্যাথরিন হেপবার্নের চিঠি, স্পেন্সার ট্রেসিকে (এটা অবশ্য আগেই পড়েছি তাঁর জীবনীতে।)

বিয়োগাসহিষ্ণু অভিনেত্রী রেবেকা ওয়েস্ট কল্পবিজ্ঞানী এইচ জি ওয়েলসকে অসহ্য রাগে আত্মহত্যা করার হুমকি দিয়ে (‘আই রিফিউজ টু বি চিটেড আউট অব মাই ডেথবেড সিন’) আবার ফিরে ডেকে যে চিঠি লিখেছেন, সেটা অনায়াসে আমার চিঠি হতে পারত, আমার কণ্ঠস্বরে পড়ে গেলে বিন্দুমাত্র বেমানান হবে না। ‘তিন মাস আগেও আমাকে চাইতে, এখন চাও না মানে কী? আমার আর শান্তির মাঝখানে তুমি দাঁড়িয়ে আছ জানো...(তুমি) দিব্যি আমাকে শুনিয়ে দাও যে অবসেশন নিরাময়যোগ্য, আমার মতো মানুষ এক প্যাশন থেকে আরেক প্যাশনে সংরক্ত লাফ দেয়, যেইমাত্র একখানা ফসকে যায়, তক্তা আর কাঠের গুঁড়ির ওপর ছিটকে পড়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না এদের...যা আমি এত আন্তরিকভাবে এত নির্মলভাবে যাপন করছি তাকে তুমি সস্তা করে দিতে চাও—সেটা ভাবলেও আমার ঘেন্না ধরে...’ এই সব বলে। তারপর আবার ‘একেবারে যেন ছেড়ে দিয়ো না আমাকে, এই মাঝেমধ্যে লিখো। সেটুকু লেখার মতো করে তো পছন্দ করো আমাকে, নাকি? অথবা আমি নাহয় ভান করলাম নিজের কাছেই যে সেটা সত্যি।’

মৃত্যু নিশ্চিত জেনে দক্ষিণ মেরুর মাইনাস সেভেন্টি ডিগ্রি হিমশীতলতায় অভিযাত্রী রবার্ট স্কট শেষ চিঠি লিখে গেছেন তাঁর স্ত্রী আর দুই বছরের ছোট্ট ছেলেকে। এই চিঠিটি ও বড় বেদনার। স্কটের মৃত্যুর বহুদিন পর পাওয়া গিয়েছিল চিঠিটি। মেরুপ্রদেশের বরফ পাতিত করে, শীতল করে, এবং হিমেল করে যা সংরক্ষণ করে রেখে দিয়েছিল সে চিঠিতে, সেটা নিখাদ ভালোবাসা—এই নশ্বর জীবনের একটিই মানে।

গৃহযুদ্ধের পরে মুক্তিপ্রাপ্ত এক কৃষ্ণাঙ্গ দাসকে ওর মালিক আবার ফিরে গিয়ে তাঁর জন্য কাজ করতে অনুনয় করেছিলেন। সেই দাসের একখানা চিঠি আছে। যা পড়লে জন্ম-স্বাধীন মানুষের হৃৎস্পন্দন অনুভব করা যায়—কী এক প্রত্যয়ে ভরে ওঠে মন। শ্রুতলিপির মতো করে লেখা চিঠি, মালিক যে দুবার তাঁকে গুলি করেছিলেন সেটা মনে করিয়ে দিয়েও পরক্ষণে মালিকের ছেলেমেয়েদের কুশলজিজ্ঞাসা করতে ভোলেননি তিনি, লিখেছেন তাঁর স্ত্রীকে এখানে লোকে ‘মিসেস অ্যান্ডারসন’ ডাকে (যাঁরা ইন দ্য হার্ট অব দ্য নাইট দেখেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই সিডনি পয়টিয়েরের সেই অসাধারণ সংলাপ ভুলতে পারবেন না,‘দে কল মি মিস্টার টিবস!’), তাঁর সুন্দরী শিশুকন্যারা রোবারের গির্জাস্কুলে যায়, তিনি আর সেই মেয়েদের প্রভু-পুত্রদের লালসার স্বীকার হতে দেবেন না। আর সহানুভূতির স্বরেই লেখা, মালিকের এই ফিরে ডাকার জন্য তিনি কৃতজ্ঞ, কিন্তু মালিকের পিতা-প্রপিতামহ তাঁর পিতা-প্রপিতামহের প্রতি যত অবিচার করেছে সেকালে, সেই অকথ্য কাল যে গত হয়েছে তার কিছু প্রমাণ তিনি চান। প্রথম প্রমাণ হবে বত্রিশ বছর তিনি এবং তাঁর স্ত্রী মালিকের হয়ে যত ঘণ্টা কাজ করেছেন, এখন তিনি যেমন সাপ্তাহিক রোজগার করেন সেই নিরিখে সেই মাপে তাঁদের তত দিনের সেই মজুরি ফিরিয়ে দেওয়া, মালিক কি পারবেন সেটা?

শিল্পী ডোরা ক্যারিংটন ভালোবাসতেন ব্লুমজবারি গ্রুপের সমকামী লেখক লিটন স্ট্রেচিকে। সমকামিতার বিষয়টি উল্লেখ করলাম এ কারণেই যে ডোরা তারপরও তাঁকে উন্মাদের মতো ভালোবাসতেন আমৃত্যু। লিটন মারা যাওয়ার পর আত্মহত্যা করেছিলেন ডোরা। লিটনকে চিঠি লিখেছিলেন তিনি, ‘রৌদ্রের দিনে আমি তোমায় বড় বেশি চাই, তখন যেন আমায় ছেড়ে যেয়ো না। আমি তোমার বিরহ এই সব গুমোট বাজে বিচ্ছিরি দিনে বরং সইতে পারব।’ (লেটারস অ্যান্ড এক্সট্র্যাক্টস ফ্রম হার লেটারস ডায়েরিজ—ডোরা ক্যারিংটন) তিনি আরও লিখেছিলেন অসহনীয় টি–পার্টি থেকে সাইকেলে চেপে ফেরার সময় কেমন লাগত তাঁর—চারপাশের দৃশ্য গলে গলে যাচ্ছে, ল্যান্ডস্কেপের সব উপাদান এমনকি রাস্তার শিশুগুলো কি বুনো খরগোশগুলো কিংবা ঝোপের প্লোভার পাখিগুলো অবধি যেন বাঁকা হাসছে। এ যেন যে ট্রেন চলে গেছে স্টেশন ছেড়ে সেই ট্রেন ধরবার মতো ঊর্ধ্বশ্বাস (কিন্তু নিষ্ফল) ছুটে চলা। ব্লুমজবারি গ্রুপে এমন আরেক শিল্পীযুগল ছিলেন শিল্পী ভেনেসা বেল আর ডানকান গ্রান্ট (উভকামী)। এই সব আমৃত্যু নিষ্ফল চাওয়ার ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়গুলোতে ওঁরাও খুব চিঠি লিখতেন। আর লিটনকে লেখা ডোরার চিঠিগুলোতে থাকত ছোট ছোট স্কেচ—এই যে একপাল পোষা শূকর পাছায় প্যাঁচ খাওয়া লেজ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, টিলার ওপর বসে প্রান্তরের গান গাইছেন তিনি আর লিটন, বিড়াল ঘুমোচ্ছে বালিশে, ফায়ার প্লেসের পাশে ফুটবাথ নিচ্ছেন লিটন, গামগাছের মগডালে বসে আছেন ডোরা, যেন শূলে চড়ানো হয়েছে তাঁকে, চাঁদনি রাতে ফোর পোস্টার বেডটা বাগানে বিছিয়ে লিটন ঘুমোচ্ছেন আর পাখি-পেঁচা-কাঠবেড়ালিরা অবাক হয়ে দেখছে...ডেরার এই চিঠি আর ছবিগুলো শিল্পের সম্পদ হয়ে আছে।

কিন্তু এখন আমি যে চিঠির কথা বলব, সেটা দেখতে একদম অন্য রকম। পেনসিলে লেখা চিঠি। বারবার একটা বাক্যের ওপর আরেকটা একই বাক্য জড়িয়ে লিখে লিখে চিঠিটা তৈরি। দেখতে জোছনায় ফুটে ওঠা শিলালিপির মতো, দুর্বোধ্য ভাষা তার। ১৯০৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব হাইডেলবার্গের মানসিক হাসপাতালে এক মহিলা রোগিণী আসেন, দুরারোগ্য মানসিক ব্যাধি নিয়ে। প্রথমে ভাবা হয় এটা স্মৃতিভ্রংশ হওয়ার অসুখ, একটু সুস্থ হওয়ার পর ঘরে ফেরত পাঠানো হয় তাঁকে। সম্ভবত তখনো স্কিৎসোফ্রেনিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে আবিষ্কৃত হয়নি। এরপর আবার আসেন তিনি হাসপাতালে, এইবার অনপনেয় রোগে মানসিক আশ্রমে আমৃত্যু ভুগে চলে যাওয়ার জন্য। দীর্ঘদিন পর হাইডেলবার্গের সেই হাসপাতাল থেকে এই পেনসিলে লেখা চিঠিগুলো আবিষ্কৃত হয়, মহিলা দ্বিতীয়বার যখন এসেছিলেন তখনকার চিঠি, অসংখ্যবার প্রায় অনির্ণেয় হরফে একই বাক্য লেখা। স্বামীকে লেখা, ‘সুইটহার্ট কাম, কাম, কাম’। কেমন করে গভীর মতিচ্ছন্ন মানুষও কান্নাবাহী ডাক পাঠায় অন্তরে। এই চিঠিটি দেখার পর আমার মনে পড়েছিল লন্ডনের এক রাতের কথা। ওয়ার্ডে একজন মানসিক রোগিণীকে এনে রাখা হয়েছে সে রাতে, তাকে প্রায় বেঁধে রাখতে হয়। নইলে সে ছোটাছুটি করে, লন্ডনে তো রোগীর পাশে রাতে থাকার অনুমতি নেই। অতএব নির্দিষ্ট সময়ের পর রোগিণীর স্বামী বাড়ি ফিরে গেল। সেই স্বামী লোকটার নাম ধরা যাক ‘স’। সারা রাত রোগিণী পর্দার আড়াল থেকে ‘স’কে ডাকতেই থাকল, ওয়ার্ডের কেউ আর ঘুমোতে পারল না, পিত্তশূলে আক্রান্ত হয়ে আমি ছিলাম সে রাতে ওই ওয়ার্ডে।

‘বঁধু হে ফিরে এসো, আমার নিতিসুখ ফিরে এসো, আমার চিরদুখ ফিরে এসো, আমার সব সুখদুখমন্থন ধন অন্তরে ফিরে এসো’ শুনে কত কেঁদেছি, কতবার মনে হয়েছে ‘মেঘ ও রৌদ্র’র শেষে এই গানটির মতন আর হয় না। কিন্তু সে তো বিশ্বকবির হিরেচুনিপান্নার যত্নের মিশেলে তৈয়ার একেক পশলা বাক্য, অশ্রুগ্রন্থি যার নিয়ত গন্তব্য অথচ অশ্রু ধুয়ে যাওয়ার পরে যা অক্ষয় হয়ে থাকে তা রৌদ্র। যার ভাষা নেই, স্মৃতি নেই, ক্ষমতা নেই যে বাক্যের সৌধ গড়ে তোলে, ব্যাধির উর্ণাজালে যার চাহনি আচ্ছন্ন, তার একখানামাত্র বাক্যই সম্বল। কি শরণার্থী মানুষ, আরেকজন মানুষের কাছে!

ব্যক্তিগতভাবে আমার সবচেয়ে প্রিয় চিঠি মাস্টারদা সূর্যসেনের লেখা শেষ চিঠিখানা, বলা বাহুল্য সে চিঠি জগৎজয়ীদের সংকলনে ঠাঁই পায়নি, ‘আমার শেষ বাণী—আদর্শ ও একতা। ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার ওপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলছে। এই তো সাধনার সময়। বন্ধুরূপে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার এই তো সময়। ফেলে আসা দিনগুলোকে স্মরণ করার এই তো সময়...’। মৃত্যু যেখানে অবশ্যম্ভাবী (ফাঁসির ঘণ্টা পাঁচেক আগে লেখা চিঠিটা, ওঁর দাঁতগুলো তখন সব ভাঙা, নখগুলো সব তুলে নেওয়া) সেখানেও কেমন করে লেখা যায় এই মুহূর্ত সুন্দর, এ মুহূর্ত পরম! লেখা যায়, ‘তোমাদের জন্য দিয়ে গেলাম স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। আমার জীবনের এক শুভ মুহূর্তে এই স্বপ্ন আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। জীবনভর উৎসাহভরে এবং অক্লান্তভাবে পাগলের মতো সেই স্বপ্নের পেছনে আমি ছুটেছি। জানি না কোথায় আজ আমাকে থেমে যেতে হচ্ছে। লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে মৃত্যুর হিমশীতল হাত আমার মতো তোমাদের স্পর্শ করলে তোমরাও তোমাদের অনুগামীদের হাতে এই ভার তুলে দেবে, আজ যেমন আমি তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি।’ এই রিলে রেসের শেষে মাস্টারদার স্বাধীন ভারতবর্ষ, স্বাধীন বাংলাদেশ কাদের হাতে হস্তান্তরিত হয়েছে? মৃত্যুর আগে একটি সোনার ডিমের মতো ঝকঝকে নিটোল স্বপ্ন যিনি ঈশ্বরের আশীর্বাদসমেত আমাদের হাতে তুলে দিয়ে জীবন উৎসর্গ করলেন, অসহনীয় শারীরিক নির্যাতন সহ্য করলেন, মহাপাতকের মতো তাঁর শরীর সলিল সমাধিস্থ করা হলো, সেই ডিম ফুটে কী বের হয়েছে? কেমন বাংলাদেশ? সেই বাংলাদেশের মানুষদের অন্তরের কোনো প্রদেশেই কি এই আত্মদানকারী দেশপ্রেমিকদের নাম লেখা আছে? শুধুই নাম?