'পশ্চিমে তৈরি আধুনিকতার মডেলগুলো থেকে আমাদের বেরোতে হবে'

>

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ছবি : সাইফুল ইসলাম
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ছবি : সাইফুল ইসলাম

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্প-উপন্যাস ভিন্ন ধরনের। মৌখিক রীতির আদলে কথাসাহিত্য রচনা করেন তিনি। তাঁর সাহিত্যের নানা বিষয়-আশয় নিয়ে এই লেখকের সঙ্গে কথা বলেছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ

আলতাফ শাহনেওয়াজ: আপনার জন্ম ১৯৫১ সালে। কিন্তু আপনার প্রথম বই নন্দনতত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৬ সালে। বই প্রকাশ করতে এত দেরি হলো কেন?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আমি লিখি নিজের আনন্দের জন্য, বই ছাপাতে হবে, এ রকম কোনো ইচ্ছা থেকে নয়। বই বেরোনোর আগে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছি, একটি গল্পও লিখেছি। ১৯৭৩ সালে বিচিত্রায় ছাপা হওয়া ওই গল্পের নাম ছিল ‘বিশাল মৃত্যু’। এর আগে লিখেছি চিত্রকলার ওপর। বই লেখার আগে ভেবেছি, আমাকে অনেক প্রস্তুতি নিয়ে নামতে হবে। একটা বই মানুষের হাতে হাতে ঘোরে। পাঠক যদি কোনো দুর্বলতা খুঁজে পায়, ব্যাপারটা কেমন হবে? এ চিন্তায় বই ছাপতে উৎসাহী হইনি।

তা ছাড়া প্রকাশনার জগৎটা তখন সীমিত ছিল। অনেক ভালো লেখককেও প্রকাশকদের পেছন পেছন ঘুরতে হতো। বাংলাবাজার ছিল প্রকাশনার কেন্দ্র। আমি বাংলাবাজারে যাইনি, কারণ বই ছাপানোর ব্যাপারে আমার আগ্রহ ছিল না। যেদিন বাংলা একাডেমি থেকে আমাকে জানানো হলো, তারা একই মলাটে, একই বিন্যাসে ১০০টি বই ছাপাবে ভাষাশহীদ গ্রন্থমালা হিসেবে এবং আমাকে নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে লিখতে হবে, আমি আগ্রহী হলাম। এভাবেই বের হলো আমার প্রথম বই নন্দনতত্ত্ব।

আলতাফ: ১৯৭৩-এ খ্যাতনামা বিচিত্রা পত্রিকায় গল্প ছাপা হলো। এরপর আবার গল্প লিখতে শুরু করলেন নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। সৃজনশীল লেখালেখিতে এই দীর্ঘ বিরতির কারণ কী?

মনজুরুল: বিচিত্রায় গল্প ছাপা হলে প্রশংসা-সমালোচনা দুই-ই শুনলাম। মনে হলো, আরেকটু প্রস্তুতি দরকার। তাছাড়া ১৯৭৪ সালে শিক্ষকতা শুরু করলাম। প্রতিটা ক্লাসের আগে আমাকে তিন-চার ঘণ্টা পড়তে হতো। এমএ প্রিলিমিনারি ক্লাসে আমার চেয়ে বয়সে বড় ছাত্রও ছিলেন। ক্লাসে তৈরি না হয়ে গেলে তাঁরা কী ভাবেন, সে চিন্তাও ছিল। ’৭৬ সালে পিএইচডির জন্য কানাডায় চলে গেলাম। দেশে ফিরলাম ’৮১ সালে। হয়তো এসব কারণেই বিরতিটা দীর্ঘ হলো। তবে কানাডায় গিয়ে এক অর্থে আমার ভীষণ উপকারই হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারে আমি লাতিন আমেরিকার সাহিত্য-খনির সন্ধান পেলাম। একটা কোর্সও নিলাম ওই সাহিত্যের ওপর। এই সাহিত্য পড়ে তিনটি বিষয়ে আমি সচেতন হলাম, এ সময় লিখিত সাহিত্যে মৌখিক সাহিত্যের প্রভাব; আধুনিকতার পুনর্বিন্যাস এবং সাহিত্যে সমসাময়িক ইতিহাসের বলিষ্ঠ উপস্থিতি।

আলতাফ: আমাদের অধিকাংশ লেখকের লেখালেখিতে হাতেখড়ি কবিতার মাধ্যমে। আপনারও কি তাই? লেখালেখির শুরুর দিনগুলো মনে পড়ে?

মনজুরুল: শিক্ষিত বাঙালির সাহিত্য প্রয়াস সাধারণত কবিতা দিয়েই শুরু হয়। আমিও যে লিখিনি, তা নয়, তবে কবিতা আদতে লিখেছি বন্ধুদের সঙ্গ দেওয়ার জন্য। কবিতা নিয়ে আমার কোনো উচ্চাশা ছিল না। আর লেখালেখির শুরুর কথা বলতে হলে বলব যে গল্প লিখেছি আদিষ্ট হয়ে, বাবার কারণে। ’৬১ সালে বাবা ছিলেন ময়মনসিংহের শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে, শিক্ষক সমাচার নামে সেখান থেকে একটা ম্যাগাজিন বের হতো। সেই ম্যাগাজিনের শিশু-কিশোর বিভাগের জন্য তিনি লেখা চেয়ে চিঠি পাঠালেন। পিতৃ-আদেশ মেনে লিখতে হলো আমাকে। আমাদের বাসায় শিশু-কিশোরদের জন্য প্রকাশিত বেশ কিছু বই ও ম্যাগাজিন ছিল। সেগুলো আনন্দ নিয়ে পড়তাম। ফলে গল্পটা লিখতে অসুবিধা হলো না। অসুবিধা যা হলো, বাবা এরপর বললেন, শিশু-কিশোরদের ম্যাগাজিন রংধনুতে লেখা পাঠাও। কলেজে ওঠার পর বললেন, মাহে নও পত্রিকায় লেখা পাঠাও। এ পত্রিকায় তখন লিখতেন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আলাউদ্দিন আল আজাদ ও আবুল হোসেনের মতো লেখকেরা। এখানে আমার দুটি লেখা বের হয়েছিল। প্রতিটি লেখার জন্য ১৫ টাকা করে দিত।

আলতাফ: বাংলাদেশের অন্যান্য লেখক-সাহিত্যিকের চেয়ে আপনার লেখনশৈলী খানিকটা ভিন্ন। এভাবেও বলা যায়, যে আঙ্গিককে অবলম্বন করে আমাদের দেশের লেখকেরা গল্প-উপন্যাস লিখছেন, সেই লিখিত আঙ্গিকে আপনি লেখেন না। আপনার লেখনকৌশল কথ্যরীতির কাছাকাছি। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?

মনজুরুল: এভাবে বললে মনে হবে, আমি বোধ হয় আমাদের লিখিত সাহিত্যের ঐতিহ্যকে অবহেলা করছি। বিষয়টি মোটেও তা নয়। এই ঐতিহ্যে সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই আমি নতুন একটি আঙ্গিক খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেছি, যে আঙ্গিকটি আসলে নতুন নয়, হাজার বছরের পুরোনো। এবং সেটি আমাদের গল্প বলার, বয়ানের, কথনের ঐতিহ্য। আমার মনে হয়েছে, এই ঐতিহ্য বা ধারায় অনেক স্বাচ্ছন্দ্য আছে, স্থিতিস্থাপকতা আছে, আত্ম-প্রতিফলনের সুযোগ আছে, পাঠকের সঙ্গে নৈকট্য সৃষ্টির, বস্তুত পাঠককে হাতে ধরে গল্পযাত্রায় শামিল করার সম্ভাবনা আছে।

আমাদের লিখিত ঐতিহ্য পশ্চিমের কাছে ঋণী এবং পশ্চিমের আধুনিকতার অনুসারী। ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণ এবং পশ্চিমা যন্ত্র ও নগরকেন্দ্রিক বাস্তবতা যখন লেখকদের একদিকে ব্যক্তির মনস্তত্ত্বের গভীর জটিলতায়, অন্যদিকে সভ্যতার স্খলন ও বৈকল্যে মনোযোগী করল, তখন বিষয় ও শৈলীচিন্তায় তার প্রতিফলন ঘটল। প্রকাশে বিমূর্ততা এল, ভাষা জটিল হলো, শব্দের আর উৎপেক্ষা-প্রতীকের কারুকাজ বাড়ল। কিন্তু পশ্চিম–কেন্দ্রিক জ্ঞানতাত্ত্বিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও যুক্তিতর্কের যে ঐতিহ্য, তা কি আমাদের ছিল? না। প্রথম মহাযুদ্ধের পর এই বাস্তবতার দেখা এ ভূখণ্ডে মেলে বটে, তবে তা আমাদের বাস্তবতাকে পরিপূর্ণভাবে প্রতিফলিত করে বলে আমি মনে করি না। আমাদের দিনযাপনে একটু আবেগধর্মী চিন্তাভাবনা কাজ করে, যুক্তিতর্কের ধার আমরা সব সময় ধারি না। তাহলে আধুনিকতার কোন প্রকাশ নিয়ে আমরা কাজ করছি? আমার তো মনে হয়, পশ্চিমের আধুনিকতার একটা বাংলাদেশি বা পশ্চিমবঙ্গীয় সংস্করণ আমরা তৈরি করেছি। এটা ভালো কি মন্দ, তা অন্য বিবেচনা। এই আধুনিকতার প্রকাশে অনেকে স্বকীয়তা দেখিয়েছেন, উতরে গেছেন। তাঁরা মেধাবী। কিন্তু দিনযাপনের প্রাত্যহিকতা ও সমাজ বাস্তবতাকে এই পশ্চিমা চাদর দিয়ে ঢেকে দিলে তাতে একটা মেকিত্ব থেকে যায়।

আলতাফ: মেকিত্ব বলতে কী বোঝাচ্ছেন?

মনজুরুল: পশ্চিমা ঐতিহ্যের আধুনিকতা-ভাবনা আর আমাদের ঐতিহ্য ও বাস্তবতার মাঝখানের যে ফাঁকটা তাতে জেগে থাকে, তাকেই ‘মেকিত্ব’ বলে বোঝাতে চাইছি। জীবনের ভেতরে ঢুকে গেলে একজন প্রুফ্রক বা স্টিভেন ডিডেলাসের মতো আমাদের ‘আধুনিক’ মানুষের আবেগ-অনুভূতিগুলো ঠিকই হয়তো পাওয়া যায়, কিন্তু ‘লেখকসুলভ’ ভাষায় যখন তা প্রকাশিত হয়, তখন তা আড়ষ্ট হয়ে ওঠে অথবা ওঠার আশঙ্কা থাকে। একসময় তৎসম-তদ্ভব শব্দের সংস্কৃতনির্ভর একটা প্রকাশভঙ্গি আমাদের ছিল। এখন অবশ্য অনেকটা দূরেই আমরা সরে গিয়েছি। ১৯৪৭ সালের পর বাংলা ভাষা আবশ্যিকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমাদের দূরত্ব বেড়েছে। এটা অবশ্যই ইতিবাচক হয়েছে। এরপরও অনেক তরুণকে ভাষায় নিজস্বতা আনয়নে সচেষ্ট হতে দেখি না। এর ফলে হচ্ছে কি, অনেকে যা বলতে চাচ্ছেন, তা পাঠকের কাছে যাওয়ার আগে তার ওপর একটা পর্দা পড়ে যাচ্ছে। আধুনিকতার চর্চায় যে বিষয়বস্তুগুলো দীর্ঘদিন ধরে আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে বা প্রকাশভঙ্গির যেসব জটিলতা জমে উঠছে, সেগুলো চলে আসছে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে পশ্চিমে তৈরি আধুনিকতার মডেলগুলো থেকে আমাদের বেরোতে হবে।

শুরু থেকে আমি ভেবেছি, আমাদের গল্প বলার ঐতিহ্যে অনেক মণিমুক্তা যে লুকানো, তার দু–একটা পেলেই তো অনেক প্রাপ্তি হয়ে যায়। সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ভালো হোক, মন্দ হোক, আমি নিজের মতো একটা পথ খুঁজে নেব। সে পথটা এসেছে মৌখিক সাহিত্যের মধ্য দিয়ে। আমি এর ভেতরেই বড় হয়েছি। ছোটবেলায় পুঁথিপাঠ শুনেছি। পুঁথি আবার মুখস্ত রাখার বিষয়। মানে এটা লিখিত, আবার কথ্য—এ দুইয়ের এক সম্মিলন, চমৎকার। প্রকাশের এই স্থিতিস্থাপকতাটা আমি খুঁজছিলাম। দেখলাম, আমি এই ঐতিহ্যে অনায়াসে ঢুকে পড়তে পারি। একই কণ্ঠ আমি তিনভাবে বাজাতে পারি এবং আমি যা বলতে চাইছি, সেটি পুনরাবৃত্ত হলেও কথ্য সাহিত্যে যেহেতু পুনরাবৃত্তি আছে, ওই মাপে, ওই দাবিতে এটা গ্রহণযোগ্যও হয়ে যায়। আমি যদি কোনো চরিত্রের নাম ভুলে যাই, আমাকে সে জন্য কেউ গালমন্দ করবে না। একজন কথকের অবস্থানে থেকে যখন আমি গল্পটা বলছি, তখন তাদের মতো একটা স্বাধীনতা আমি পেয়ে যাই। আমার মনে হয়, এই ঐতিহ্যকে আমরা সঠিকভাবে অনুসন্ধান করিনি, প্রয়োগের কথা তো পরে আসে।

আলতাফ: আপনি বলছেন, আধুনিক লিখিত সাহিত্যে একটা মেকিত্ব থেকে যায়। তবে আপনি যখন কথ্য সাহিত্যের ঐতিহ্যকে লিখিতরূপে আনেন, তখন কি সেখানে মেকি ভাব আসে না?

মনজুরুল: চমৎকার প্রশ্ন। উত্তর হলো, অবশ্যই আসে। মেকিত্ব আসে তখনই, যখন কথ্য সাহিত্যের ঐতিহ্যকে একটা অপরিবর্তনশীল ধ্রুব ভেবে একমাত্র এর শর্তেই আমরা লিখে যাই। মনে রাখতে হবে, প্রথমত ওই ঐতিহ্যে অনেক পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়েছে; সময় ও সমাজ বাস্তবতার দাবি মানতে গিয়ে এর মনন ও মেজাজে অনেক অদল–বদল হয়েছে। আমাদের কথ্য সাহিত্যের পেছনেও চিন্তার অনেক খেলা আছে। এটা ভাবলে ভুল হবে যে কথক-গায়েনরা আধুনিক নন। গ্রামের একজন কথকের ভেতরেও জীবন নিয়ে জিজ্ঞাসা আছে, গভীরতা আছে। তিনি অনুসন্ধানও করেন তাঁর মতো করে। এখন আমি যদি আমার জীবনকে পশ্চিমের কাঠামোয় ফেলে বিচার করি, তাহলে মেকিত্ব থেকেই যাবে। আবার কিছু বিপদ আমারও আছে। আমার লেখায় পুনরাবৃত্তি আছে, অতিরঞ্জন আছে, পাঠকের সঙ্গে দূরত্ব মোচনটা অনেক সময় একটা ভঙ্গি হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তবে আমি বিশ্বাস করি, মাঝেমধ্যে এ ধরনের বিপদ আমাকে নতুন করে ভাবতে এবং প্রকাশের নতুন পথ খুঁজে নিতে সাহায্য করে।

আলতাফ: লেখক, পাঠক, সমালোচক ও শিক্ষক—নানাবিধ পরিচয়ে বেশ অনেক বছর ধরে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যকে পর্যবেক্ষণ করছেন আপনি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কথাসাহিত্য নিয়ে কী বলবেন?

মনজুরুল: ১৯৭১ আমাদের বদলে দিয়েছে। আমাদের এমন কিছু বিষয়–আশয় দিয়েছে, যা আমাদের সৃষ্টিশীলতাকে সক্রিয় করেছে। আমরা নিজেদের ভাষা খুঁজে নিয়েছি, নিজেদের মতো করে লিখেছি, একটা অপ্রতিরোধ্য অবস্থানও তৈরি করেছি। এবং তাতে অবদান রেখেছেন ষাটের দশকের প্রতিভাবান লেখককুলসহ সত্তর দশক এবং তার পরে যাঁরা আত্মপ্রকাশ করেছেন, তাঁদের অনেকে—শহীদুল জহির থেকে আন্দালিব রাশদী হয়ে শাহ্​নাজ মুন্নী অথবা সাদিয়া মাহ্​জাবীন ইমাম পর্যন্ত। (এই তালিকায় আরও কুড়ি–বাইশটা নাম যোগ করা যায়, স্থানাভাবে সম্ভব নয় বলে মার্জনাপ্রার্থী)। আর এই সময়ের সাহিত্যের প্রবণতা নিয়ে মোটাদাগে যদি বলতে হয়, বলব যে এখন খোলা ও নিরীক্ষাপ্রবণ মন নিয়ে অনেক তরুণ লিখছেন। আবার যথেষ্ট প্রস্তুতি না নিয়েও লিখছেন কেউ কেউ। আধুনিকতার এই শেষ সময়ে এসে লেখার মতো অনেক কিছুই পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের কথাসাহিত্যে আমি যে বিষয়টা পাচ্ছি না, তা হলো একটা সূক্ষ্ম রসবোধ। তা ছাড়া আমাদের একটা বড় দুর্বলতা হলো সাহিত্য সমালোচনার অভাব।

আলতাফ: সাহিত্য সমালোচনা সেভাবে হচ্ছে না কেন?

মনজুরুল: একটা ভূখণ্ডে সাহিত্য সমালোচনা তখনই দাঁড়ায়, যখন ওই দেশের মানুষ সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত হয়। অর্থাৎ তারা শিক্ষার সংস্কৃতিকে খোলা মন নিয়ে গ্রহণ করতে পারে। তাদের হাতে, তাদের বাড়িতে বই থাকে। পাঠকেরা সচেতন হয়, তুলনামূলক বিচার করতে পারে। আমাদের দেশের পাঠকসমাজ কি তেমন হতে পেরেছে? পরিশ্রমী সমালোচকের ভীষণ অভাব। একজন আবদুল মান্নান সৈয়দের মতো সমালোচক এখন তেমন দেখতে পাই না। অন্যদিকে যাঁরা সমালোচনা করছেন, তাঁদের কারও কারও মধ্যে তাত্ত্বিক শৃঙ্খলারও অভাব রয়েছে।

আলতাফ: আপনার মধ্যে একধরনের মজার ব্যাপার আছে: আপনি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ, তবে গল্প-উপন্যাস লিখেছেন দেশীয় ঐতিহ্যে। এই বৈপরীত্ব সম্বন্ধে কী বলবেন?

মনজুরুল: বাংলা অঞ্চলের নিজস্ব শিক্ষাপদ্ধতি ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে চলে গেছে অনেক আগে। পশ্চিমা শিক্ষা গ্রহণ করতে আমরা বাধ্য হয়েছি। একটা অস্বচ্ছ পশ্চিমা দেয়ালের ভেতরেই আমাদের শিক্ষা, গবেষণা, শহুরে সংস্কৃতি, বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদির ঘোরাফেরা। আমি এই দেয়ালের আড়াল থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেছি এবং আমাকে সাহায্য করেছে বাঙালিয়ানার ঐতিহ্য। পশ্চিম থেকে অবশ্য যতটা নেওয়া সম্ভব, আমি নিই, তবে চেষ্টা করেছি নিজের শর্তে নেওয়ার। কতটা পেরেছি, জানি না।

আলতাফ: লিখছেন দীর্ঘদিন ধরে । বাংলা একাডেমি, একুশে পদকসহ পেয়েছেন নানা পুরস্কার ও সম্মাননা। কোনো অপ্রাপ্তি কি আছে আপনার?

মনজুরুল: আমার কোনো অপ্রাপ্তি নেই। বরং দেওয়ার চেয়ে পাওয়াটা যেন একটু বেশি ঘটে গেছে; সেটা হয়তো একজন শিক্ষক হওয়ার জন্য।