জ্যাজ ফেস্টের মাইফেলে

কিউবার জ্যাজ ব্যান্ড ‘মেকেকে’–এর সেই পাঁচ তরুণী, যাঁদের পরিবেশনা মুগ্ধ করেছিল শ্রোতাদের
কিউবার জ্যাজ ব্যান্ড ‘মেকেকে’–এর সেই পাঁচ তরুণী, যাঁদের পরিবেশনা মুগ্ধ করেছিল শ্রোতাদের
>গেল সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সাভানা শহরে হয়ে গেল জ্যাজ ফেস্টিভ্যাল। সেই জলসায় যেমন ছিল সংগীতের সুধা, তেমনি দেখা গেছে হরেক মানুষের মুখাবয়ব।

সাভানা শহরের ফরসাইত পার্কটির চারপাশের প্রতিটি সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে মোটর চলাচল। সংগীতপ্রিয় মানুষ চঞ্চল পায়ে এসে ঢুকছেন নগরীর সাবুজিক পরিসরে। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যের বসতবাড়িতে ভরপুর এ শহরে আজ ২৯ সেপ্টেম্বর সমাপ্ত হতে যাচ্ছে সপ্তাহব্যাপী জ্যাজ ফেস্ট। আজকের সান্ধ্যানুষ্ঠানের বিরাট মাইফেলটি বসেছে মণ্ডপের মতো একটি মঞ্চকে ঘিরে, ঘাসের চত্বরে। সমঝদারেরা ইতিমধ্যে ওখানে বসে পড়েছেন কম্বল বিছিয়ে। কেউ কেউ নিয়ে এসেছেন হালকা গার্ডেন চেয়ার। সাজিয়ে রাখছেন শুকনো খাবার ও নানাবিধ পানীয়ের শিশি-বোতল। আমেরিকার মিলিটারি ব্যান্ডের বাদকরা টিউন করে নিচ্ছেন তাঁদের যন্ত্রপাতি।

এই কর্মযজ্ঞে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছে শ্রোতাদের সঙ্গে ইনফর্মালি কথাবার্তা বলে অনুষ্ঠান কেমন হলো এ বাবদে মন্তব্য সংগ্রহ করা। এ জরিপে আমি চেষ্টা করছি তাঁদের অনুভূতিকে ধারণ করতে। তো, বাদ্যবাজনার শোরগোল জমে ওঠার আগেই কাজে নামি। ময়দানের ঘাসে বসে পড়া জমায়েতকে এক পাশে রেখে উঠে আসি পার্কের পুরোনো ওকগাছে ছায়াচ্ছন্ন সরণিতে। পিচঢালা সড়কজুড়ে আর্ট স্কুলের ছেলেমেয়েরা এঁকে চলছে আলপনা।

আমি দাঁড়িয়ে পড়ে জানতে চাই, সংগীতের সঙ্গে চিত্রকলা সম্পর্ক কী? ভুরুতে রুপালি আংটি বাঁধা একটি মেয়ে আঁকাজোখা থেকে চোখ তুলে জবাব দেয়, ‘ইউ নো ভিজ্যুোল আর্ট ইজ হাউ টু ডেকোরেট দ্য স্পেস, অ্যান্ড দ্য মিউজিক ইজ হাউ টু ডেকোরেট দ্য টাইম। আজ আমরা জ্যাজ শুনতে শুনতে তুলি চালিয়ে মেলবন্ধন ঘটাচ্ছি টাইমের সঙ্গে স্পেসের।’ আমি নোট নিতে নিতে ‘দিস ইজ ভেরি ইমপ্রেসিভ’ বলে মন্তব্যটির তারিফ করে আগ বাড়তে যাই। নিরাভরণ ঊরুতে ঝংকারের প্রতীক উলকি করা একটি মেয়ে ফিক করে হেসে বলে, ‘উই আর কুল, কাম ব্যাক, পেইনটিং শেষ হলে আমরা কিন্তু ড্যান্স করব। লাইফ ইজ বিউটিফুল।’ বক্তব্যে শেষাংশের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করে আগ বাড়ি আমি।

ফরসাইত পার্কে জ্যাজ সংগীতের জলসায় সাদা–কালো হরেক মানুষের সমাগম। ছবি: লেখক
ফরসাইত পার্কে জ্যাজ সংগীতের জলসায় সাদা–কালো হরেক মানুষের সমাগম। ছবি: লেখক

আমার সামনে দিয়ে কুকুরের বকলশ ধরে সাদা লাঠি ঠুকে আগুয়ান হচ্ছেন মাথায় স্ক্যালক্যাপ পরা এক অন্ধ ইহুদি দম্পতি। সঙ্গে কানে ইয়ারফোন লাগানো দুটি যমজ সন্তান। শিশু দুটিও অন্ধ। অন্ধ পরিবারটির প্রত্যেকের চোখে পরা সানগ্লাসে ঝলসাচ্ছে বেলা শেষের উষ্ণ রোদ। মিলিটারি ব্যান্ডের বাদনে ছড়াচ্ছে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সুরধ্বনি। স্ক্রিনে ডিজিটালি দেখানো হচ্ছে লড়াইয়ের ময়দানে সৈনিকের মৃতদেহ ফেলে রেখে ঘরে ফেরা অশ্বের ইমেজ। আন্দাজ করি, যেসব পিতামাতা যুদ্ধে সন্তান হারিয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ এসে হাজির হয়েছেন আজকের জ্যাজ মিউজিকের জলসায়।

 এসে পড়ি জল উৎসারিত শ্বেতপাথরের ফোয়ারাটির চাতালে। প্রৌঢ়ত্বের প্রান্তিকে চলে আসা একটি যুগল বিয়ের জমকালো পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছেন ফুলের সাজি হাতে নিয়ে। ওঁদের সঙ্গে টুকটাক কথা বলি। দুজনেই অতীতে বিবাহিত হয়েছেন একাধিকবার। ডিভোর্সি হিসেবে হপ্তাজুড়ে জমানো জ্যাজ শুনতে এসে দেখা হয়েছে তাঁদের। চতুর্থ দিনে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ফের শুভবিবাহের। গতকাল দুপুরে বুটিকশপ থেকে খরিদ করেছেন স্যুট ও কনেশোভন–শুভ্র ব্রাইডাল ড্রেস। কোনো পুরহিত বা ইয়ারবক্সি ছাড়া নিজেদের মতো করে দুজনে বিবাহিত হয়েছেন একটু আগে। কৈশোরে এঁরা খোয়াব দেখতেন জাজের মাইফেলের সুরতালে উদ্বেলিত হয়ে লেনদেন করবেন হৃদয়ের। ঘটনাটি আজ ঘটল, এ আবেগের অভিব্যক্তি হিসেবে তাঁরা পরস্পরকে চুম্বন করেন।

তাঁদের মিথস্ক্রিয়া যতই প্রাইভেট হোক, আমাকে কিন্তু জাজবিষয়ক একটি সওয়াল করতেই হয়। জানতে এ পরিণয়ের স্থায়িত্বের ওপর জ্যাজ শোনার স্পৃহা প্রভাব ফেলবে কি? জানতে চাই। কনেবউটি হেসে জবাব দেন, ‘ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড আ জ্যাজ মিউজিক লাভার ইজ আ পার্সন উইথ প্যাশন। আমার স্বামীপ্রবরটি প্যাশোনেট পুরুষ, আই উড লাইক টু গিভ ইট আ ট্রাই।...নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, সফট জাজের ঝংকারে সমাচ্ছন্ন হয়ে আজ রাতে লাভ মেকিংয়ে মশগুল হতে।’ আকাঙ্ক্ষাটি সর্বশাস্ত্রে স্বাভাবিক, তাই এ বাবদে আর কোনো প্রশ্ন না করে আগে বাড়ি। দম্পতির পুরুষটি ফটোগ্রাফ তোলার ড্রোনের রিমোটে হাত দেন। ড্রোনটি জায়েন্ট সাইজের পোষা গঙ্গাফড়িংয়ের মতো উড়ে এসে নিউলি ম্যারিড কাপলের ছবি ওঠায়।

জ্যাজ ফেস্টিভালকে কেন্দ্র করে পিচঢালা সড়কে আর্ট স্কুলের ছেলেমেয়েরা এঁকে চলছে আলপনা। ছবি: লেখক
জ্যাজ ফেস্টিভালকে কেন্দ্র করে পিচঢালা সড়কে আর্ট স্কুলের ছেলেমেয়েরা এঁকে চলছে আলপনা। ছবি: লেখক

ব্যান্ড এবার চুটিয়ে বাজাচ্ছে লোকপ্রিয় একটি জ্যাজ লিরিকের টিউন। শুনতে গিয়ে কথাগুলো অবধারিতভাবে চলে আসে মনে, ‘হোয়েন আই গ্রিউ আপ, অ্যান্ড ফল ইন লাভ, আই আস্কড মাই সুইটহার্ট হোয়াট লাইজ এহেড? উইল উই হ্যাভ রেনবো ডে আফটার ডে?’ রংধনু ঠিক দৃশ্যমান হয় না বটে, তবে পার্কের প্রান্তিকে সড়কের ওপারে ভিক্টোরিয়ান কেতার একটি রানডাউন বাড়ির সামনে এসে আমার ক্যাসিনোতে জ্যাকপট পেয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। সিঁড়িতে ভিজিবল হালতে দর্শন দিচ্ছেন আফ্রো-ক্যারিবিয়ান জাজের একটি নাগরিক–নন্দিত ব্যান্ডের তাবৎ নারীকুল। তাঁদের মধ্যমণি হয়ে বাদ্যযন্ত্র হাতে স্মার্টফোনে ছবি তোলা তামেশগিরদের দিকে তাকিয়ে আছেন কানাডার মশহুর, সপ্রানো কণ্ঠের গায়িকা, সেক্সাফোনিস্ট জেন বনেট। কিউবার পাঁচটি যুবতীকে নিয়ে ‘মেকেকে’ নামে ব্যান্ড বেঁধেছেন তিনি। এঁরা ইতিমধ্যে চারবার জুমো অ্যাওয়ার্ডে পুরস্কৃত হয়েছেন। দুবার গ্রামি এওয়ার্ডের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে তাঁদের নাম। ছবি তুলতে তুলতে জটাজুটে মেকি সাপ জড়ানো এক পাড় সমঝদার আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘মেকেকে মিনস এনার্জি অব ইয়াং গার্ল স্পিরিট...নজর করে দেখো কী রকম কিলার ক্যাটাগরির যুবতীদের ব্যান্ডে নেওয়া হয়েছে।’

স্টেজের পেছন দিকের দালানে তৈরি হয়েছে গ্রিনরুম। আমি কাচের সুয়িং ডোর ঠেলে ঢুকে পড়ি সোডামেশিন থেকে একটি কোল্ড ড্রিংকস কিনতে। কাছ থেকে চৌকস চেহারার এক নারী কান্নামেশানো গলায় হিস্পানি ভাষায় বলে ওঠেন, ‘মি কানতানতে ফাবরিতাবা আমার প্রিয় সংগীতশিল্পী!’ তাঁর পুরুষ সঙ্গীটি সঙ্গে সঙ্গেই ধুয়া দেন, ‘ওহ লর্ড, ইউ আর রাইট!’ সোডাপাপ হাতে আমি চলে আসি ভেতর দিককার খোলা বারান্দায়। ওখানে গ্রান্ড পিয়ানোতে বসে আছেন শুভ্র চুল–দাঁড়িতে অভিজাতদর্শন চক লেভেল। কিংবদন্তিপ্রতিম এই পিয়ানোবাদক এক জামানায় রক ব্যান্ড ‘রেলিং স্টোন’–এ চুটিয়ে গান করতেন। তাঁকে চাক্ষুষ দেখা তীর্থমন্দিরে এসে মহাযোগী কোনো সন্ন্যাসীর সাক্ষাৎ পাওয়ার সমার্থক। সিনিয়র এ শিল্পীকে নিশানা করে খানেক তফাতে দাঁড়িয়ে পড়েছে মিডিয়ার ক্যামেরাবাজরা। একটু আগে দর্শনে মুগ্ধ হয়ে পড়া যুগলটি বেএখতেয়ার হয়ে চলে যান পিয়ানোর সামনে। তাঁরা তাঁদের জোড়া দেহখানি ব্যাপক আকারের গলদা চিংড়ির মতো বাঁকিয়ে বেহদ পুলকে নৃত্য করে ওঠেন। উল্লাস প্রকাশের অ্যায়সা শারীরিক তরিবতে রীতিমতো ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাই আমি!

মঞ্চে হরেক রকমের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে চলেছেন বার্নি উইলিয়ামসের সহশিল্পীরা। আর বার্নি যেন মেঘভাসা আকাশের দিকে তাকিয়ে খুঁজছেন দিব্য প্রেরণা। বেসবলের এ সুপার হিরো কিছুদিন আগে ক্রীড়াজগৎকে আলবিদা বলে বেরিয়েছেন মিউজিক ট্যুরে। বাদ্যবাজনার জলস্রোতে তরণি ভাসানোর মতো স্মুথভাবে লিরিকটি তিনি ছড়িয়ে দেন সামনের সবুজ ময়দানে। ঘাসে ইজেল দাঁড় করিয়ে জলসার চিত্র আঁকছিলেন দাড়িগোঁফে সাধুসন্তের মতো দেখতে এক চিত্রকর। নিজের আঁকা থামিয়ে তিনি বলেন, ‘দেখো বার্নি কেমন মসৃণ ভঙ্গিতে টিউনের মেলোডি লাইন দিয়ে সংগীতের শুরুয়াত করলেন। তারপর এ চরণটি ইমপ্রোভাইজ করতে করতে...ফিরে ফিরে গেয়ে সৃষ্টি করছেন সুরব্যঞ্জনার অভিব্যক্তি।’

ঘাসে বিছানার চাদর বিছিয়ে বসেছে অন্ধ পরিবারটি। তাদের কুকুরটি হাঁপাচ্ছে জিব বের করে। স্ক্যালক্যাপ পরা পুরুষটি তাওরাত কিতাবের স্ক্রল হাতে দুলে দুলে করছেন প্রার্থনা। স্টেজে ফ্লোরিডার একটি জ্যাজ অ্যানসাম্বল ছড়াচ্ছে রীতিমতো ‘ফ্লেমিং ভাইব’বা সংগীতের জলন্ত স্পৃহা। গোধূলির আভায় সপ্তশিল্পীর হাতে স্বর্ণাভ দ্যুতি ছড়াচ্ছে সেক্সোফোন, ট্রাম্পেট ও ট্রামবোন। জনা কয়েক শ্রোতা দাঁড়িয়ে পড়ে শরিক হচ্ছেন ড্যান্সে। বাদন ক্রমশ উতরোল হচ্ছে, আর দখিনা হাওয়ায় তরুপল্লবের মতো লীলাচঞ্চল হচ্ছে মানুষের নৃত্যায়িত দেহরাজি। অন্ধ বাচ্চা দুটিও শামিল হয় সমবেত নৃত্যে।

ময়দানের নিরিবিলি কর্নারে রেড ওয়াইন, ক্রেকার ও চিজ নিয়ে বসেছেন মাঝবয়সী দুই নারী। কথাবার্তায় জানতে পারি, স্কুলজীবনের বান্ধবী তাঁরা, একসঙ্গে যেতেন জ্যাজ কনসার্ট শুনতে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে ভিন্ন ভিন্ন দুই পুরুষকে বিয়ে করে তাঁদের জীবন বয়েছিল অন্য খাতে। ওঁদের বাচ্চাকাচ্চারা কলেজ শেষ করে চাকরিবাকরিতে ঢুকেছে। আর ডিভোর্সের মাধ্যমে দুজনেই নিষ্কৃতি পেয়েছেন অপ্রিয় পুরুষদের সহবতে বাকি জিন্দেগি কাটানোর প্রথাগত প্রত্যাশা থেকে। জাজে দুজনই উদ্বেলিত হন আগের মতো—একত্রে এনজয় করছেন আজকের মাইফেলটি। না, মহিলা দুজন ফর্মালি ডেট করছেন না, তবে কিনা ‘জ্যাজ মিউজিক ইজ ডিজাইনড ফর ওপেন মাইন্ডেড পিপুল’, তাঁরাও খোলা মনে পরস্পরের সঙ্গে ফের মেলামেশা করছেন, ভবিষ্যতে তাঁদের বন্ধুত্ব কোনদিকে মোড় নেবে, তা ঠিক নিশ্চিত নন তাঁরা, ‘বাট উই উড লাইক টু কিপ আওয়ার মাইন্ডস ওপেন ফর এনি পজিবিলিটিজ।’

জাজের আসরে বিয়ে করলেন যাঁরা, সেই নবদম্পতি ওই মাঠেই পরস্পরকে চুম্বন করছেন প্রবল আবেগে
জাজের আসরে বিয়ে করলেন যাঁরা, সেই নবদম্পতি ওই মাঠেই পরস্পরকে চুম্বন করছেন প্রবল আবেগে

মঞ্চে উঠে আসে কিউবা থেকে আগত মেকেকে ব্যান্ডের পাঁচ তরুণী, সঙ্গে তাঁদের কানাডিয়ান চড়নদার জেন বনেট। বাঁশরীর হৃদয়-মথিত আবহে ভরে ওঠে সন্ধ্যা। দগ্ধদিল বাদ্যের সঙ্গে অত্যন্ত ফেমিনিন ভঙ্গিতে বিস্তারিত হয় সমবেত নৃত্য। আমার পাশে দাঁড়িয়ে তিন প্রস্থ স্যুট পরা এক শ্বেতাঙ্গ পুরুষ পাইপ থেকে ধোঁয়া ছেড়ে বলেন, ‘দেখো, কীভাবে এঁরা ফোকলরিক আবহে আফ্রো-ক্যারিবিয়ান রিদমকে মেশাচ্ছে জাজের উত্তরাধুনিক ধ্বনিপুঞ্জে।’ সেক্সোফোন হাতে নেন জেন, ঝংকারের উর্মিতে উতরোল হয় তাবৎ জলসা। নৃত্যের প্রকরণেও আসে পরিবর্তন। শ্রোতাদের অনেকেই ‘চা চা চা...’ জপ করে সমবেত নৃত্যে শামিল করেন নিজেদের স্টেপ। একজন আলাভোলা সমঝদার অবেগপ্রবণ হয়ে হিস্পানিওলে আওয়াজ দেন, ‘আমর পর লাস মোচাচাস কুবানাস, বা কিউবান যুবতীদের জন্য ভালোবাসা।’ বলেই তিনি যেন মূর্ছা যাচ্ছেন—ঘাসে ঢলে পড়েন এমন ভঙ্গিতে। ওখান থেকে দেহটি ব্রেক ড্যান্সে ছাঁইমাখা শৌল মাছের মতো বাঁকিয়ে ডিগবাজি পাড়লে, পাইপ ফোঁকা ভদ্রসন্তানের মন্তব্য, ‘সিমস লাইক কিকড বাই আ ড্রাংকেন ডংকি...।’

ফুড ভেন্ডারদের পরিসরে বেসামাল হয়ে ড্যান্স করছেন চিনাবাদামওয়ালা। পেশায় তিনি চাষি। তবে এ অত্রাফের কোথাও জাজের জলসা হলে তিনি পিনাটের পিকাপটি নিয়ে হাজির হন। একসময় হাতে জ্বলন্ত স্টোভ নিয়ে, মধুর ফোড়ন দিয়ে বাদাম ভাজতে ভাজতে, ড্যান্স করতে করতে বিক্রি করতেন সওদা। বছর সাতেক আগে দুর্ঘনাটি ঘটে, বেমক্কা ভঙ্গিতে নাচতে গিয়ে স্টোভ বিস্ফোরিত হয়ে ঝলসে যায় তাঁর মুখমণ্ডল। তারপর থেকে ইনি মুখোশ পরে মাতাচ্ছেন জাজের মাইফেল। একুশ বছর ধরে লিপ্ত রয়েছেন এ বাণিজ্যে, ফাঁকতালে চুটিয়ে শুনছেন নানা কিসিমের জাজ। হালফিল তাঁকে আর ব্যবসাপাতির নজরদারি করতে হয় না। মেয়ে সোমত্ত হয়ে উঠেছে, সে–ই চিনাবাদাম ভাজে, আর অত্র অবসরে রিদমের সঙ্গে পা মিলিয়ে মাতোয়ারা হয়ে নৃত্য করেন তিনি।

এক জামানায় রোলিং স্টোনের মাইফেল মাতানো চক লেভেল পিয়ানোতে ঝংকার তুলতেই অরণ্যে ঝোড়ো হাওয়ার মতো মুখর হয়ে ওঠে গোটা জলসা। তিনি ব্যাক টু দি উডস অ্যালবাম থেকে গান ধরেন, ব্যক্তিগত জীবনে সংরক্ষণবাদী এ বৃক্ষচাষির নিসর্গ হেফাজতের অঙ্গীকার মূর্ত হয়ে ওঠে মুহূর্তে।

তুলতুলে কম্বলে বসেছেন এক বৃদ্ধ দম্পতি। তাঁদের চোখমুখে সৈকতে কাঁকড়ার পদচিহ্নের মতো বয়সের বলিরেখা। তবে দুজনে চক লেভেলের সংগীত শুনতে শুনতে বিয়ারের সঙ্গে মৌজসে ফুঁকছেন সিগারেট। চোখাচোখি হতেই আমাকে বসতে বলেন। চক এবার গেয়ে চলছেন, ‘আই অ্যাম ইন লাভ উইথ ইউ বেবি...।’ চোখে তারিফের ঝিলিক তুলে বৃদ্ধ আরেকটি মালবোরো ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়েন। তাঁর কোটের বুকপকেটে গাঁথা ভিয়েতনাম যুদ্ধের মেডেল। এঁরা দুজনে হাইস্কুলে ছিলেন ‘সুইট হার্ট’। আজ থেকে ছেচল্লিশ বছর আগে এ রকম একটি জাজের জলসায় পরস্পরের প্রতি বাগদানের বিষয়টি সেরেছিলেন। তাঁদের জ্যেষ্ঠ কন্যাটিও কিছুদিন আগে রিটায়ার্ড করেছে। আমি যে সমাজে ঘুরপাক করি, এখানে আড়াই বছর বিবাহিত হয়ে একত্রে ঘরসংসার করতে পারলে বিষয়টিকে অ্যাচিভমেন্ট বিবেচনা করা হয়। আর কাজাবিল্লা কোনো দম্পতি একত্রবাসে পাঁচ বছর অতিক্রম করলে বিষয়টি হয়ে দাঁড়ায় পারস্পরিক সহিষ্ণুতার এক পরম দৃষ্টান্ত। এই পরিস্থিতিতে অত্র যুগল অতিক্রম করেছেন ছেচল্লিশ বছর! তো দম্পতির সমীপে শান্তিপূর্ণভাবে একত্রবাসের রহস্য জানতে চাই আমি। বৃদ্ধা ফিচুত শব্দে বিয়ারের আরেকটি ক্যান ওপেন করে জবাব দেন, ‘দাম্পত্য হচ্ছে আগেকার আমলের ফিল্ম ডেভেলপ করার মতো। কাজটি করতে হয় ডার্করুমে।’ আমার ফলোআপ সওয়াল হয়, ‘এত বছর একত্রে বসবাস, একঘেয়ে লাগে না আপনাদের?’ বৃদ্ধ ফোকলা দাঁতে হেসে উত্তর দেন, ‘পে অ্যাটেনশন টু হাউ জ্যাজ মিউজিক ইজ বিয়িং প্লেইড। একই লিরিক্যাল নোট বারবার বাজাচ্ছে, তবে প্রতিবারই উপস্থাপন করছে ভিন্ন ভঙ্গিতে।’ তিনি ফের বলেন, ‘ডার্করুমে নতুন পদ্ধাতিতে ফিল্ম ডেভেলপ করার চেষ্টা করো, আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, এতে অবধারিতভাবে বাড়বে দাম্পত্যের মেয়াদ।’

বয়োবৃদ্ধ দম্পতির সঙ্গে বাতচিতে মশগুল হয়েছিলাম। ঠিক খেয়াল করিনি, কখন যে চক লেভেল জাজের উপসাগর ছেড়ে ঢুকে পড়েছেন ব্লুজের খরস্রোতা নদীজলে। তাঁর কিস্তিতে যেন খান খান হয়ে পড়ে বিক্ষুব্ধ তরঙ্গরাজি। জলসায় সাজ সাজ রব ওঠে। সাভানার ড্যান্স ট্রুপের কয়েকটি কিশোর-কিশোরী সংগীত কলাকারের সৃষ্ট আজনবী ধ্বনিপুঞ্জের সঙ্গে শরীরি সংগত করে মেতে ওঠে নৃত্যে। ক্যামেরাবাজ কতগুলো ড্রোন ধেয়ে যায় তাদের দিকে।