সমাজ ও ইতিহাসের ধারায় বিশ্বায়ন

বদরুল আলম খান একজন অধ্যাপক ও সমাজতাত্ত্বিক। প্রায় চার দশক ধরে শিক্ষকতা করছেন দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্নাতক দর্শনে আর পিএইচডি করেছেন সমাজতত্ত্বে। আশির দশকে দেশে ফিরে এসে প্রায় দেড় দশক শিক্ষকতা করেছেন যথাক্রমে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রায় পচিশ বছর ধরে অভিবাসন জীবনযাপন করছেন অস্ট্রেলিয়ায়। আবারও নতুনভাবে পড়াশোনা করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্কে। প্রায় দুই দশক ধরে শিক্ষকতা করছেন সেই দেশে সমাজ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। ড. খানের দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যায়নের মধ্যে তাই বহুমাত্রিক জ্ঞানশৃঙ্খলার সমাবেশ ঘটেছে। দর্শন-সমাজতত্ত্ব ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসবোধ মিলিয়ে নানা দৃষ্টির মিশেলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আবার লেখায় ফিরে এসেছেন তিনি। যার ফলাফল প্রথমা থেকে প্রকাশিত তাঁর তিনটি বই। আমরা এখানে কথা বলব তাঁর তৃতীয় বই বিশ্বায়ন: ইতিহাস ও গতিধারা নিয়ে।

বিশ্বায়ন সুদীর্ঘ এক প্রক্রিয়া। নানা ধাপে রাষ্ট্র, সমাজ ও বাণিজ্যের নানা ধরন ও রূপ এই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়েছে। বিশ্বায়নকে নিয়ে এই বইয়ে ইতিহাসের পরিসর ও গতিধারায় বিশ্বায়নকে বোঝার চেষ্টা করেছেন বদরুল আলম খান। বইটি আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত। অধ্যায়গুলোর শিরোনামের ক্ষেত্রে লেখক ব্যবহার করেছেন বিশেষ প্রতীক ও মিথ। মিথ চরিত্র ব্যবহার করতে গিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই সভ্যতা থেকেই রসদ নিয়েছেন তিনি।

প্রথম অধ্যায়ের শুরু হয়েছে মজার এক শিরোনাম দিয়ে: ‘পৃথিবী গোল নাকি সমতল?’ এমন চিত্তাকর্ষক ভঙ্গিতে এবং সরল ভাষায় গুরুগম্ভীর বিষয়গুলো পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন লেখক।

>বিশ্বায়ন: ইতিহাস ও গতিধারা বদরুল আলম খান প্রচ্ছদ: অশোক কর্মকার প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা প্রকাশকাল: জুলাই ২০১৮ ২৩২ পৃষ্ঠা, দাম: ৪৫০ টাকা।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে আছে মিথের জগৎ, ধর্মের যুগ ও প্রাচীন সাম্রাজ্যের কথা। এই অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন বিশ্বের দুই সভ্যতার মহান দুই মহা কাব্যের নামানুসারে: ‘ইলিয়াড থেকে মহাভারত’। তৃতীয় অধ্যায়টি লেখক সাজিয়েছেন ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কারের অপূর্ণতা, নৌশক্তির উত্থান ও প্রভাব, গোত্রভিত্তিক সাম্রাজ্য আর মহাদেশীয় বিবেচনায়। বিশ্বায়নের এ পাঠটি তুলে এনেছেন সম্রাট আর সুলতানদের গল্পের মাধ্যমে। ধর্ম, নৌশক্তি আর বাণিজ্য—এরাই তো বিশ্বায়নের অন্যতম বাহন।

বিশ্বময় বাণিজ্য ও বাণিজ্যপুঁজির বিস্তারে ভৌগোলিক আবিষ্কার রেখেছে ভূমিকা
বিশ্বময় বাণিজ্য ও বাণিজ্যপুঁজির বিস্তারে ভৌগোলিক আবিষ্কার রেখেছে ভূমিকা

চতুর্থ অধ্যায়ে এসে সেই আখ্যানেরই বয়ান তুলে ধরা হয়েছে ‘ইসাবেলা ও ক্রুসেডের গল্প’ শিরোনামে। এখানে উঠে এসেছে ক্রুসেডের কথা, আলোচনা হয়েছে খ্রিষ্টধর্মের জঙ্গিবাদী রূপ প্রসঙ্গে। বিশ্বময় বাণিজ্য আর বাণিজ্যপুঁজির বিস্তারে নৌশক্তি আর ভৌগোলিক আবিষ্কার যে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে, সে পাঠটি গল্পের মতো করে সহজ বিবরণে তুলে ধরেছেন লেখক।

পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম অধ্যায় এ বইয়ের তিন গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সমসাময়িক বিশ্বব্যবস্থার সাম্প্রতিক প্রবণতা, বিশ্বায়নের নানারূপ ও ধরন সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে এখানে। এসব অধ্যায়ে পুঁজিবাদের বিকাশ ও এর দ্বন্দ্বময় সময় এবং নতুন বিশ্বব্যবস্থায় চীন-ভারতের মতো নতুন শক্তির উত্থান বিশ্লেষণ করেছেন বদরুল আলম খান। বিশ্বায়ন সম্পর্কে যে ইতিবাচকতার কথা বলা হয়, তার নানাবিধ প্রতিক্রিয়ার দিকগুলো তিনি তুলে ধরেছেন শেষ অধ্যায়ে। এভাবে আলোচ্য বইয়ে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে বিশ্বায়নকে। বিশ্বায়নের বহুমুখী প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।