রশিদ চৌধুরী, প্রীতিভাজনেষু

রশিদ চৌধুরী (১ এপ্রিল ১৯৩২—১২ ডিসেম্বর ১৯৮৬)। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
রশিদ চৌধুরী (১ এপ্রিল ১৯৩২—১২ ডিসেম্বর ১৯৮৬)। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
>১২ নভেম্বর ছিল কবি বেলাল চৌধুরীর জন্মদিন। অগ্রন্থিত এই লেখায় তিনি তুলে ধরেছেন শিল্পী রশিদ চৌধুরীর অবয়ব

১৯৫৭-৫৮-এর কথা। আমি তখন চাটগাঁতে থাকি। কাজ করি একটি গভীর সমুদ্রে মৎস্য শিকার প্রকল্পে। নিয়মিত ছোটাছুটি করতে হয় চাটগাঁ-ঢাকা-খুলনা। সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি থেকে শতহস্ত দূরে। আর সুযোগ পেলেই ছুটে যেতাম পার্বত্য চট্টগ্রামে। হাতের তালুর মতো চেনা হয়ে গিয়েছিল গোটা পার্বত্য এলাকা। চাকমা বসতি থেকে মুরুংদের নিবাস পর্যন্ত।

এসবের মধ্যে আমার ঢাকার বন্ধুবান্ধবেরা যারা চাটগাঁ যেত এবং আমার সঙ্গে মোটামুটি একটা যোগাযোগ রাখত, তারা হলো আমার তখনকার দিনের দুই তরুণ শিল্পী বন্ধু সৈয়দ জাহাঙ্গীর ও রশিদ চৌধুরী। দুজনই তখন বিদেশফেরত। জাহাঙ্গীর তখন যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে এসে ডেরা বেঁধেছে রাওয়ালপিন্ডিতে। আর রশিদ চৌধুরী পারি থেকে ফিরে ঢাকায়। দুজনেরই তখন টগবগ করে ফোটা দুরন্ত যৌবন। দুজনেরই সুঠাম, সবল চেহারা। দুজনেরই দেহের রং শ্যামলা। চোখে অঢেল স্বপ্ন। আঁকাআঁকির তাড়নায় দুজনই অস্থির। রশিদ চৌধুরীকে অবশ্য আমি আগে তেমনভাবে চিনতাম না। জাহাঙ্গীরের সূত্রেই আলাপ-পরিচয় হয়েছিল চাটগাঁতেই প্রথম।
জাহাঙ্গীর আর আমি দুজনেই একসঙ্গে চষে বেড়াতাম পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল। রশিদ মাঝেমধ্যে আসত। অফুরন্ত আড্ডা আর এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করেই কাটত আমাদের। আমাদের আড্ডা মারার প্রধান ক্ষেত্র ছিল সুলেখক এবং তার চেয়েও বড় পরিচয় বংশীবাদক সুচরিত চৌধুরীর নন্দনকাননের বাড়ি নিভৃত নিলয় কিংবা বোস ব্রাদার্সের মিষ্টির দোকান। ঝোড়ো হাওয়ার মতো ছিল আমাদের গতিবিধি।

মাঝেমধ্যে সুযোগ পেলেই আমি আর জাহাঙ্গীর বেরিয়ে পড়ি পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায়। চাকমা, মুরুংদের বসতি ঘুরে ঘুরে বেড়াই। জাহাঙ্গীর জলরঙে ছবি আঁকে। আমি ছবি তুলি, লিখি। জাহাঙ্গীর আসে, চলে যায়। হঠাৎ একদিন সশরীরে এসে হাজির রশিদ। সে–ও সদ্য পারি প্রত্যাগত। চট্টগ্রামে একটা প্রদর্শনী করতে চায়। আজকে যেমন যত্রতত্র যে কেউ যখন-তখন প্রদর্শনী করছে, তখন কিন্তু প্রদর্শনীর ব্যাপারটা অত সহজ ছিল না।

দৌড়ালাম কয়েকজন ধনাঢ্য শিল্প-অনুরাগীর বাড়ি। কেউ এগিয়ে এলেন সাহায্য-সযোগিতার হাত প্রসারিত করে, কেউ শুধু আশ্বাস দিয়েই ক্ষান্ত হলেন। রশিদ কিন্তু অদম্য। রশিদের ছবি দেখে সবাই মুগ্ধ। সম্পূর্ণ নতুন এক মেজাজ। নতুন ধরনের অভিব্যক্তি।

বেলাল চৌধুরী
বেলাল চৌধুরী

এভাবেই রশিদের সঙ্গে আমার আলাপ-পরিচয়ের সূত্রপাত। প্রথমদিকে রশিদ কথা বলত খুব কম। খাটতে পারত অসম্ভব। রশিদ ও জাহাঙ্গীর, খুব কাছে থেকে দেখেছি বলেই বলতে পারি, তখন অন্তত দুজনই সৃজনশীল কিছু করার অনুপ্রেরণায় রীতিমতো টগবগ করে ফুটছিল।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর কলকাতা থেকে আসা শিল্পী জয়নুল আবেদিন ও তাঁর কয়েকজন সতীর্থ শিল্পীর অনলস প্রচেষ্টায় চালু হয়েছিল আর্ট স্কুল। অবশ্য এই স্কুল চালু হওয়ার ব্যাপারটা যত সহজে বলা হচ্ছে, তত সহজসাধ্যভাবে হয়নি। এর মধ্যে অনেক কুটিল অঙ্ক ছিল। ’৪৩-এর মন্বন্তরের ছবি এঁকে জয়নুল আবেদিনের তখন ভারতজোড়া খ্যাতি। বড় মাপের শিল্পী তিনি। যেমন ঋজু ও বলিষ্ঠ গড়ন তাঁর, তেমনি অদম্য মনের জোর। শুধু প্রতিষ্ঠান গড়েই ক্ষান্ত হলেন না। ছাত্রছাত্রী জোগাড়েও অশেষ কৃতিত্ব দেখালেন। তাঁরই ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রথম কয়েক বছরের মধ্যে যেসব ছাত্রছাত্রী এই চারুকলা ইনস্টিটিউটে যোগ দিলেন, পরবর্তীকালে তাঁরাই তরুণ প্রজন্মের শিল্পী হিসেবে খ্যাতিমান হলেন। এই একঝাঁক তরুণ প্রজন্মের শিল্পীর মধ্যে ছিলেন বিজন চৌধুরী, যিনি বর্তমানে কলকাতার স্থায়ী নিবাসী, মোহাম্মদ কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, কাইয়ুম চৌধুরী, রশিদ চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, আবদুস সবুর, আবদুর রাজ্জাক, আবদুর রউফ, জোনাবুল ইসলাম প্রমুখ খ্যাতিমান। তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে কীর্তিমান শিল্পী।

জয়নুল আবেদিনের সহকর্মীদের মধ্যে ছিলেন শফিউদ্দিন আহমদ, কামরুল হাসান, শফিকুল আমিন, খাজা শফিক, আনওয়ারুল হক প্রমুখ। ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে ছিল এক অচ্ছেদ্য প্রীতির বন্ধন। মনে হতো এক পরিবারের সদস্য।

তখন ঢাকা শহরের পরিধি ছিল খুবই সীমিত। কয়েকটি রাস্তা আর কয়েকটি চায়ের দোকান বা রেস্তোরাঁর মধ্যে সীমাবদ্ধ। যার ফলে তখনকার দিনের কবি, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী বা রাজনীতিকদের সঙ্গে শিল্পীদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত হার্দ্য। যে কারণে তখনকার সব তরুণ শিল্পীর সঙ্গেই আড্ডার সূত্রে আমারও বন্ধুতা গড়ে উঠেছিল। কিবরিয়া, বশীর, কাইয়ুম ভাই, দেবদাস, রশিদ, জাহাঙ্গীরদের সঙ্গে শুধু বন্ধুত্বই নয়, একটা নির্ভেজাল আত্মিক সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। ভ্রাম্যমাণ মানুষ আমি। মাঝে যাযাবর জীবনের নিজস্ব নিয়মে সুদীর্ঘকালের বিচ্ছেদের পর দুজনের সঙ্গেই আবার আমার যোগাযোগ ঘটল সত্তর দশকের মাঝামাঝি। দুজনই তখন অনেক পরিণত, প্রতিষ্ঠিত। যে যার কাজে স্বোপার্জিত মুদ্রার স্বাক্ষর অঙ্কিত করে নিয়েছে। অনেক ভাঙাচোরার মধ্য দিয়ে রশিদ অতিক্রম করে এসেছে এক দীর্ঘ সংগ্রামসংকুল পথ। আঁকাজোকায় নিরন্তর বদলেছে নিজেকে। কাজ করেছে বিভিন্ন মাধ্যমে। শেষ দিকে হাত দিয়েছিল ট্যাপট্রিতে। তাতেও রশিদের সিদ্ধি ঘটেছিল আশাতীত। সবচেয়ে বড় কথা, রশিদের ছবিতে প্রথম দৃষ্টিতে একটা দেশজ আবহের বাতাবরণ থাকলেও একটু ভালো করে নিরীক্ষণ করলেই দেখা যায়, রশিদ কিন্তু দুর্মরভাবে পাশ্চাত্য রীতির অনুসারী ছিল। কি রং, কি অঙ্কন সবকিছুতেই এটা অত্যন্ত প্রবলভাবেই অনুভূত হতো। রশিদের ছবি আমি তেমন একটা দেখিনি যদিও, কিন্তু যতটুকু দেখেছি তার ওপর নির্ভর করেই এ কথা বলছি। তবে এ ক্ষেত্রে রশিদের নিজস্ব মৌলিক চিন্তাভাবনা ও দক্ষতা অনস্বীকার্য।

রশিদ কবিতাও লিখত। সামান্য কয়েকটা আমি দেখেছি, পড়েছি। সেখানেও সেই একই ব্যাপার। খানিকটা খণ্ডচিত্রের মতোই। অত্যন্ত সংবেদনশীল চিত্ররূপময়তা প্রতি ছত্রে ছত্রে। আশ্চর্যের ব্যাপার রশিদ কিন্তু কোনো দিনই তার কবিতার ব্যাপারে আমার সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা বা প্রসঙ্গ একবারও তোলেনি। আমিও কিছু জিজ্ঞেস করে তাকে অপ্রস্তুত করিনি।

জীবনের শেষ কয়েক বছরে ওর সঙ্গে অনেকবারই দেখা হয়েছে এখানে-সেখানে। সব সময়ই ওকে দেখতাম কর্মব্যস্ত। কাজের তাড়ায় হন্তদন্ত। মন খুলে, দুদণ্ড জিরিয়ে কথা বলার অবকাশ যেন তার নেই। সারাক্ষণই এটা করছে, ওটা করছে, বিশেষ করে ট্যাপট্রির কাজ। এরই মাঝে যেটুকু কথাবার্তা হতো তাতে বুঝতে পারতাম ওর এই ছটফটানির ভেতর আসলে কাজ করছে ওর সৃজনশীল শিল্পীসত্তা। কিছু একটা করার অদম্য আগ্রহ আর জীবনের নানা টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে তাকে যেতে হচ্ছে বলে এই অস্থিরতার প্রকাশ আমার বারবার মনে হয়েছে। একজন প্রকৃত শিল্পীর আত্মানুসন্ধান তাকে অনবরত তাড়া করে ফিরছে। ভেতরের দহন আর নবতর সৃষ্টির জ্বালা তাকে স্থির হতে দিচ্ছে না যেন।

সংগ্রহ ও টীকা: মাসুদুজ্জামান
গত শতকের আশির দশকে মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকায় সম্পাদক মীজানুর রহমান বিষয়ভিত্তিক ও বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে ধরে অসাধারণ সব সংখ্যা করতেন। বেলাল চৌধুরীর অগ্রন্থিত এই লেখাটি শিল্পী রশিদ চৌধুরীর মৃত্যুর পরে লেখা। লেখাটি পত্রিকাটির তৃতীয় বর্ষ দ্বিতীয়-তৃতীয় সংখ্যা, অক্টোবর ১৯৮৭-মার্চ ১৯৮৮ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। সমকালের খ্যাতিমান লেখক-শিল্পীদের সঙ্গে বেলাল চৌধুরীর ছিল ঈর্ষণীয় সখ্য। জীবনের মধ্যপর্ব পর্যন্ত তিনি একধরনের বোহেমিয়ান জীবনযাপন করেছেন। এই লেখাতেও পাঠক রশিদ চৌধুরীসহ অন্য শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর কতটা অন্তরঙ্গ ও গভীর সম্পর্ক ছিল, তার আভাস পাবেন।