জটিল রাজনৈতিক অর্থনীতির স্বচ্ছ পাঠ

বিশ্ব পুঁজিবাদ ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি
এম এম আকাশ
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রথম প্রকাশ: জুলাই, ২০১৮
২৪০ পৃষ্ঠা, দাম: ৪৫০ টাকা।

অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বাম ঘরানার চিন্তাবিদ ও গবেষক হিসেবে খ্যাত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এই অধ্যাপক বিশ্ব-রাষ্ট্র-সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতিকে বিচার-বিশ্লেষণ করে থাকেন সেই দৃষ্টিকোণ থেকে। তবে তাঁর বিশ্লেষণের গভীরতা একাধারে যথেষ্ট তথ্য-উপাত্তনির্ভর, পর্যাপ্ত যুক্তিপূর্ণ ও বহুমাত্রিক। সম্প্রতি প্রথমা প্রকাশন তাঁর বিশ্ব পুঁজিবাদ ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি নামে যে বইটি বের করেছে, সেটি হাতে নিলে এই কথা মনে হতে বাধ্য।

মূলত গত এক দশকে এম এম আকাশের লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও বক্তৃতা থেকে বাছাই করা নয়টি রচনার সংকলন এই বই। এর প্রথম অংশে বিশ্ব পুঁজিবাদ বিষয়ে তিনটি প্রবন্ধ রয়েছে। এ বছর যখন বিশ্ব আর্থিক সংকটের ১০ বছর পূর্ণ হলো, তখন এ বইয়ের প্রথম প্রবন্ধটি পাঠককে আর্থিক সংকটের কারণ ও বিস্তার সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা দেবে। আবার ‘দ্বিতীয় মার্ক্স’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটির একুশ শতকে পুঁজি নামের বইয়ের আলোচনা লিখতে গিয়ে আকাশ আয়বৈষম্যের নেতিবাচক দিকগুলো সহজভাবে ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছেন, যা পাঠককে ভাবাবে।

বইয়ের দ্বিতীয় অংশ হলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি। এখানে গ্রন্থিত হয়েছে ছয়টি নিবন্ধ, যার প্রথম তিনটিতে আকাশ বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বৈষম্য, দারিদ্র্য, পুঁজিপতি গোষ্ঠীর বিকাশ ও শ্রমিকশ্রেণির বঞ্চনা নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি চলমান উন্নয়ন প্রক্রিয়া ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাকে দেশের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য ও বঞ্চনার জন্য দায়ী করেছেন। তাঁর মতে, ‘বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনের জন্য Business As Usual Strategy থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মুক্তবাজার ও চুইয়ে পড়া প্রবৃদ্ধির তত্ত্ব থেকে বের হয়ে আসতে হবে এবং “সমতাপূর্ণ প্রবৃদ্ধির” নীতি গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধিকে এমন চরিত্রের হতে হবে, যাতে আগামী দিনগুলোতে ধনীদের আয় যে হারে বৃদ্ধি পাবে, তার চেয়ে বেশি হারে বৃদ্ধি পাবে দরিদ্রদের আয়।’ (পৃ. ১৫০)

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীনকে িনয়ে দুটি প্রবন্ধ আছে এই বইয়ে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীনকে িনয়ে দুটি প্রবন্ধ আছে এই বইয়ে



তবে ‘বঙ্গবন্ধু: ইতিহাসের নির্মাতা, ইতিহাসের ট্র্যাজেডি, ইতিহাসের শিক্ষা’ এবং ‘তাজউদ্দীন আহমদ: সময় যাঁকে তৈরি করেছিল এবং যিনি সময়কে অতিক্রম করতে চেয়েছিলেন’ শীর্ষক নিবন্ধ দুটো সম্ভবত এই বইয়ের পাঠকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রতীয়মান হবে। যথাসম্ভব নির্মোহভাবে ও সাহসের সঙ্গে লেখক বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রধানতম দুই প্রাণপুরুষের ওপর আলোকপাত করেছেন।

বইটি শেষ হয়েছে বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিবাদের গতি-প্রকৃতির ওপর ছোট একটি নিবন্ধ দিয়ে। এতে আকাশ আমাদের এই বলে সতর্ক করে দিচ্ছেন: ‘শুধু দমন-পীড়ন এবং অর্থপ্রবাহ বন্ধ করেও পলিটিক্যাল ইসলামকে পরাজিত করা যে সম্ভব হবে না, সেটাও আমাদের স্বীকার করতে হবে।’ (পৃ. ২৩২)। পাশাপাশি তাঁর বাড়তি সতর্কবার্তা: ‘ফ্যাসিবাদকে দমন করতে গিয়ে আমাদেরকেও আজ কঠোর প্রতিরোধী হওয়া ছাড়া উপায় নেই, কিন্তু সে ক্ষেত্রে একই সঙ্গে আমরা নিজেরাও যাতে কখনো ফ্যাসিবাদী রূপ পরিগ্রহ না করি, সে বিষয়েও আমাদের সদা সতর্ক থাকতে হবে।’ (পৃ. ২৩৪)।

সব মিলিয়ে বইয়ের প্রবন্ধ–নিবন্ধগুলো পাঠককে নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে।