রকিব হাসান। জনপ্রিয় সিরিজ ‘তিন গোয়েন্দা’র স্রষ্টা। দীর্ঘদিন লেখালেখি করলেও সেভাবে জনসমক্ষে আসতে চান না। তিনি লিখেছেন তাঁর প্রিয় ৫ বিষয় নিয়ে।
১. বই
মর্মে আঘাত দেওয়া ‘পথের পাঁচালী’
আমার প্রিয় বই হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী। চারবারের চেষ্টায় বইটি শেষ করেছি। মনে আছে, প্রথমবার এ বইয়ের প্রেমে পড়েছিলাম কিশোর বয়সে। পড়তে পড়তে যখন দুর্গা মারা গেল, তারপর আর পড়তে পারিনি। দ্বিতীয়বার পড়ি আমার যখন ২৪–২৫ বছর বয়স, তখন। সে দফায় আটকে গেলাম ইন্দির ঠাকুরনের মৃত্যুর ঘটনায়। সে সময় এটা আমার মনে এতটাই প্রভাব ফেলল যে আমি আর উপন্যাসটি শেষ করতে পারলাম না। এর অনেক দিন পর তৃতীয়বার পথের পাঁচালী পড়তে বসি আমার ৪০ বছর বয়সেরও পরে। মজার ব্যাপার হলো, সে সময়ও এ উপন্যাসটি শেষ করতে পারিনি। পরে পণ করলাম পথের পাঁচালী পড়বই পড়ব। প্রায় একই সময়ে দেখে ফেললাম সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী সিনেমাটি। তারপর ৫০ বছর বয়সে আবার পড়তে শুরু করি এবং পাঁচবারের চেষ্টায় বইটি শেষও করি। আদতে এই উপন্যাসের করুণ আবহ বারবারই আমার মর্মে আঘাত দিয়েছে।
২. গান
পুরোনো না হওয়া
‘ক্ষমা কর প্রভু’
গান তো একসময় খুব শুনতাম—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান, আধুনিক বাংলা গান। মনে পড়ে পেশা হিসেবে যখন লেখালেখিকে নিয়েছিলাম, প্রায় সারা দিনই লিখতাম। আমার ওই লেখালেখির সময়ে মনঃসংযোগ ধরে রাখার জন্য ঘরে নিচু লয়ে উচ্চাঙ্গসংগীত ছেড়ে রাখতাম আমি। তবে রবিঠাকুরের একটি গান শুনলে এখনো আমার চিত্ত প্রসন্ন হয়ে ওঠে—‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু’। দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে এই গান কী যে ভালো লাগে! মাঝেমধ্যে নিজেকেই প্রশ্ন করেছি, কেন এই গান এত স্পর্শ করে আমাকে? পুরো গানটিতে একধরনের উদ্যম ও সমর্পণের ব্যাপার আছে। তাই বোধ হয় এত ভালো লাগে। এ ছাড়া সুবিনয় রায়ও আমার প্রিয় শিল্পীদের একজন। আমার গান শোনার ক্ষেত্রে একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটে—কোনো গান মনে লেগে গেলে এক বৈঠকে সেই গানটি অনেকবারই শুনি, ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু’র যেমন কথা বললাম। আদতে প্রিয় গান কখনো পুরোনো হয় না।
৩. চলচ্চিত্র
স্মৃতি এবং ‘টাইটানিক’
বলার মতো প্রিয় কোনো সিনেমা সত্যি নেই আমার। তবে হ্যাঁ, কিশোর বয়সে উর্দু ছবি হাজার দাস্তান দেখেছিলাম—একবার নয়, উনিশবার। সেই কথাই মনে আসছে এখন। কৈশোর–পরবর্তী সময়ে ভালো লাগত উত্তম কুমারের ছবি। বিশেষত, উত্তম–সুচিত্রা জুটির রোমান্টিক ছবিগুলো খুব টানত আমাকে। উত্তমের ভেতরে কী যেন একটা ছিল, আকর্ষণ করার মতো। এরপর পরিণত বয়সে যে সিনেমাটি খুব ভালো লেগেছে, তার নাম টাইটানিক। এই ছবির শেষ পর্যায়ে জাহাজ ডোবার যে মর্মান্তিক চিত্র, তা আমাকে স্পর্শ করেছিল। মনে হয়েছিল, আসলেই তো, মানুষের জীবন কতই না ক্ষণস্থায়ী!
৪. চরিত্র
আগাথা ক্রিস্টির
এরকুল পোয়ারো
আমার প্রিয় প্রিয় লেখক অজস্র—অ্যালিস্টার ম্যাকলিন, উইলবার স্মিথ, আগাথা ক্রিস্টি। তবে প্রিয় চরিত্র সেভাবে নেই। আগাথা ক্রিস্টির এরকুল পোয়ারো চরিত্রটিকেই যা একটু ভালো লাগে। যদি কেন ভালো লাগে—এ প্রশ্ন আসে, বলব যে এ চরিত্রের বুদ্ধিমত্তা, বাক্পটুতা ও রহস্য উন্মোচনের কৌশল মুগ্ধ করার মতো। এ চরিত্র ছাড়া আমার সৃষ্ট কিশোর, মুসা ও রবিনও আমার খুব প্রিয় চরিত্র। ১৯৮৩ সালে রবার্ট আর্থার জুনিয়রের ‘থ্রি ইনভেস্টিগেটর’ সিরিজের দ্য মিস্ট্রি অব দ্য স্টুটারিং প্যারোট বইটি পড়ে এই তিন গোয়েন্দার মুখটি দেখতে পেয়েছিলাম প্রথম। আর তখনই মনে হয়েছিল এবার থেকে শুধু বাচ্চাদের বই–ই লিখব। এখন তো গোয়েন্দা চরিত্রের কথা বললে কেবল কিশোর, মুসা ও রবিনের ছবিই ভেসে আসে আমার চোখে। কত মানুষ আমার এ চরিত্রটিকে পছন্দ করেছে, ভালোবেসেছে, ভাবলে বিস্ময় জাগে।
৫. লেখার সঙ্গী
শেষ পর্যন্ত কম্পিউটার
অনেকেরই লেখালেখির জন্য প্রিয় সময় আছে। আমার তার উপায় ছিল না। অর্থসংস্থানের জন্য একসময় আমাকে প্রচুর লিখতে হয়েছে। এক মাসে ছয়টি বই লেখার রেকর্ডও রয়েছে। একসময় শুধু চার ঘণ্টা ঘুম আর অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজের জন্য দুই ঘণ্টা বাদ দিয়ে বাকি ১৮ ঘণ্টাই লিখতে হয়েছে আমাকে। এ ক্ষেত্রে তাই শেষ পর্যন্ত লেখালেখিতে আমার প্রিয় সঙ্গী কম্পিউটারই। কাগজে–কলমে কখনো লিখিনি আমি। এর অন্যতম কারণ হলো, আমার হাতের লেখা বিচ্ছিরি রকমের খারাপ। প্রথমে লেখালেখি শুরু করেছিলাম মুনীর অপটিমা টাইপরাইটারে। পরে যখন কম্পিউটার এল, তখন টাইপরাইটারটি বিক্রি করে কম্পিউটার কিনলাম। এরপর থেকে কম্পিউটারই প্রিয় সঙ্গী।