সত্য আর কল্পনার অপূর্ব মিশেল

>

অসুখী দিন
শাহীন আখতার
প্রচ্ছদ: জাহিদুর রহিম অঞ্জন
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৮
২৯৬ পৃষ্ঠা, দাম: ৫০০ টাকা।

বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের দামামা। মন্বন্তর। দুর্ভিক্ষ। আর উপমহাদেশে চলছে আজাদির লড়াই। লড়াই চলছে যার যার মতো। কোথাও সত্যাগ্রহী, কোথাও কমিউনিস্ট আন্দোলন, কেউ আবার আজাদ হিন্দ ফৌজে। সুবিস্তৃত এই পটভূমিকে পেছনে রেখে এই সময়ের তরুণী সাবিনার সত্যানুসন্ধান শুরু হয়। অনুসন্ধানের শুরুটা ঘটল বইয়ের প্রথম পরিচ্ছেদে—রেলস্টেশনে সস্তা জিনিসপত্রের মাঝখান থেকে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড বই কিনে ট্রেনে বসে পড়তে শুরু করার মাধ্যমে। ওই বইয়ে নাম অনিতা সেনের স্মৃতিকথা। এই অনিতা সেন বরাক আসাম ভ্যালির কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী। এরপর একবার ব্রিটিশ আমলের অনিতা সেন আর একবার স্বাধীন বাংলাদেশের সাবিনা—এই দুই তরুণীর চোখে আর ভাবনায় গোটা স্বাধীনতার আন্দোলন উল্টে-পাল্টে পড়বেন পাঠক।
শাহীন আখতারের অসুখী দিন উপন্যাসে আদতে এই দুজনেরই স্মৃতিকথা বা সত্যানুসন্ধান পারিবারিক নানা অ-উন্মোচিত রহস্যের সমাধানের পথে এগিয়ে চলে। অনিতা সেনের ভাই নীরদচন্দ্র সেন সুভাষ বোসের আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দিতে পা বাড়িয়েছিল রেঙ্গুনের পথে। অতঃপর নিখোঁজও হয়েছিল। ওদিকে সাবিনার পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাবা মোয়াজ্জেম হকও এ কাজ করেছিল তার যৌবনে। দুটি ঘটনার যোগসূত্র মিলিয়ে মিলিয়ে কুলাউড়া-শিলচর-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম-রেঙ্গুন-শিলং-কলকাতার পথে যাত্রা শুরু হবে আমাদের। এই যাত্রাপথে কখনো মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনে দীক্ষিত অনিতার বাবা অহিংস হয়েও কারাবরণ করবে, কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে কমরেডদের সামনে ‘কুণ্ঠাহীন আনুগত্যে’ ব্যর্থ হয়ে কান্না চাপার চেষ্টা করবে অনিতা সেন, কখনো আবার নেতাজির হলওয়েল মনুমেন্ট সরানোর ডাকে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের হিন্দু-মুসলিম ছাত্রদের সঙ্গে একই কাতারে বেরিয়ে আসবে নীরদচন্দ্র সেন আর মোয়াজ্জেম হক, কখনো–বা গান গেয়ে উঠবেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস বা নেত্রকোনার রসিদউদ্দিন। একই যুদ্ধের, একই আন্দোলনের কত কত দিক আর কত রকমের মুখ দেখতে পাব আমরা এই পথচলায়। সেই চলার মধ্যে কখনো আর ফিরে আসেনি অনিতার ভাই নীরদ। সাবিনার বাবা মোয়াজ্জেম ফিরেছে বটে, কিন্তু যখন ফিরেছে, সে তখন অবশ্য ‘যুদ্ধ-ধ্বস্ত, জেলখাটা ছাব্বিশ বছরের বিমর্ষ যুবক। পেছনে অগণিত সহযোদ্ধার লাশ, সামনে দীর্ঘ জীবন। যা বাংকারের মতো ফাঁপা, অন্ধকার আর বিষাদময়।’

শিল্পী: জামাল আহমেদ
শিল্পী: জামাল আহমেদ

বিষাদময়? তা তো বটেই। যে বন্ধু তাকে এঁদো গ্রাম থেকে এনে কলকাতা চিনিয়েছিল, যে বন্ধু একদিন ইসলামিয়া কলেজ থেকে মিছিলে টেনে নামিয়েছিল, সেই জহরকেই তো বলতে শোনা যায় ‘পাকিস্তান চেয়েছে মুসলিমরা, তাদের পাকিস্তানেই যাওয়া উচিত।’ মোয়াজ্জেম তখন ভাবে, ‘তাকে কি কলকাতা হারাতে হবে, তা-ও এমন একজনের কথায় যে তাকে হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো বাঁশি বাজিয়ে একদিন এ শহরে এনেছিল?’
হ্যাঁ, দিনের শেষে ‘সুখ’ কি সত্যি মেলে? এভাবেই চলতে চলতে একই ‘ওয়ার সেমেট্রি’তে দুই ভিন্ন সময়ে পা ফেলবে এই দুই তরুণী অনিতা ও সাবিনা, পড়বে একই এপিটাফ, ‘হোয়েন ইউ গো হোম, টেল দেম অফ আস, অ্যান্ড সে—ফর দেয়ার টুমরো, উই গেভ আওয়ার টুডে।’ এই এপিটাফ পড়তে গিয়ে এই সময়ে দাঁড়ানো সাবিনার মনে হবে ওর সঙ্গে যেন পড়ছে আরেকজন, ওর ঘাড়ের ওপর বিগত সময়ের আরেকজনের উষ্ণ নিশ্বাস। আজ ও আগামীকালের এই মাখামাখির ব্যাপারটি কাহিনিজুড়ে দুজন নারীর হাত ধরে চলবে, চলতে থাকবে। কোনো একদিন, কাহিনির শেষে সে কালের অনিতা সেনের ঘরে প্রবেশ করবে এ সময়ের সাবিনা। বহু আগের এক নারীর মণিপুরি উলের চাদরে নিজেকে জড়িয়ে সাবিনার মনে হবে, এ এক মমতাময়ী প্রেতাত্মা। অনিতা বা সাবিনা ডায়েরিতে লিখবে, ‘আমি সত্যি বুঝতে পারি না, কোথায় সত্যের শেষ আর ফিকশনের শুরু!’
সত্য আর কল্পনা—এই দুইয়ের মিশেলে এক অপূর্ব কাহিনি শুনিয়েছেন কথাশিল্পী শাহীন আখতার তাঁর অসুখী দিন উপন্যাসে, যেখানে এত কিছুর পরও ‘সুখ’-এর দেখা কি সত্যি মেলে, মিলেছে?