নীরেন্দ্রনাথের প্রয়াণে

নিজের ঘরে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (১৯ অক্টোবর ১৯২৪—২৫ ডিসেম্বর ২০১৮)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
নিজের ঘরে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (১৯ অক্টোবর ১৯২৪—২৫ ডিসেম্বর ২০১৮)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
>

২৫ ডিসেম্বর মারা গেছেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তাঁকে নিয়ে আয়োজন

কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী পরিণত বয়সেই (১৯২৪—২০১৮) চলে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ যুগ-উত্তর সময়ের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় কবি ছিলেন তিনি। বাংলা কবিতা যে নতুন আদল, প্রকরণ ও আধুনিকতা নিয়ে হিরের দ্যুতির মতো ঝলমল ও ছন্দের নবীন নিরীক্ষায় সিদ্ধি অর্জন করেছে, তাতে তাঁর কৃতিত্ব কম নয়। ছন্দ ছিল তাঁর কবিতার প্রাণ। তিনি কতভাবে যে ছন্দ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তা বলে শেষ করা যায় না। যেকোনো নবীন কবির জন্য তাঁর রচিত কবিতার ক্লাশ গ্রন্থটি হয়ে উঠেছিল অবশ্যপাঠ্য। ছন্দে তিনি যত্ন ও মনোযোগের জন্য বহু তরুণকে দীপিত করেছেন। তিরিশ, চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশক থেকে বাংলা কবিতা নানাজনের প্রতিভার স্পর্শে শিখরস্পর্শী, লোকপ্রিয় ও জীবনের নানা দিক উন্মোচনে আশ্চর্য দক্ষতা অর্জন করলেও এই কবির এ ক্ষেত্রে ভিন্ন দায় বহন করেছিল তাঁর সাহিত্যবোধ। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথায়, ‘কবির কাজ তাঁর নিজস্ব হৃদয়কে উন্মোচিত করে দেখানো। কিন্তু তার মানে কি এই যে শুধু ব্যক্তিগত কিছু দুঃখ-সুখের কথাই তিনি বলবেন? আমার তা মনে হয় না।...সন্ন্যাসী তিনি নন। তিনিও সামাজিক মানুষই। উপরন্তু, ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক তাঁকেও একটি রাজনৈতিক বিন্যাসের মধ্যেই নিশ্বাস নিতে হয়। ফলত, তাঁর চতুষ্পার্শ্বের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলি, প্রায় অনিবার্যভাবেই তাঁর ওপর ছায়া ফেলতে থাকে।’

এই দায়কে তিনি কোনোদিন উপেক্ষা করেননি। সরল, নিরাভরণ ছিল তাঁর কবিতা। কোনো রহস্য ও দুর্বোধ্যতার আড়াল ছিল না তাঁর সৃজনে। তাঁর কথায়, কবিতায় ‘গদ্যই আমার মাতৃভাষা’। এই প্রকরণকেই নিজস্ব এক নির্মিতির সৌজন্যে প্রসারিত করেছেন। টানটান গদ্যে বলতে চেয়েছেন তাঁর অন্তরের বয়ান। ছন্দবাহিত এই বয়ান হয়ে উঠেছে ভিন্ন স্বর ও ভিন্নমুখীন। কবিতার গঠন কারুকার্যে তাঁর কবিতা স্পন্দ নিজস্ব চরিত্র নির্মাণ করেছে।

তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ নীলনির্জন সত্যজিৎ রায়ের প্রচ্ছদে যখন বেরোল ১৩৬১ সালে, অনেক তরুণ পাঠক এই কাব্যগ্রন্থের হৃদয়গ্রাহী আবেগে উদ্দীপিত বোধ করেছেন। কোরক সাহিত্যপত্র ১৯৯৮ সালে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে নিয়ে একটি শ্রদ্ধাজ্ঞাপক বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত করেছিল। তাতে অনেকের মূল্যায়ন ও স্মৃতিচারণে এ প্রসঙ্গটি খুবই প্রণিধানযোগ্য হয়ে উঠেছে।

এরপর ছয় বছরের ব্যবধানে প্রকাশিত হয়েছিল দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ অন্ধকার বারান্দা। পঞ্চম গ্রন্থ কলকাতার যিশু ও ষষ্ঠ গ্রন্থ উলঙ্গ রাজা প্রকাশের পর তাঁর কাব্যকীর্তি নবীন মাত্রা অর্জন করেছিল। সরলতা, অভিব্যক্তি ও কাব্যিক গুণে তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছিল বাংলা কবিতায় বিশিষ্ট।

তাঁর জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার চান্দ্রা অঞ্চলে। ঠাকুরদার কাছে হাতেখড়ি হয়েছিল শিশুশিক্ষায়। ঠাকুরদার কাছেই অল্পবয়সে জীবনের পাঠ নিয়েছেন। এই অঞ্চলের নিসর্গ বাল্যকালেই তাঁকে মুগ্ধ করছিল। ঠাকুরদার স্নেহছায়ায় মানুষ হয়েছেন তিনি। ভোলেননি ঠাকুরদাকে।

জন্মভিটে, পরিপার্শ্বের উদার প্রকৃতি পরিণত বয়সেও তাঁকে স্মৃতিকাতর করে তুলত। তাঁকে যখন অল্পবয়সে কলকাতায় তাঁর ভাষায় পাঠানো হলো স্কুলে পড়াশোনার জন্য, একদিনের জন্য ফরিদপুরের চান্দ্রা তাঁর হৃদয় থেকে ছেড়ে যায়নি।

ফরিদপুরের চান্দ্রা তাঁর মানস গঠনে প্রবলভাবে ছাপ ফেলে। পরিণত বয়সে যখন লিখছেন আত্মজৈবনিক নানা রচনা, তাতে এই অঞ্চল এবং ছেলেবেলার স্মৃতি বিশ্বস্ততার সঙ্গে উঠে এসেছিল। বাবার কাছে পেয়েছিলেন সাহিত্যের রুচি। আত্মজীবনীতে তাঁর সাহিত্যমানস গড়ে ওঠার পেছনে বাবার অবদানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন। অধ্যাপক বাবা জিতেন্দ্রনাথ শেকস্‌পিয়র পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভাষাতত্ত্বও পড়াতেন। শেকস্‌পিয়র-বিশেষজ্ঞ ছিলেন তিনি। তিনি শিক্ষকতা করতেন। শিক্ষকতার এই ধারাকেই বহন করে নীরেন্দ্রনাথের পুত্র ও কন্যারা আজ কলকাতায় শিক্ষা পরিমণ্ডলে খ্যাতিমান। এক কন্যা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ভাষা, বানান ও ব্যাকরণ নিয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে এ ক্ষেত্রে তিনি বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছিলেন।

বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে যখন আমাদের অনেক তরুণের কাব্যরুচি একটু একটু করে নানা আলোড়ন ও অভিজ্ঞতার মধ্যে গড়ে উঠছে, সেই সময়ে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ছিলেন আমাদের কাছে সমীহ-জাগানিয়া এক কবি। নানা বাধা পেরিয়ে যখন তাঁর বই আসত নিউমার্কেট এবং স্টেডিয়ামের বইয়ের দোকানে, আমাদের মনের ভেতরে আলো সঞ্চারিত করত তাঁর বই। তাঁর কবিতার ঘোর আমাদের ভিন্ন এক জগৎসংসারে নিয়ে গিয়েছিল। ‘অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল’, ‘শীতাংশু’ ও ‘কলকাতার যিশু’র লালবাতি আমাদের মানস-চৈতন্যের দিগন্তকে প্রসারিত করেছিল। অমলকান্তি তাঁর স্কুলজীবনের বন্ধু ছিল। এ কবিতাটি কীভাবে রচিত হয়েছিল নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তা সবিস্তারে বর্ণনা করেছিলেন। অজিত দত্তের ‘মালতী তোমার মন’, অমিয় চক্রবর্তীর ‘কেঁদেও পাবে না বৃষ্টির অজস্র জলধারে’ ও জগন্নাথ চক্রবর্তীর ‘প্রেম অপ্রেম সমৃদ্ধ ইজেল ও বুনো পারাবাত’ আমাদের জীবনের বিষাদ ও হর্ষে অঙ্গীভূত হয়ে গিয়েছিল। জীবন ও মননধর্মে কবিতা কী করতে পারে—এ জিজ্ঞাসায় আলোড়িত হয়ে আমরা বলতেই পারি, সুন্দরের অভিপ্রায়ে এ গভীর ছাপ রেখে যায়। কবিতা কখনো-সখনো হৃদয় যন্ত্রণার আলোড়নে জীবনকে দেখার ধরনে কিংবা প্রেয়সীর সুষমাকে মুগ্ধ বিস্ময়ে অবলোকন শেখায়।

নীরবিন্দু আত্মজীবনী, সমকালীন সমাজজীবনের জলছবিও। এই গ্রন্থে আছে পারিবারিক সমাজজীবন ও কলকাতা বসবাসের অভিজ্ঞতা। তাঁর অভিজ্ঞতা আমাদের উতলা করে এবং পাঠকও স্মৃতিকাতরতায় উন্মনা হয়। এ ছাড়া সত্যযুগ সংবাদপত্রের বার্তা বিভাগে কাজ এবং পরবর্তীকালে সংবাদপত্রে সম্পাদনাকর্মে দীর্ঘযাত্রার বিবরণ আছে নীরবিন্দুতে।

আমরা অবশ্য জানি যে কত আন্তরিকতায় এবং পরম যত্নে তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দমেলা। বহু প্রতিষ্ঠিত লেখককে প্রেরণা সঞ্চার করেছিলেন শিশু ও কিশোরদের জন্য লিখতে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে বহু সংগীতশিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী যখন উদ্বাস্তু ও নিরাশ্রিত জীবনযাপন করছেন, তখন কলকাতার ১৪৪ লেনিন সরণিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সহায়ক সমিতি। এই সমিতির তিনজন সম্পাদকের মধ্যে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ছিলেন অন্যতম সম্পাদক, সভাপতি ছিলেন চিকিৎসক মনি বিশ্বাস।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সত্যিকার অর্থেই তিনি বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু হয়েছিলেন। বাংলাদেশ নিয়ে অনেক কবিতায় সে সময়ের মর্মযাতনা প্রতিফলিত হলেও সর্বাধিক আলোচিত ও পঠিত ছিল অবরুদ্ধ দেশে শামসুর রাহমানকে নিয়ে তাঁর উৎকণ্ঠাবিষয়ক একটি কবিতা। তাঁর ভাষায়, ‘সত্যিই সে এক দুঃসময়। বাঙালি জীবনে এত বড় দুঃসময় আগে কখনো আসেনি। ভিটেমাটি ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে এপারে চলে এসেছিল। আমাদের প্রতিবেশী দেশের মানুষেরা যখন বিপন্ন, তখন আমরা কি আর চুপ করে বসে থাকতে পারি? তখনই আমরা তৈরি করেছিলাম বাংলাদেশ শিল্পী সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী সমিতি।

সেখানে বাংলাদেশ থেকে আগত লেখক-শিল্পীদের একত্র করে নানারকম অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও তালিম দেওয়ার কাজ হতো। অনুষ্ঠান করে শুধু অর্থসংগ্রহ করা নয়, মানুষকে এই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অবহিত করাও হতো। যাঁরা কলকাতায় এসেছিলেন, তাঁদের জন্য সাধ্যমতো থাকার ব্যবস্থাও আমরা করেছিলাম। অনেকেরই ছোটখাটো কর্মসংস্থানের কাজ আমরা করতে পেরেছিলাম। মোটকথা, বিপদের দিনে বিপন্ন মানুষের পাশে যেমন সম্পন্ন মানুষেরা এসে দাঁড়ায়, আমরাও তেমনি যতটা পেরেছি করেছি।

যুদ্ধের শেষদিকে আমাদের জন্য বাংলাদেশের সাতক্ষীরা যাবার ব্যবস্থা হয়। আমি গিয়েছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গাড়িতে। ওই গাড়িতে আরো ছিলেন তারাপদ রায় ও সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। আমরা সবাই মিলে প্রথমে বসিরহাটে যাই। বসিরহাটের ভোমরায় গাড়ি রেখে আমরা নৌকাযোগে ইছামতী নদী পার হয়ে সাতক্ষীরায় যাই। সেখানে তখন লোকে লোকারণ্য। সে ছিল ’৭১-এর ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধের একদিন। ওখানেই প্রথম বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ তোলা হয়। গাওয়া হয় ও দেশের জাতীয় সংগীত আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’

কলকাতার বারতা পাবলিকেশন্স যখন কালি ও কলম প্রকাশ করেছিল ২০১৫ সালে, তিনি হন এই পত্রিকার সম্পাদক। তখন থেকে বাংলাদেশের লেখক ও কবিদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ও এ দেশের লেখালেখি সম্পর্কে প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবেও তাঁর সঙ্গে সে সময় থেকে এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে পড়ি। তাঁকে হারিয়ে কত স্মৃতিই না আজ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।