'প্রতিষ্ঠানবিরোধী থাকতে থাকতে আমরা ক্রমশ প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ঢুকে পড়েছি'

>

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কলকাতার জনপ্রিয় সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল এবিসি রেডিওর জন্য, ২০১২–এর ৪ জানুয়ারি। সাক্ষাৎকারে নিজের সাহিত্য ও জীবন সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন খোলামেলা কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সাজ্জাদ শরিফ

সাজ্জাদ শরিফ: আমাদের কলকাতার প্রয়াত কবিবন্ধু জয়দেব বসু লিখেছিল, ১৯৫০-এর দশকের কবিদের মতো আত্মবিজ্ঞাপনে পারদর্শী আর কেউ নন। আপনার প্রথম উপন্যাস আত্মপ্রকাশ-এর নায়কের নাম সুনীল কেন?

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: নতুন ধরনের একটা কিছু করার জন্য। বাংলা ভাষায় লেখকেরা সাধারণত নিজের নাম দেয় না। লেখকেরা নিজেরা জীবনে অনেক রকম কাণ্ড করে, কিন্তু লেখায় সেগুলো গোপন করে যায়। আমি ভাবলাম, লেখার সঙ্গে জীবনের তফাত থাকবে না। প্রথম দিকে যে উপন্যাসগুলো আমি লিখি, সব নিজের জীবনের কথা। চাপে পড়ে যখন অনেক লিখতে আরম্ভ করলাম, তখন দেখলাম, বারবার নিজের জীবন ভাঙিয়ে ভাঙিয়ে পারা যাবে না। অল্প বয়স থেকে আমার প্রিয় বিষয় হচ্ছে ইতিহাস। ঊনবিংশ শতকের যে সময়টাকে আমাদের এখানে পুনর্জাগরণ বলা হয়ে থাকে, ভাবলাম, সেই সময়টাকে নিয়ে লিখি না কেন? স্বপ্নে দেখলাম, মাইকেল মধুসূদনের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের ঝগড়া হচ্ছে। ভাবলাম, এঁদের জীবন্ত করে লিখলেই তো হয়। এঁদের জীবনী লেখা হয়েছে, কিন্তু এঁদের তো উপন্যাসের চরিত্র করে লেখা হয়নি। সেভাবে সেই সময় উপন্যাসের শুরু।

সাজ্জাদ: আত্মপ্রকাশ উপন্যাসে আপনি লিখেছেন যে উপন্যাসের নায়ক চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করছে। বাস্তবেও কি তেমন কিছু করেছিলেন?

সুনীল: হ্যাঁ, চৌরঙ্গীর মোড়ে একদিন দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। তখন ওটাকে সাহেবপাড়া বলা হয়। এ ছাড়া সব বড়লোক সেজেগুঁজে ওই পাড়ায় ঘুরে বেড়াত। আমাদের তো তখন তরুণ বয়স। আড্ডা দিতে, ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছা করে প্রতিদিন। কিন্তু সেসব করতে তো পয়সার প্রয়োজন অনেক। আমাদের ভেতর একজন বলে উঠল, ভিক্ষা করলে কেমন হয়? কথামতোই কাজ শুরু হয়ে গেল। দাঁড়িয়ে পড়লাম রাস্তার মোড়ে হাত পেতে। কিন্তু কেউ দেখি ভিক্ষা দিতে চায় না। সবাই ‘হুড়হুড়’ করে তাড়িয়ে দেয়। তখন আমরা চালাকি করে ইংরেজি বলতে শুরু করলাম। লোকজন তো অবাক। আরে! এ দেখি ইংরেজি বলা ভিখিরি।

সাজ্জাদ: আপনার আগে লেখা উপন্যাসগুলো তরুণদের মন স্পর্শ করেছিল। এখনকার তরুণদের মন কি আপনি বুঝতে পারেন?

সুনীল: যারা সাহিত্য পছন্দ করে, তেমন তরুণ-তরুণীদের কথা আলাদা। সাহিত্যের সেরা রূপটাই ওরা পছন্দ করবে। কিন্তু এখনকার যেসব তরুণ পড়াশোনা করে, চাকরি করে, ব্যবসা-বাণিজ্য করে, তাদের ভাষা বা মন-মানসিকতা আমি জানি না। এখনকার তরুণেরা তাদের কথার ভেতরে অর্ধেকটা ইংরেজি বলে, হিন্দিও বলে। আমরা এমনটা করতাম না। তাদের যে জীবনযাত্রা, যে মূল্যবোধ, সেটা আমাদের সঙ্গে মেলে না।

সাজ্জাদ: আপনার উপন্যাসে কি সে কারণেই তরুণ-তরুণীদের চরিত্র কমে আসছে?

সুনীল: ওদের ব্যাপার তেমন একটা বুঝি না বলেই সেভাবে আমি কিছু লিখি না। লিখলেও চেষ্টা করি স্মৃতিকাতরতা এনে একটু ইতিহাস মিশিয়ে দিতে।

সাজ্জাদ: আপনার ইতিহাসভিত্তিক পূর্ব-পশ্চিম উপন্যাসটি নিয়ে কিন্তু পাঠকদের মধ্যে সমালোচনা আছে। এর বহু চরিত্রকে আমরা জানি, ঘটনাগুলো দেখেছি। ফলে উপন্যাসের সঙ্গে বাস্তবের যে ব্যবধান, তার অভিজ্ঞতা পাঠককে বিড়ম্বিত করেছে।

সুনীল: খুব বেশি বাস্তববিমুখ কখনো হয়েছি বলে তো মনে পড়ে না। সব সময় চেষ্টা করেছি জীবনের সত্য ঘটনাই উপন্যাসের চরিত্রে ফুটিয়ে তোলার। তবে প্রতিটি পাঠকের কিন্তু ঘটনা বোঝার জন্য আলাদা আলাদা বাঁক রয়েছে। কোন পাঠক কোন উপন্যাসকে কীভাবে চিন্তা করছেন, কী তিনি ভাবছেন—তা বোঝা মুশকিল। আর সেই সময় নিয়ে তো তখন বেশ আইনি জটিলতা হয়েছিল। উপন্যাসটিকে সরকারি পুরস্কার দিতে গিয়েও তারা সিদ্ধান্ত বদলে ফেলে। কারণ, আমি দেখিয়েছিলাম যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছাত্রজীবনে সমকামী ছিলেন। আমাদের দেশে তো যাঁরা একবার বিখ্যাত হয়ে যান, তাঁদের কোনো দোষ আমাদের চোখে পড়ে না। তাঁরা আমাদের চোখে মহাপুরুষ হয়ে যান। তাঁদের নিয়ে সত্যি কিছু বললেও মানুষ সহ্য করতে পারে না। তবে আমি কখনো এসবের পরোয়া করিনি। আমি তাঁদের সব সময় রক্ত–মাংসের সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখার চেষ্টা করেছি।

সাজ্জাদ: আপনি আত্মজীবনীমূলক লেখা লিখেছেন অনেক। সেসব পড়ার সময় বারবার মনে হয়েছে, স্পর্শকাতর বিষয়গুলো আপনি এড়িয়ে গেছেন। বাইরের ঘটনার কথা অনেক বললেও নিজের অন্তরঙ্গ কথা কমই বলেছেন। এর কোনো বিশেষ কারণ আছে কি?

সুনীল: নিজের সব কথা তো আর মানুষকে বলা যায় না। এ জন্যই আত্মজীবনীর নাম দিয়েছিলাম অর্ধেক জীবন। এর মানে এটা নয় যে আমি আমার অর্ধেক জীবনের গল্প বলেছি সেখানে। আমার জীবনের যেসব গল্প মানুষকে বলা যায়, সেগুলোই আমি বলার চেষ্টা করেছি। সব গল্প তো আর মানুষকে বলা যাবে না। আর লেখার সময় আমি ঠিক করেছিলাম, কোনোভাবেই কারও সম্পর্কে খারাপ কোনো মন্তব্য করব না।

সাজ্জাদ: আপনি আপনার প্রেমের কথাও তেমন লেখেননি। আপনার আর মার্গারিটের প্রেমের গল্প যদিও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

সুনীল: বিয়ের পর কি আর কেউ আগের প্রেমের কথা বলবে, বলো? স্বাতীর সঙ্গে যখন আমার বিয়ের আলোচনা চলছিল, তখন আমি ওকে মার্গারিটের কথা বলেছিলাম। তাকে বলেছিলাম, মার্গারিট নামে একটা মেয়ের সঙ্গে আমার গভীর বন্ধুত্ব। একরকম প্রেমই বলা চলে। তখন ও আমাকে বলল, ‘শোনো, বিয়ের আগে যা করেছ করে ফেলেছ। সেটা নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না। বিয়ের পর যেন আর কিছু না শুনতে হয় আমাকে।’

সাজ্জাদ: তাঁর কথা কি রাখতে পেরেছিলেন?

সুনীল: সে কথা তোমায় বলব কেন?

সাজ্জাদ: স্বাতীর সঙ্গে আপনার পরিচয় কীভাবে হয়েছিল?

সুনীল: আমার লেখা পড়ে ও আমাকে চিঠি লিখত। আমিও চিঠির উত্তর দিতাম। চিঠি থেকেই আমাদের আলাপ শুরু হয়। আমি তখন দমদমে খোলামেলা এক পরিবেশে থাকি। সেখানকার রাস্তাঘাটের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। হঠাৎ দেখি গাড়ি করে এক ভদ্রলোক এসেছেন। সঙ্গে বিভিন্ন বয়সের তিন ভদ্রমহিলা। তিনি এসেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনাদের এখানে কৃত্তিবাস কিনতে পাওয়া যায়?’ আমি তো অবাক। আরে, আমি কি এখানে কৃত্তিবাস বিক্রি করি নাকি? ওসব তো স্টলে কিনতে পাওয়া যায়। যা-ই হোক, তাঁরা কী বুঝলেন কে জানে। চলে যাওয়ার সময় হঠাৎ একটা মেয়ে রহস্যজনকভাবে পেছন ফিরে প্রশ্ন করল, ‘আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, করুন।’ মেয়েটি ‘আচ্ছা থাক, পরে’ বলে হঠাৎ গাড়িতে উঠে চলে গেল। তার কয়েক মাস পরের কথা। আমি তখন আনন্দবাজার-এ নিয়মিত ফিচার লিখছি। একদিন দেখি তিন ভদ্রমহিলা তাঁদের পরিচিত একজন মানুষের সঙ্গে অফিসে এসেছেন। খবরের কাগজের অফিস দেখতে কেমন হয়, সেটা দেখতে এসেছে আরকি। একজন আমার কাছে তাঁদের নিয়ে এল আলাপ করানোর জন্য। কথা বলতে গিয়ে দেখি, ওই তিন মেয়ের ভেতরে সেই ‘আচ্ছা থাক’ বলা মেয়েটিও আছে। পরে জানতে পেরেছি, সেই মেয়েটিই আমাকে নিয়মিত চিঠি লিখত। তারপর আমার সঙ্গে ওর বিয়ে। ওর বাড়ির লোকের অনেক আপত্তি ছিল। আমি তো চিরকালই বাউন্ডুলে। কখন বাড়ি ফিরি না-ফিরি তার ঠিক থাকে না। তা ছাড়া আমি বাঙাল। ওরা ছিল খাঁটি কলকাতার মানুষ। এখন তো আমরা এত মিলেমিশে গেছি যে আর ভেদ করা যায় না।

সাজ্জাদ: আপনি সব সময় বলে এসেছেন যে আপনার প্রথম প্রেম হলো কবিতা। একসময় ‘ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি’ কবিতায় আপনি লিখেছিলেন, গুজরাটের বন্যার সময় প্রকৃতির বিধ্বংসী রূপ দেখতে গিয়ে তাঁর মুখ ফসকে বেরিয়ে যেতে পারে, ‘বাহ্​, কী সুন্দর।’ কবিতাটি নিয়ে পরে কিছু হয়েছিল?

সুনীল: না, তা হয়নি। আমি নিজেই একবার হেলিকপ্টারে করে বন্যার সময় গিয়েছিলাম। বন্যাপ্লাবিত এলাকা, কিন্তু হেলিকপ্টার থেকে দেখে মনে হয়েছিল, বাহ্, ওপর থেকে তো বেশ সুন্দর দেখায়। বন্যায় মানুষের যে এত কষ্ট-দুঃখ, সেটা তো আর ওপর থেকে বোঝা যায় না। কী সুন্দর জলের মধ্যে গাছগুলো, ছোট ছোট ঘর মাথা তুলে আছে। তখন ভাবলাম, ইন্দিরা গান্ধীর মতো রাজনীতিবিদেরা তো বন্যা হলে প্রায়ই যান। সেখান থেকে ফিরে পরে তাঁরা বিবৃতিও দেন। আমি ভাবলাম, তিনিও যদি কোনো দিন আমারই মতো করে ভেবে বসেন, বাহ্, কী সুন্দর। এটা ভেবেই আসলে কবিতাটা লেখা। এই কবিতাটা নিয়ে তোমাকে একটা ছোট মজার কথা বলি। ওই কবিতায় এমন একটা লাইন ছিল:

তোমার শুকনো ঠোঁট, কত দিন সেখানে চুম্বনের দাগ পড়েনি,

চোখের নিচে গভীর কালো ক্লান্তি...

‘চুম্বনের দাগ পড়েনি’ বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছি যে তাঁর মেজাজ খুব তিরিক্ষি হয়ে থাকে। এ রকম একটা লাইন দেশের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে ব্যঙ্গ করে লিখে ফেললাম। পরবর্তী সময়ে এই কবিতার ইংরেজি অনুবাদ একটা পত্রিকায় ছাপা হয়। ফলে পত্রিকাটি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। দিল্লির আরেকটা ম্যাগাজিনেও এই কবিতাটার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করা হয়। ইন্দিরা গান্ধী তখন একটা লিটল ম্যাগাজিনের প্রদর্শনী উদ্বোধনী করতে গেছেন। সেখানে এক তরুণ তাঁর সামনে গিয়ে হঠাৎ ওই পত্রিকাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, এটা পড়ুন।’ ইন্দিরা গান্ধী সেটা পড়লেন। পড়ে মন্তব্য করলেন, ‘নটি, ভেরি নটি।’ বলে চলে গেলেন। এমন কিন্তু নয় যে এর জন্য আমাকে শাস্তি দিয়েছিলেন বা কিছু।

সাজ্জাদ: আপনার সঙ্গে কি এরপর আর কখনো দেখা হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর?

সুনীল: দু-তিনবার দেখা হয়েছে। তবে ঘনিষ্ঠ হওয়ার মতো কিছু নয়।

সাজ্জাদ: একজন সাধারণ সাহিত্যিক হিসেবে আপনার জীবন শুরু হয়েছিল। তারপর অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে। শুরুর দিকের জীবন আপনি প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মে কাটাননি। পরবর্তী সময়ে বড় বড় জায়গায় কাজ করতে গিয়ে নিজের চিন্তার স্বকীয়তা কি আদৌ ধরে রাখতে পেরেছিলেন? নাকি নিজের মধ্যে সব সময় দোদুল্যমান অবস্থায় জীবন কেটেছে?

সুনীল: আজ যদি আমার বয়স ৩২ হতো, তাহলে আমি সাহিত্য একাডেমির এই সভাপতির পদ নিয়ে উপহাস করতাম। কিন্তু প্রতিষ্ঠানবিরোধী থাকতে থাকতে আমরা ক্রমশ প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ঢুকে পড়েছি। যেমন আমাদের বয়সী অনেককেই চাকরির জন্য, জীবিকার জন্য আনন্দবাজার পত্রিকায় যেতে হয়েছে; প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম মেনে কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আসলে অনেক কিছু রোধ করা যায় না। যেমন ধরো, সাহিত্য এডাডেমির সভাপতি আমি হতে চাইনি। এটা তো সারা ভারতবর্ষের জন্য একটাই। সবাই বলে উঠল, অনেক দিন কোনো বাঙালি আসেনি। এই বাঙালির দোহাই দিয়ে তারা আমাকে পদটিতে বসিয়ে দিল। তবে এর ফলে আমি প্রচুর ঘোরাঘুরি করতে পেরেছি। আমাকে ভারতের বিভিন্ন শহরে যেতে হয়। ভারতের বাইরেও সাহিত্যিকদের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হয়। একসময় ঘোরাঘুরি খুব ভালো লাগত। এখন আর ভালো লাগে না। আর নিজের লেখালেখিও তো বেশ কমে গেছে। আমি পড়তে খুব ভালোবাসি। এখন তো ঠিকমতো পড়ার সময়ও পাই না।