কবিতাকুঞ্জের কাছে মানুষের কাছে

>

নেত্রকোণার মালিনীতে কবিতাকুঞ্জের প্রাচীরের গ্রিল ধরে নির্মলেন্দু গুণ। ছবি: খালেদ সরকার
নেত্রকোণার মালিনীতে কবিতাকুঞ্জের প্রাচীরের গ্রিল ধরে নির্মলেন্দু গুণ। ছবি: খালেদ সরকার

কবি নির্মলেন্দু গুণ নিজের জন্মভূমি নেত্রকোণায় গড়ে তুলেছেন ‘কবিতাকুঞ্জ’ নামে কাব্য–গবেষণার একটি প্রতিষ্ঠান। তাঁর সঙ্গে নেত্রকোণায় গিয়ে দেখা হলো অভিনব সেই জগৎ, জানা গেল প্রতিষ্ঠানটির উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম। আমাদের এই যাত্রায় কবিও খুঁজে পেলেন তাঁর হারিয়ে যাওয়া এক বন্ধু–পরিবারকে। লিখেছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ

নেত্রকোণার মগরা নদীর পাশে একটি বাড়িতে অন্যরকম সাড়া পড়ে গেল এক দুপুরবেলা। নিস্তরঙ্গ দুপুরের রংই যে বদলে গিয়েছিল সেদিন। বাড়ির মানুষেরা প্রতিদিন যেভাবে দুপুর কাটায়, গেল বছরের ২০ এপ্রিল ওই বাড়ির দুপুরটি তেমন ছিল না। আজ এই ২০১৯–এর জানুয়ারিতে দাঁড়িয়েও সেই সব দৃশ্য েযন ছবির মতো ভেসে আসছে। হ্যঁা, সেদিন বাড়ির মানুষজনের ভেতর নিশ্চিতভাবেই ছিল রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা, ‘কখন আসবে কবি?’

অবশেষে সাদা চুল আর শ্মশ্রুমণ্ডিত সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটি এলেন। তাঁর সঙ্গে লটবহরের মতো ছিলাম আমরাও।

কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে নেত্রকোণা-যাত্রার প্রথম দিকে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল একটিই—তাঁর গড়া ‘কাশবন’ ও ‘কবিতাকুঞ্জ’—এই দুই প্রতিষ্ঠান চর্মচক্ষে দেখা। ‘কাশবন’ বেশ আগে তৈরি করলেও কবিতা নিয়ে গবেষণার জন্য ‘কবিতাকুঞ্জ’ তিনি তৈরি করেছেন বছর দুই হলো। তবে আমাদের এই পরিকল্পনা-সূচিতে অকস্মাৎ জায়গা করে নিলেন এক মুক্তিযোদ্ধা—ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী। তিনি ছিলেন কবির কলেজজীবনের বন্ধু। নেত্রকোণার মগরা নদীর পার্শ্ববর্তী এই ইলিয়াস আহমদের বাড়িতে বসে তাঁর সন্তান–সন্ততিদের সামনেই নির্মলেন্দু গুণ সেদিন দুপুরবেলা আওড়াচ্ছিলেন নিজের আত্মস্মৃতি আমার কণ্ঠস্বর থেকে, ‘...অলঙ্ঘনীয় হিমালয়ের মতোই ইলিয়াস আমার পথ আগলে দাঁড়াল। আমি ইলিয়াসের আলিঙ্গনের মধ্যে বন্দী হয়ে গেলাম। মনে মনে বললাম, বাঁচা গেল। একটা বড় ফাঁড়া কেটেছে। আমি তো যেতে চাই না, আমি তো থাকতেই চাই। এই দেশ, এই জন্মভূমি ছেড়ে আমি কোথায় যাব? কেন যাব? দেশত্যাগের পথে ইলিয়াসই ছিল আমার শেষ বাধা। ওই বাধার বিন্ধ্যাচলটিকে টপকানো গেল না।’

পাকিস্তানি আমলে ষাটের দশকের শুরুর দিকে নির্মলেন্দু গুণ একবার ফেঁসেছিলেন ডাকাতির মিথ্যা মামলায়। পুলিশের ধড়পাকড় থেকে বাঁচাতে বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তে সেই সময়ের তরুণ অনামা কবি নির্মলেন্দু গুণ দেশ ছেড়ে চিরতরে পালিয়ে যাচ্ছিলেন ভারতে। ওই সময়ই তাঁর দেশত্যাগে বাধা দেন ইলিয়াস, সবার অগোচরে তাঁকে রেখে দেন নিজের ডেরায়। আমার কণ্ঠস্বর-এ সবটা সবিস্তার লিখেছেন তিনি। ওখানেই জানিয়েছেন, ১৯৯৫ সালে মারা গেছেন ইলিয়াস।

ধীরে ধীরে কবি তাঁর বই থেকে সেই অংশটি পড়েন, যেখানে ইলিয়াস ডাকাতির মিথ্যা মামলার ফেরারি আসামি গুণকে বলছেন, ‘তুই কবিতা লিখবি মানুষের ঘুম ভাঙানোর জন্য। পুলিশের ভয়ে তুই যদি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাস, এ কাজ করবে কে?’

তিনি পড়ছেন, আর তাঁর পাশে বসে শুনছেন ইলিয়াসের মেয়ে ইভানা ইলিয়াস। তাঁর চোখে চিকচিক করছে জলের আভাস। কবির লেখার মধ্য দিয়ে তিনি কি ততক্ষণে খুঁজে চলেছেন নিজের হারিয়ে যাওয়া পিতার অবয়ব?

নেত্রকোণার মালিনীতে কবিতাকুঞ্জের প্রবেশপথের ফলকে নিজের লেখা ‘আমন্ত্রণ’ কবিতাটির সামনে কবি। ছবি: প্রথম আলো
নেত্রকোণার মালিনীতে কবিতাকুঞ্জের প্রবেশপথের ফলকে নিজের লেখা ‘আমন্ত্রণ’ কবিতাটির সামনে কবি। ছবি: প্রথম আলো

চল মন নেত্রকোণা

নেত্রকোণার বারহাট্টা উপজেলার কাশতলা গ্রামের পৈতৃক ভিটায় ২০০৯ সালে নির্মলেন্দু গুণ গড়ে তুলেছিলেন পাঠাগার, সংগীতবিদ্যালয়, সংগ্রহশালাসমেত ‘কাশবন কমপ্লেক্স’। আর ১৯৯১-এ একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘কাশবন বিদ্যানিকেতন’ নামে। এ ছাড়া আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে তাঁর—কবিতামোদী ও কাব্য-গবেষকদের জন্য সাম্প্রতিক সময়ে নেত্রকোণা শহরের উপকণ্ঠে তৈরি করেছেন ‘কবিতাকুঞ্জ’। এই দুই প্রতিষ্ঠান দেখার বাসনা ছিল, কোন ধরনের এবং কী কী কাজ হয় এখানে, জানারও ইচ্ছা ছিল সে সম্পর্কে। কবিকে বলেছিলাম সে কথা। এর মধ্যে তিনি নিজেই যখন তাঁর সঙ্গে নেত্রকোণায় যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন, ‘হ্যাঁ’ বলতে আর দেরি হয়নি।

২০ এপ্রিল ২০১৮। শুক্রবার। মাইক্রোবাসে ঢাকা থেকে নেত্রকোণার উদ্দেশে যাত্রা শুরু হলো আমাদের। গাড়িতে উঠে তাঁকে বললাম, আপনার ভারত যাওয়া আটকেছিলেন যিনি, আপনার বন্ধু ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী, যাবেন তাঁর বাড়িতে?

‘ইলিয়াস তো মারা গেছে। ওর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ নেই অনেক দিন। ওরা কোথায় থাকে? তাঁকে তুমি কীভাবে চেনো?’ গুণের গলায় উত্তেজনা।

‘তাঁর ছেলে আমাদের বন্ধু। রুবাইয়াৎ আহমেদ। নাট্যকার। ঢাকায় থাকে। আর নেত্রকোণায় থাকেন ওর মা ও বোন।’

‘ইলিয়াসের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল ওর মৃত্যুর কয়েক দিন আগে। ইলিয়াসের বাড়ি চেনো?’

নির্মলেন্দু গুণের এই সব কথার মধ্যেই ছিল বন্ধুগৃহে যাওয়ার স্পষ্ট সম্মতি। অতঃপর কবি আসছেন শুনে সেদিন অন্য রকম সাড়া পড়ে গেল মগরার পাড়ঘেঁষা সেই একতলা বাড়িতে। আর দুপুর পেরিয়ে বিকেলে সেই বাড়ি থেকে যখন বেরিয়ে আসছি, নির্মলেন্দু গুণ সে সময় বন্ধুকন্যার মাথায় হাত রাখছেন পিতৃস্নেহে। এ এক বাবার হাত!

মালিনীর বুকে ‘কবিতাকুঞ্জ’

ঢাকা থেকে নেত্রকোণা—দুরত্ব নেহাত কম নয়। বাস্তবিক অর্থে এ যাত্রায় কথা ও কবিতার পথ ধরে তবেই পৌঁছানো হলো কবিতাকুঞ্জে। পথে যেতে যেতে নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে আবুল হাসানের মানিকজোড় বন্ধুত্ব, তাঁদের কবিতাময় উন্মাতাল সময়—কত কিছুই না এল! এত দিন কেবল শুনেই এসেছি কবিতা নিয়ে মহা-কায়কারবার হবে কবিতাকুঞ্জে। তবে সেদিন বিকেলে সেই কবিতাকুঞ্জের সামনে দাঁড়াতেই উত্তেজনা আরও বেড়ে গেল এর প্রবেশপথের ফলকের দিকে তাকিয়ে। এখানে উৎকীর্ণ হয়ে আছে ‘আমন্ত্রণ’ নামে নির্মলেন্দু গুণেরই একটি কবিতা, ‘কাব্যশক্তি মহাশক্তি, বিধাতার দান/ নরলোকে তিনি ধন্য যিনি তাহা পান।/ কাব্যরূপ কুঞ্জে বাস করে যেইজন/ প্রেমভাবে কাটে নিত্য তাহার জীবন।’

কবিকে জিজ্ঞেস করলাম, কবিতার সঙ্গে থাকার কারণেই কি আপনার জীবনে এত প্রেম, প্রেমভাব?’

উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসলেন।

কবিতাকুঞ্জে প্রবেশ করে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ! নানান দেশের বিচিত্র রকম কবিতার বইয়ের সমরোহ চারদিকে! কবিতাকুঞ্জের এখন প্রাথমিক পর্যায়—প্রতিষ্ঠানটি সবেমাত্র শুরু, তাই অনেক কিছুই ঠিকঠাক গড়ে ওঠেনি এখনো।

শহরের উপকণ্ঠে মালিনী নামের স্থানে ৮ শতাংশ খাসজমির ওপর গড়ে উঠেছে কবিতাকুঞ্জ। ২০১৬ সালে ১৬ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু হয় এ প্রতিষ্ঠানের। তবে বিভিন্ন কাব্যপ্রেমী মানুষের সহায়তায় প্রতিষ্ঠানটি নতুনভাবে উদ্যম পেতে শুরু করে গত বছরের মাঝামাঝি। ‘বিশ্ব সভ্যতার যে ইতিহাস, তা কবিতার মাধ্যমেই আমাদের কাছে এসেছে। আর বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বের কোনো দেশেই শুধু কবিতার ওপর কোনো প্রতিষ্ঠান আছে কি না তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। তাই আমি এটা করেছি।’

প্রশ্ন করতে পারি ভেবেই বোধ হয় কবিতাকুঞ্জ গড়ে তোলার কারণ ব্যখ্যা করলেন নির্মলেন্দু গুণ।

: কী কাজ হবে কবিতাকুঞ্জে?

: কবিতা নিয়ে গবেষণা হবে। সারা বিশ্বের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবিতা তো বটেই, একটা দেশ, একটা জাতি, এমনকি একটা ভাষাকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে—এমন বইও আমরা সংগ্রহ করছি এখানে। আবার অনেক ক্ষেত্রে কোনো কোনো কবিতার বইয়ে মূল ভাষার (যেমন ইতালীয়) কবিতার পাশাপাশি ওই ভাষার ইংরেজি এবং বাংলা অনুবাদও রাখা হচ্ছে এখানে। ফলে গবেষকেরা চাইলে মূল, ইংরেজি ও বাংলা—এই তিনটি ভাষাকে সামনে রেখে তাঁদের গবেষণা করতে পারবেন। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন ভাষার ১৬ শতাধিক কাব্যগ্রন্থ সংগ্রহ করা হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশসহ আরও ৮০টি দেশের কবিদের কবিতার বই রয়েছে।

: কীভাবে সংগ্রহ করেন বইগুলো?

প্রশ্ন করার আগেই উত্তর প্রস্তুত, ‘কবিতাকুঞ্জ মূলত চলছে বিভিন্নজনের সাহায্য-সহযোগিতায়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, কোরিয়া, নরওয়ে, সুইডেন, ফ্রান্স, ভারত প্রভৃতি দেশ থেকে কাব্যানুরাগী ও আমার সুহৃদেরা এখানে বই পাঠান। তাই সবাইকে নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে কবিতাকুঞ্জ।’

নির্মলেন্দু গুণের নেতৃত্বে ‘দশে মিলে করি কাজ’-এর এই যজ্ঞের উদ্দেশ্যটি যে বেশ মহৎ, তা স্পষ্টই বোঝা গেল। আমাদের কথার ফাঁকেই কবিকে ঘিরে ধরলেন শহরের মানুষজন। তিনি এসেছেন—খবরটি চাউর হয়ে গেছে এর মধ্যেই। সবাইকে নিয়ে তিনি চললেন কবিতাকুঞ্জের পাশের নদীর ঘাটে। ঘাটটি তৈরি করে এতে শান বাঁধিয়ে দিয়েছে নেত্রকোণা জেলা পরিষদ। আর এর বাহারি ‘কুঞ্জঘাট’ নামটি দিয়েছেন কবি স্বয়ং। কবিতাকুঞ্জে ‘মগরা’ ও ‘সোমেশ্বরী’—নেত্রকোণার দুই নদীর নামে দুটি অতিথিশালাও নির্মাণ করেছেন তিনি। গবেষকেরা গবেষণা করতে এলে এখানে থাকবেন, কবির ইচ্ছা এমনই।

তিনি বললেন, ‘কবিতাকুঞ্জে এখন একজন গ্রন্থাগারিক আছেন। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে কবিতাকুঞ্জ।’ এ পর্যন্ত বলে হঠাৎই একটু স্বাপ্নিক চোখে তাকালেন। বললেন, ‘আমি স্বপ্ন দেখি, কবিতাকুঞ্জের কুঞ্জঘাটে বসে মানুষ জোছনা দেখবে আর কবিতা পড়বে।’

আহা, এমন স্বপ্ন তো কবিরাই দেখবেন!

কবিতাকুঞ্জে এলে পেছনের কুঞ্জঘাটে এমনভাবে বসে থাকেন কবি। ছবি: খালেদ সরকার
কবিতাকুঞ্জে এলে পেছনের কুঞ্জঘাটে এমনভাবে বসে থাকেন কবি। ছবি: খালেদ সরকার

আমি তোমাদের লোক

নিজের শহর, নিজ জন্মমাটিতে নির্মলেন্দু গুণ অবশ্যই অন্য এক মানুষ! দেখা গেল, আমাদের নিয়ে এই তিনি দেবী নামে তাঁর এক নাতনির বিয়েতে যাচ্ছেন, তো ওই বারহাট্টায় নিজের পৈতৃকভিটা কাশবনে এসে খুঁজে বের করছেন শৈশবের বন্ধুবান্ধব। আবার কখনো নিজের হাতে গড়া স্কুলের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হাঁটছেন, কথা বলছেন—সব মিলিয়ে এই নির্মলেন্দু গুণ আমাদের কাছে কিছুটা অচেনা বৈকি। এর পেছনের কারণও তিনি জানালেন খোলামেলা ভাষায়, ‘নেত্রকোণায় ফেরা মানে মাটির কাছে ফেরা, জন্মের কাছে ফেরা, আমার মানুষের কাছে ফেরা। এখানে ফেরার পর আমি আদতেই আমার হয়ে যাই।’

কবিতাকুঞ্জ

মালিনী, নেত্রকোণা

প্রতিষ্ঠা: ২০১৬ সাল।

বইয়ের সংখ্যা: ১৬ শতাধিক; এ পর্যন্ত বাংলাদেশসহ মোট ৮০টি দেশের কাব্যগ্রন্থ সংগ্রহ করা হয়েছে।

খোলা থাকে: সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।

অতিথিশালা: ২টি।

ঘাটের নাম: কুঞ্জঘাট।