নৌকার ওই একাকী, বিষণ্ন, ক্লান্ত মাঝিকে আমি আকাশ দেখাতে চেয়েছিলাম, মা

সেলিনা হোসেন। ছবি: প্রথম আলো
সেলিনা হোসেন। ছবি: প্রথম আলো

সেলিনা হোসেন। কথাসাহিত্যিক। তিনি লিখেছেন তাঁর প্রিয় ৫ নিয়ে।

১. প্রিয় বই

কবি জেমস ম্যাথুজের ‘ক্রাই রেজ’

এই মুহূর্তে আমার প্রিয় পাঠ দক্ষিণ আফ্রিকার কবি জেমস ম্যাথুজের ক্রাই রেজ বইটি। এখানে কবি তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে যে অসাধারণ পঙ্‌ক্তিগুলো উচ্চারণ করেছেন, সেগুলো আমার খুবই প্রিয়। আমি মনে করি, চেতনাগত দিককে প্রসারিত করার এবং মানবাধিকার স্বীকার করে মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশের একটি বড় জায়গা তৈরি করে দেয় এই ক্রাই রেজ। ২০০৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার জুন ঝু শহরে একটি সাহিত্য সম্মেলনে এই কবির সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। তখন অটোগ্রাফসহ তিনি এ বইটি তুলে দিয়েছিলেন আমার হাতে।

২. প্রিয় চলচ্চিত্র

এখনো মনের মণিকোঠায় ‘টু উইমেন’

আমি যখন বাংলা একাডেমিতে চাকরি করতাম, সেই সময়ে বলাকা সিনেমা হলে একটি ছবি দেখেছিলাম—টু উইমেন। ইতালিয়ান চলচ্চিত্রনির্মাতা ভিত্তরিও ডি সিকার এই ছবিতে অভিনয় করেছেন সোফিয়া লরেন, জিন-পল-বেলমন্ডো, রাফ ভ্যালোনের মতো অভিনয়শিল্পী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই সিনেমা মূলত এক দরিদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মা ও তার মেয়ের গল্প। নিয়তির তাড়া খেয়ে জীবন যে কত দিকে বাঁক নেয় এবং মানুষের সৃষ্ট বিপর্যয়ের মধ্যেও ইচ্ছা অথবা অনিচ্ছায় যারা বেঁচে থাকে, তাদের কত বিচিত্র-নির্মম ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়—এই ছবির মাধ্যমে আমি মনে করি সেটি তুলে ধরা হয়েছে। সব মিলিয়ে টু উইমেন এখনো রয়েছে আমার মনের মণিকোঠায়।

টু উইমেন ছবির দৃশ্য
টু উইমেন ছবির দৃশ্য

৩. প্রিয় স্থান

বারবার ফিরে আসি লালদিয়ার চরে

জীবনে এত ভ্রমণ করেছি যে একটি স্থানকে ‘প্রিয়’ তকমা দেওয়া আমার জন্য একটু মুশকিলই। তার পরেও বলব লালদিয়ার চরের কথা। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণ উপকূল বরগুনার পাথরঘাটায় এটি অবস্থিত। ১৯৭৬ সালে প্রথমবার গিয়েছিলাম সেখানে। ভেবেছিলাম ওখানে গিয়ে একটি কাজ করব। কিন্তু গিয়ে যখন দেখলাম, জায়গাটি একটি জনবসতিহীন চর, তখন মনে হলো, আমরাই তো ঘুঁচিয়ে দিতে পারি এই শূন্যতা। বসতি স্থাপনের কাজ শুরু করলাম। সেই লালদিয়ার চরে বসতির সংখ্যা এখন অনেক। এই চরে বসে এখন নিত্যই শুঁটকি বানাচ্ছেন নারীরা, আর উত্তাল সমুদ্রের তলদেশ থেকে রূপার পাতের মতো ঝকঝকে মাছ ধরে আনেন জেলেরা—এগুলো যখন দেখি, মনে হয় বারবারই ফিরে আসি লালদিয়ার চরে।

৪. প্রিয় ব্যক্তিত্ব

কেউ যেন কখনো দেয়াল থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবিটি না নামান

আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কেবল একজন মানুষ হিসেবে নন, একজন ব্যক্তি হিসেবেও নন, আমাদের জাতির ‘আইকন’ হিসেবেই তিনি আমাদের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি। কারণ একজন বাঙালি হিসেবে, বাংলা ভাষার লেখক হিসেবে আমি যখন বিশ্বের দিকে তাকাই, দেখতে পাই তিনিই সেই মানুষ, যিনি মর্যাদার আসনে পৌঁছে দিয়েছেন আমাদের, একটি দেশের স্বাধীনতাকে বাস্তব রূপ দিয়েছেন। এখানে একটি কথা বলি, রাষ্ট্রক্ষমতায় যে কেউই আসতে পারেন। কিন্তু আমি চাই, কেউ যেন কখনো আমাদের ঘরবাড়ি, অফিস–আদালতের দেয়াল থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবিটি না নামান।

৫. প্রিয় স্মৃতি

বলতে চাই লারার কথা

প্রিয় স্মৃতির কথা বলতে হলে অবশ্যই আমি লারার কথা বলতে চাই। আমার অকালপ্রয়াত মেয়ে ফারিয়া লারা। দুই শ ঘণ্টা ফ্লাই করে ও যখন বৈমানিক হলো, একদিন আমাকে বলল, মা, তুমি কি যাবে আমার সঙ্গে? ছোট্ট একটা বিমান, একটাই মাত্র সিট আছে, একজনকে নিতে পারব আমি। লারা আমাকে শীতলক্ষ্যায় নিয়ে গিয়েছিল। নদীর ওপর দিয়ে বিমান চালাতে চালাতে আচমকা লারা বলল, মা, নদীর ওপরে ওই যে নৌকাটা দেখছ, ওই নৌকার ওপরে যে ছই, আমি সেখানে নামি? মেয়ের দুষ্টুমিতে সাই দিয়ে আমিও বললাম, নামো। আমার তো এখন নিজেকে পাখির মতো মনে হচ্ছে, ওখানে নামলে আমার ভালোই লাগবে। তারপর সে আরও কিছুক্ষণ বিমান চালিয়ে বলল, মা, আমরা কিন্তু ফিরে যাচ্ছি। তখন আমি মেয়েকে বললাম, তাহলে তুমি সে সময় ছইয়ের ওপরে নামতে চেয়েছিলে কেন? লারা বলল, নৌকার ওই একাকী বিষণ্ন, ক্লান্ত মাঝিকে আমি আকাশ দেখাতে চেয়েছিলাম, মা। আমি ছইয়ের ওপর নামতাম, বিমানের চাকা ধরে উঠে আসত মাঝি, আমি তাকে আকাশ দেখাতাম।—লারার এসব স্মৃতি আমার খুব প্রিয়। মাঝেমধ্যেই এগুলো আমার মাথার ভেতরে ভিড় করে।

ফারিয়া লারা
ফারিয়া লারা