এখনো মান্টো

এখনো সরব উপমহাদেশের নন্দিত লেখক সাদত হাসান মান্টো। তাঁর জীবন সম্প্রতি আবার আলোচনায় এসেছে নন্দিতা দাসের মান্টো সিনেমার মাধ্যমে। ভারত ভাগের নির্মম শিকার ক্ষণজন্মা এই কথাসাহিত্যিকের আজ জন্মদিন। তাঁকে নিয়ে আয়োজন।
সাদত হাসান মান্টো (১১ মে ১৯১২—১৮ জানুয়ারি ১৯৫৫)। অলংকরণ: প্র স্টুিডও
সাদত হাসান মান্টো (১১ মে ১৯১২—১৮ জানুয়ারি ১৯৫৫)। অলংকরণ: প্র স্টুিডও
সাদত হাসান মান্টোর জন্মদিনে আজ ছাপা হলো তাঁর একগুচ্ছ গল্প এবং তাঁকে নিয়ে একটি লেখা। রক্ত, দাঙ্গা আর অশ্রুর গাথা দিয়ে মোড়ানো এই গল্পগুলো প্রথমবারের মতো অনূদিত হয়েছে বাংলা ভাষায়। আসছে ফেব্রুয়ারির বইমেলায় জাভেদ হুসেনের অনুবাদে প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হচ্ছে মান্টোর গল্পের বই কালো সীমানা । ‘মোমবাতির অশ্রু’ গল্পটি ছাড়া এখানকার সব গল্পই ওই বইয়ের অন্তর্ভুক্ত। গল্পগুলোর অনুবাদসহ এই আয়োজনে মান্টোকে নিয়ে লিখেছেন জাভেদ হুসেন

এ আয়োজনটি অলংকরণ করেছেন সব্যসাচী মিস্ত্রী
এ আয়োজনটি অলংকরণ করেছেন সব্যসাচী মিস্ত্রী

মান্টোর বিভীষিকার নন্দনতত্ত্ব

রাষ্ট্র, ধর্মবাদী থেকে প্রগতিশীল—সবাই একযোগে সাদত হাসান মান্টোকে খারিজ করে দিলেও তিনি গল্পকার হিসেবে নিজের অবস্থান জানতেন। মৃত্যুর এক বছর আগে লেখা নিজের এপিটাফে তিনি বলে গেছেন, ‘এখানে সমাধিতলে শুয়ে আছে মান্টো এবং তাঁর বুকে সমাহিত হয়ে আছে গল্প বলার সব কৌশল আর রহস্য।’ কখনো ফতোয়া এসেছে, অশ্লীলতার জন্য মামলা হয়েছে ছয়বার, বন্ধুরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, কিন্তু মান্টোর চারপাশে বয়ে চলা জীবনের প্রতি আকর্ষণ আর তাঁর কলম কেউ থামাতে পারেনি।

বেঁচেছেন মাত্র ৪৩ বছর। কিন্তু লিখে গেছেন কী প্রবল উদ্যমে! ২২টি ছোটগল্পের সংকলন, ১টা উপন্যাস, রেডিও নাটকের ৭টা সংগ্রহ, ৩টা প্রবন্ধ সংকলন আর ২টা চেনা মানুষদের স্মৃতিকথা! তাঁর লেখা সিনেমার চিত্রনাট্যগুলো এক করে ছাপানো হয়েছে বলে জানা যায় না। এগুলোর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ লিখেছেন দুই দানবের জন্য—মদ আর সংসার।

তবে এসবের মধ্যে তিনি ভারত ভাগের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও শুনিয়ে যাচ্ছেন রক্ত হিম করা গল্প। গল্পগুলো শোনাচ্ছেন সেই দেশগুলোতে, যেখানে ইতিহাস হিসাব করে অবহেলা করা হয়, যে দেশগুলোতে বর্তমানের শাসন অনুযায়ী অতীতও পাল্টে যায়। এই ইতিহাস প্রকল্পের সামনে মান্টো একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। বেঁচে থাকতে তিনি যেমন অনেকের কাছে অস্বস্তিকর ছিলেন, মরে গিয়ে ঝাঁজ আরও বেড়েছে। সাময়িক কর্তার খায়েশ অনুযায়ী বদলে যাওয়া ইতিহাসের আসল পাঠ নিতে গেলে মান্টোর তুলনা নেই; বিশেষ করে, যে ইতিহাস এমন অস্বস্তিকর, অনিশ্চিত আর বিপজ্জনক বর্তমান তৈরি করেছে। মান্টো নিজে সে কথা জানতেন।

সে জন্য তখন যা ঘটেছে, মান্টো তাতে কোনো পক্ষাবলম্বন না করে কেবল লিখে রেখে গেছেন। তাতে কোনো তত্ত্ব বিশ্লেষণ নেই, কোনো বেদনাবোধও নেই যেন। মান্টো যেন ১৯৪৭ সালের দাঙ্গার চলমান ছবি তুলে রাখছেন কাগজে আর কলমে! এমন নিস্পৃহ কিন্তু নির্মম কাজ কেন করলেন মান্টো? মানুষের মন আর কদর্যতার বহু মাত্রা তুলে আনতে মান্টোর কোনো জুড়ি নেই। তিনি দেখেছেন যে বর্তমান যখন অতীত হয়, তখন সবকিছু কেমন প্রয়োজনমতো বদলে দেওয়া হয়। তাই কি তিনি কেবল যা ঘটেছে, তার অবিকল ফটোগ্রাফমাত্র রেখে গেছেন, তাতে কোনো পক্ষের, ঘৃণার বা সহমর্মিতার কোনো রং না লাগিয়ে? অতীত যখন পাল্টে যাওয়ার নিরন্তর হুমকির মুখে থাকে, তখন মান্টোর এই ছবি মারাত্মক হয়ে হাজির হতে পারে কারও কারও জন্য।

তিন মেয়ের সঙ্গে সাদত হাসান মান্টো। ছবি: সংগৃহীত
তিন মেয়ের সঙ্গে সাদত হাসান মান্টো। ছবি: সংগৃহীত

এমন এক মানবিক বিপর্যয়ের পর সিয়াহ হাশিয়ে লেখার সময় মান্টো নিজেই-বা কোথায়, কেমন আছেন? তিনি তখন বোম্বে (মুম্বাই) ছেড়ে লাহোর পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর ভালোবাসার বোম্বের সিনেমাজগৎ, তাঁর বন্ধু আর চেনা মুখগুলো সহসা অচেনা হয়ে যাওয়ার শহর ছেড়ে তিনি যেন নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছেন। লাহোরের সিনেমাজগৎ তখন সবে বুঝতে শুরু করেছে যে তার সামনে বিশাল সম্ভাবনা। কিন্তু তা বাস্তব হয়ে উঠতে অনেক দেরি। মান্টো তত দিনে প্রগতিশীল ঘরানা থেকে ধর্মবাদী আর রাষ্ট্র—সবার সমান চক্ষুশূল। সংসার চালানোর টাকা জোগাড় করা কঠিন হচ্ছে দিন দিন। প্রিয় বন্ধু ইসমত চুগতাইয়ের কাছে তিনটি চিঠিতে মান্টো বলছেন—কোনোভাবে আমাকে ফেরত নিয়ে যাও, এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।

মদের প্রতি আকর্ষণ ছিল আগেও। এই পরবাসে এসে বন্ধু আর সহায়হীন হয়ে তা হয়ে গেল নেশা। বুদ্ধিমান লেখকেরা তখন সরকারের কাছ থেকে বাড়ি, ব্যবসা ইত্যাদি বরাদ্দ নিয়ে নিচ্ছেন। এতটা বাস্তববুদ্ধি মান্টোর কোনোকালেই ছিল না। একমাত্র অবলম্বন পত্রিকায় লিখে রোজগার। তা-ও কি সহজ? কোনো কিছুই তখনো বোঝা যাচ্ছে না। ইংরেজ সরকারের আমলের অশ্লীলতার অভিযোগে করা মামলা নতুন দেশের সরকার উঠিয়ে নেয়নি। আমৃত্যু সেই বোঝা তাঁকে বইতে হয়েছে। তাঁর লেখা ছাপতে পত্রিকার সম্পাদক ভয় পান, কখন পত্রিকা বন্ধের খাঁড়া নেমে আসে, কে জানে!

বিকেল হলেই বেরিয়ে পড়েন মান্টো। পত্রিকা অফিসে গিয়ে নাছোড়বান্দার মতো টাকা চান, পরে লিখে শোধ করে দেবেন। এমন হিসাবে তো পত্রিকা চলে না। সম্পাদক কাগজ-কলম এগিয়ে দিয়ে বলেন—মান্টো সাহেব, কিছু একটা লিখে দিন। মদ আর বাজার খরচের টাকার জন্য দুশ্চিন্তিত লেখক সদ্য দেখা দাঙ্গার গল্প লিখে দেন কাঁপা কাঁপা হাতে। সেই গল্প কখনো কেবল এক লাইন, বেশি হলে পৃষ্ঠা দেড়েক। এভাবে লেখা ৩২টা গল্প নিয়ে ১৯৪৮ সালে বের হয় সিয়াহ হাশিয়ে, মানে কালো সীমানা। এই নাম দ্ব্যর্থবোধক। এক অর্থে কালো সীমান্ত, নতুন দেশের বর্ডার, মান্টো যাকে কালোই বলতেন; আরেক অর্থ হলো, পত্রিকায় কোনো শোকসংবাদ বা দুঃখের সংবাদ যে কালো বর্ডারে ছাপা হয়, সেই কালো সীমানা।

এই বই মান্টো আর প্রগতিশীল লেখক সংঘের মধ্যে বিচ্ছেদেরও কারণ হলো। মান্টো এই বইয়ের ভূমিকা লিখতে দিলেন হাসান আসকারিকে। আসকারি নতুন পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে দায়িত্ব পেয়েছিলেন নতুন রাষ্ট্রের পরিচয় কী হবে, সে ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়ার। তিনি ছিলেন লেখক সংঘের সাহিত্য দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী। লেখক সংঘের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সরদার জাফরি, আহমদ নাদিম কাসমি মান্টোকে অনুরোধ করলেন আসকারিকে দিয়ে ভূমিকা না লেখাতে। মান্টো চুপ রইলেন। আসকারির ভূমিকাসহই বই বের হলো। প্রগতিশীল লেখক সংঘের সঙ্গে মান্টোর বিচ্ছেদ চূড়ান্ত হয়ে গেল। মান্টো বন্ধুহীন হয়ে পড়লেন। বন্ধু বলতে রইল তারা, যারা তাঁকে সস্তা মদ জোগাড় করে দেয়, যারা তাঁর মৃত্যু এগিয়ে নিয়ে এসেছিল।

দেশভাগের প্রতিদিনের বাস্তবতা, তার আতঙ্ক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে ছাপিয়ে আমাদের আজকের চেতনা আর অবচেতনায় সমানভাবে হানা দেয়। সমকালে রামুতে পোড়া মন্দিরের ছাইয়ের মধ্যে স্মিত হাসির বুদ্ধ, গুজরাটের দাঙ্গা, পাকিস্তানের শিয়া মহল্লায় নির্বিচার আগুন বা খ্রিষ্টানদের প্রার্থনার সময় নির্বিচার গুলিবর্ষণ মান্টোকে বারবার ফিরিয়ে আনে। কিন্তু তিনি আজ সহজে কোনো শরীর খুঁজে পান না, যে শরীর মাত্র ৪৩ বছর বয়সে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার সাহস রাখবে।

প্রথমা প্রকািশতব্য বইয়ের প্রচ্ছদ
প্রথমা প্রকািশতব্য বইয়ের প্রচ্ছদ

মান্টোর একগুচ্ছ গল্প

জবাই আর কোপ

‘আমি লোকটার গলায় ছুরি ধরলাম, ধীরে ধীরে পোচ দিয়ে জবাই করলাম।’

‘এ তুই কী করলি!’

‘কেন?’

‘জবাই করলি কেন?’

‘এভাবেই তো মজা!’

‘মজার বাচ্চা, তুই কোপ দিয়ে মারলি না কেন? এইভাবে...’

আর জবাই করনেওয়ালার গলা এক কোপে আলাদা হয়ে গেল।

জেলি

ভোর ছয়টার সময় পেট্রলপাম্পের কাছে ঠেলাগাড়িতে বরফ ফেরিওয়ালার পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। সাতটা পর্যন্ত লাশ পড়ে রইল রাস্তায়। ঠেলা থেকে বরফ গলে গলে পানি হয়ে পড়তে থাকল।

সোয়া সাতটা বাজলে পর পুলিশ লাশ উঠিয়ে নিয়ে গেল। বরফ আর রক্ত সেই রাস্তায়ই পড়ে থাকল।

পাশ দিয়ে একটা টাঙ্গা চলে গেল। তাতে বসা ছোট একটা বাচ্চা রাস্তায় জমে থাকা উজ্জ্বল থকথকে রক্তের দিকে তাকাল। ওর জিভে জল এসে পড়ল। সে তার মায়ের হাত টেনে আঙুল দিয়ে সে দিকে দেখিয়ে বলল, ‘দেখ মা, জেলি!’

যথাযথ পদক্ষেপ

যখন মহল্লায় হামলা হলো, কিছু কম বুদ্ধির লোক মারা পড়ল। যারা বাকি ছিল, তারা প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে বাঁচল। একজন লোক আর তার বউ নিজের ঘরের তলকুঠুরিতে গিয়ে লুকিয়ে রইল।

খুনিরা কখন আসে—দুই দিন দুই রাত মিয়া-বিবি এই ভয়ে দমবন্ধ করে কাটিয়ে দিল। কিন্তু কেউ এল না।

কেটে গেল আরও দুই দিন। কমতে লাগল মৃত্যুর ভয়। খিদে আর পিপাসার কষ্ট তার চেয়েও বেশি হতে লাগল।

আরও চার দিন কেটে গেল। জীবন-মৃত্যু নিয়ে আর কোনো আগ্রহ রইল না মিয়া-বিবির। তাদের আশ্রয় ছেড়ে বের হয়ে এল দুজন।

মিয়া খুব দুর্বল কণ্ঠে বাইরে থাকা লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘আমরা নিজেই ধরা দিচ্ছি ...আমাদের মেরে ফেলো।’

যার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলো, সেই লোক চিন্তায় পড়ে গেল, ‘আমাদের ধর্মে তো জীবহত্যা পাপ।’

এরা সবাই ছিল জৈন। তাই তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে যথাযথ পদক্ষেপের জন্য মিয়া-বিবিকে পাশের মহল্লার লোকদের হাতে তুলে দিল।

মোমবাতির অশ্রু

ভাঙা দেয়ালের ওপর বানানো নোংরা তাকের ওপর মোমবাতি সারা রাত কেঁদে কাটায়।

মোম গলে কামরার ভেজা মেঝেতে ঠান্ডায় কুঁকড়ে যাওয়া আবছা বিন্দুর মতো ছড়িয়ে পড়ে। ছোট্ট লাজো মুক্তার মালার জন্য জেদ ধরে কাঁদা শুরু করল। ওর মা মোমবাতির জমে যাওয়া অশ্রুগুলো একটা সুতোয় গেঁথে মালা বানিয়ে দিল। ছোট্ট লাজো সেই মালা পরেই খুশি। হাততালি দিয়ে সে নাচতে নাচতে বাইরে চলে গেল।

রাত এল...নতুন মোমবাতি জ্বলল ধুলোভরা তাকের ওপর। কামরার অন্ধকার দেখে অবাক হয়ে চমকে উঠল একচক্ষু মোমবাতি। তবে সে সামলে নিল একটু পরেই। তারপর ঘরের নীরবতার সঙ্গে এক হয়ে দেখা শুরু করল নিজের চারপাশ।

ছোট্ট লাজো ঘুমাচ্ছিল একটা ছোট চৌকির ওপরে। স্বপ্নে সে বান্ধবী বিন্দুর সঙ্গে ঝগড়া করছিল। বিন্দুর পুতুলের সঙ্গে তার মেয়েকে কোনোভাবেই বিয়ে দেবে না সে। কারণ পুতুলটি দেখতে বিশ্রী।

লাজোর মা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে নিস্তব্ধ আধো অন্ধকার রাস্তায় ফেলে রাখা আবর্জনার দিকে কী আশায় যেন তাকিয়ে ছিল। সামনে বন্ধ শুড়িখানার বাইরে একটা চুলা থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ছিল জেদি শিশুর মতো কয়লার স্ফুলিঙ্গ।

ঢং ঢং করে বারোটা বাজল ঘণ্টাঘরে। বারোটা বাজার শেষ ঘণ্টার আর্তনাদ ডিসেম্বরের ঠান্ডা রাতে কিছুক্ষণ কেঁপে আবার নৈঃশব্দ্যের কাঁথা গায়ে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। তার আগে সে লাজোর মায়ের কানেও গুনগুন করে শুনিয়ে গেল ঘুমের সুন্দর বার্তা। কিন্তু সেই গুনগুনের অন্তরা তার মনে অন্য কোনো কথা শুনিয়ে দিয়েছিল।

হঠাৎ করে শীতল হাওয়ার ঝাপটায় নূপুরের মৃদু ঝনঝন শব্দ ওর কানে এল। সে কান পাতল সেই আওয়াজ ভালো করে শোনার জন্য।

রাতের নীরবতায় নূপুরের শব্দ বাজছিল যেন কোনো মূমূর্ষু মানুষের গলায় আটকে যাওয়া শেষনিশ্বাস। শান্ত হয়ে বসে পড়ল লাজোর মা । বাইরে রাস্তায় ক্লান্ত ঘোড়ার শ্বাস রাতের নীরবতায় কেমন শিহরণ জাগিয়ে তুলছিল। একটা টাঙ্গা এসে দাঁড়াল গ্যাসবাতির খাম্বার কাছে। টাঙ্গাওয়ালা নিচে নামল। ঘোড়ার পিঠে একটা থাপ্পড় দিয়ে সে জানালার দিকে তাকাল। জানালার পর্দা ছিল ওঠানো। একটা আবছা ছায়াও লটকে ছিল দেয়ালের গায়ে।

নিজের মোটা কর্কশ কম্বল ভালো করে গায়ে জড়িয়ে টাঙ্গাওয়ালা নিজের পকেটে হাত ঢোকাল। সাড়ে তিন টাকা ভাড়া পেয়েছে। এর থেকে এক টাকা চার আনা সে নিজের কাছে রাখল। বাকি টাকা রেখে দিল টাঙ্গার গদির নিচে। এবার সে এগোল সিঁড়ির দিকে।

লাজোর মা চান্দো দরজা খুলে দিল।

মাধব টাঙ্গাওয়ালা ভেতরে ঢুকে দরজার শিকল টেনে দিয়ে চান্দোকে জড়িয়ে ধরল। ‘ভগবান জানে, আমি তোকে কত ভালোবাসি...যৌবনকালে তোর দেখা পেলে এই টাঙ্গা ঘোড়া সব বেচতে হতো!’ এই বলে সে চান্দোর হাতে এক টাকা গুঁজে দিল।

চান্দো জিজ্ঞেস করল, ‘বাস, এই?’

‘এই ধর, আরও দিলাম’, মাধব এবার রূপোর চার আনা ওর দ্বিতীয় হাতে রাখল। ‘কসম, এই ছিল আমার কাছে।’

রাতের ঠান্ডায় বাজারে দাঁড়িয়ে ঘোড়া কাঁপছিল। আগের মতোই ঝিমাচ্ছিল গ্যাসবাতির খাম্বা।

মাধব বেহুঁশ পড়ে ছিল সামনে ভাঙা চৌকিতে। তার পাশেই চান্দো চোখ খুলে শুয়ে। দেখছিল মোম গলে গলে ভেজা মেঝেতে পড়ে ছোট ছোট মুক্তোর বিন্দুর মতো জমছে। হঠাৎ করে সে পাগলের মতো উঠে বসে পড়ল লাজোর চৌকির কাছে গিয়ে। ঘুমন্ত লাজোর গলায় মোমের বিন্দু নিশ্বাসের সঙ্গে দুলছিল। চান্দোর ঝাপসা চোখে মনে হলো যেন মোমবাতির এই জমে যাওয়া বিন্দুগুলোতে তার লাজোর অনাগত যৌবনের অশ্রু লুকিয়ে বাসা বেঁধেছে। তার কাঁপা কাঁপা হাত এগিয়ে লাজোর গলার মালা ছিঁড়ে ফেলল।

গলে শেষ হওয়া মোমবাতি থেকে জ্বলন্ত সুতো পিছলে নিচে পড়ে মেঝেকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘরে নিস্তব্ধতার সঙ্গে নেমে এল অন্ধকারও।

খবরদার

দাঙ্গাকারীরা বড় কষ্টে বাড়ির মালিককে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে এল। কাপড় থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে সে উঠে দাঁড়াল। তারপর দাঙ্গাবাজদের সাবধান করে দিয়ে বলল, ‘চাইলে আমাকে মেরে ফেলো, কিন্তু খবরদার আমার টাকাপয়সায় হাত দেবে না!’

একেবারে ছুটি

 ‘ধর...ধর...পালাতে না পারে!’

একটু ছোটাছুটির পর শিকার ধরা পড়ল। বর্শা দিয়ে তাকে এ ফোঁড়-ও ফোঁড় করতে একজন এগিয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় ধরা পড়া মানুষটা মিনতি করে বলল, ‘আমাকে মেরো না, আমাকে মেরো না...আমি ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছি।’

চ্যালেঞ্জ

আগুন লাগল যখন, সারা মহল্লা জ্বলে ছাই হলো...কেবল একটা দোকান বেঁচে গেল, সেই দোকানের ওপরে সাইনবোর্ডে এই তখনো পড়া যাচ্ছিল...‘এখানে বাড়ি বানানোর মাল-সামান পাওয়া যায়।’

জুতো

জটলা দিক বদলে স্যার গঙ্গারামের মূর্তির দিকে রওনা হলো। মূর্তির ওপর লাঠির বাড়ি পড়ল, ইট ছোড়া হলো। একজন গিয়ে মূর্তির মুখে আলকাতরা মেখে দিল। আরেকজন অনেকগুলো পুরোনো ছেঁড়া জুতো জমা করে মালা বানিয়ে মূর্তির গলায় পরানোর জন্য সামনে এগোল। কিন্তু এর মধ্যে এসে পড়ল পুলিশ। গুলি চালানো শুরু হলো।

জুতোর মালা বানানেওয়ালা জখম হলো। চিকিৎসার জন্য তাকে ‘স্যার গঙ্গারাম হাসপাতালে’ পাঠানো হলো।

গল্পের সূত্র: ‘মোমবাতির অশ্রু’ গল্পটি ১৯৪১ সালে লাহোরের প্রকাশনা সংস্থা ‘মাকতবায়ে উর্দু’ প্রকাশিত মান্টো কে আফসানে বা মান্টোর গল্প থেকে অনূদিত। আর ‘জেলি’, ‘জবাই আর কোপ’, ‘চ্যালেঞ্জ’, ‘যথাযথ পদক্ষেপ’, ‘একেবারে ছুটি’, ‘খবরদার’ ও ‘জুতো’—এই সাতটি গল্প অনুবাদ করা হয়েছে সিয়াহ হাশিয়ে বা কালো সীমানা থেকে। এ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫২ সালে, লাহোরেরর ‘মাকতাবায়ে জাদিদ’ থেকে।