ঘুড্ডি এবং সৈকতের সেই সুবর্ণা

কক্সবাজারে ঘুড্ডি ছবির শুটিং মুহূর্তে সুবর্ণা মুস্তাফা। ছবি: সংগৃহীত
কক্সবাজারে ঘুড্ডি ছবির শুটিং মুহূর্তে সুবর্ণা মুস্তাফা। ছবি: সংগৃহীত

আজ কেবল মনে পড়ছে ঘুড্ডির কথা। ঘুড্ডি! আহা, সেই যে একদা পরিচালনা করেছিলাম ছবিটি, সেই ঘুড্ডি ছবির মধ্যে কত স্মৃতিসুধা, কত কিছু যে লুকিয়ে আছে! ঘুড্ডির স্ক্রিপ্ট চুরি হয়ে গেল। অফিসের তালা ভেঙে শুধু স্ক্রিপ্ট নিয়ে গেছে, সেই সঙ্গে শিশু একাডেমীর একটা নির্মাণাধীন ছবির কন্টিনিউয়িটি ড্রেস। উদ্দেশ্যমূলক সন্দেহ নেই! নাট্যজন সেলিম আল দীন তাঁর পথনাটক চরকাঁকড়ার ডকুমেন্টারির চিত্রনাট্য করে দিয়েছিলেন সংলাপসহ! শুটিংয়ের কল দেওয়া হয়ে গেছে সামনের শুক্রবার। সবাই প্রস্তুত—সুবর্ণা মুস্তাফা, রাইসুল ইসলাম আসাদ, ফরিদ আলী, তারিক আনাম, লাকী আখান্দ্​, হ্যাপী আখান্দ্, নাসির উদ্দীন ইউসুফ; ক্যামেরার শফিকুল হক স্বপন, সম্পাদক সাইদুল আনাম টুটুল, সহকারী বিকাশ দত্ত আরও অনেকে। এককথায় ঢাকা থিয়েটারের সবাই! তখন প্রবল উত্তেজনা আমাদের মধ্যে পথনাটক চরকাঁকড়া এবার পর্দায়, যে নাটকের জন্য আমরা এক রাত হাজতবাস করেছি! সেলিম হতাশ হাওয়ার পাত্র নয়। ‘ভাববেন না, এক মাসের মধ্যে আবার লিখে দেব।’ আমার জেদ চেপে গেল। বেশ, লিখতে থাক, কিন্তু আমি শুক্রবার থেকেই শুরু করব! কল ঠিক থাকবে। কে যেন জিজ্ঞেস করল, গল্প, স্ক্রিপ্ট? হয়ে যাবে, দেখা যাক।

তিনটি গাড়ি—একটা চালাচ্ছে স্বপন, ওরই গাড়ি। পাশে আমি। পেছনে সুবর্ণা, আসাদ। আরেকটি চালাচ্ছে ফরিদ আলী, আমার অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু। ওর গাড়ি আমাকে দিয়েছিল শুটিংয়ের জন্য। ক্যামেরা আর লটবহর আছে শেষ গাড়িতে! গাড়িতে উঠে চোখ বুজে বললাম, চল নারায়ণগঞ্জ! স্টিমারঘাটে। কেন বলেছিলাম, জানি না আজও!

ঘাটে পৌঁছে শীতলক্ষ্যা পার হলাম, সোনাকান্দা দুর্গ, পরিত্যক্ত! পৌঁছে গেলাম! পথে সুবর্ণা ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল, চরিত্রটা কী, বললেন না তো? কী জবাব দেব? আমি নিজেই তো জানি না! হুট করে বললাম, এই ধর তুই আর্কিটেকচার ফ্যাকাল্টির ছাত্রী, কেমন? সুবর্ণার প্রতিক্রিয়া দেখতে পাইনি পেছনে তাকিয়ে। এবার আসাদের পালা, আমি জানি। ভরাট গলায় তার প্রশ্ন, আর আমি? জবাব না ভেবেই দিলাম, তুই? তুই আসাদ, আসাদই! যুদ্ধ শেষে অস্ত্র জমা দিয়ে হাতটা খালি, শহর চাষ করে বেড়াস। ও কী বুঝল, জানি না! ছোট্ট করে প্রতিক্রিয়া দিল, হু। দুর্গে পৌঁছে ক্যামেরা বসিয়ে সুবর্ণাকে বললাম, তুই ক্যামেরার ডান দিক দিয়ে ইন করে ওই সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাবি, আর আসাদ বাঁ দিক দিয়ে, দুজনই ব্যাক টু ক্যামেরা, কেমন? ওদের জীবনের প্রথম শট, ব্যাক টু ক্যামেরা। অবশ্য ওদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি, অভিনয়জগতের সিঁড়ি দিয়ে ধ্রুবতারার জগতে। সুবর্ণা ওই দিন থেকে চলনে-বলনে পাক্কা আর্কিটেকচার ফ্যাকাল্টির ছাত্রী বনে গেল।

তবে আমার আজকের গল্প ওই দিন নিয়ে নয়, বরং আরেক দিনের। ছবির শেষ সময়ে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে এক বিকেলের কথা। আউটডোর, স্বল্প বাজেট, অল্প ম্যাটেরিয়াল নিয়ে গিয়েছি কক্সবাজারে! শেষ দিন, শেষ বেলা। আর থাকার পয়সা নেই আমাদের। কিন্তু মাথায় রয়েছে লম্বা একটি সিকোয়েন্স। এক টেকে ওকে করতে হবে, ‘এনজি’ হলে উপায় নেই। কারণ, আর ম্যাটেরিয়াল নেই।

এর পরের সিকোয়েন্সে হলো লাকী আখান্দের সুরে হ্যাপী আখান্দের গাওয়া কালজয়ী গান ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’। সেই অজানায় হারিয়ে যাওয়ার গান, হারিয়ে যাওয়ার আর্তি গানের কথায়, সুরে। গান শুট করা আগেই হয়েছে। চলচ্চিত্রে এটি প্রায়ই হয়ে থাকে, আগেরটা পরে, পরেরটা আগে। পরিচালক গাইড করবে ঠিকই, কিন্তু মুড কন্টিনিউয়িটির মূল দায়িত্ব শিল্পীর। আর আসাদ, আফজাল, ফরীদি, সুবর্ণার মতো শিল্পীদের জন্য এটি কোনো সমস্যা নয়। ওরা মুড তৈরি করতে জানে!

স্বপনের হ্যান্ড-হেল্ড ক্যামেরায় ধারণ করা হবে এই সিকোয়েন্স। সবাই দুপুরের খাবার খাচ্ছে। শুধু সুবর্ণা, আসাদ, স্বপন—ওরা আমার ‘মুখপানে চেয়ে’ প্রতীক্ষায়। আর আমি সংলাপ লিখছি, দীর্ঘ কবিতা কিংবা স্বগতোক্তির মতো। ঘুড্ডি ছবিটির কোনো ফরমাল স্ক্রিপ্ট ছিল না, আগেই বলেছি। টুকরো কাগজে লিখে লিখে সুবর্ণাকে দিচ্ছি—কখনো ওর মুখের দিকে তাকিয়ে, কখনো সমুদ্রগর্জনে কান পেতে। গভীর ধ্যানমগ্ন হয়ে ও পাঠ করছে! তারপর একসময় চোখ তুলে বলল, চলো, আমি রেডি।

তারপর ছোট্ট ইউনিট নিয়ে জিপে একটানে হিমছড়ি। সুবর্ণা প্রম্পট করতে মানা করল। ওর মুখাবয়বে কোনো টেনশন নেই, মুখটি আশ্চর্যজনকভাবে নিরুদ্বিগ্ন! এদিকে আমরা আছি ভীষণ দুশ্চিন্তায়। যদি ফিল্ম রানআউট হয় বা সুবর্ণা ভুল করে বসে, এনজি হয়, তবে আর উপায় নেই, মাঠে মারা যাবে সবকিছু। বিদায় সমুদ্রস্বপ্ন! সবাই চুপ! শুধু দু-একটি গাঙচিল আকাশে যেন উন্মুখ উড়ছে সুবর্ণার সংলাপ শোনার জন্য। ওরাই তো পৌঁছে দেবে সুবর্ণার বার্তা দূর সমুদ্রের বুকে ভাসমান নাবিকের কাছে। দীর্ঘ সংলাপে তা-ই লেখা আছে।

অতঃপর বললাম, অ্যাকশন। শট শুরু হলো। আমার কান সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে শুনতে চাইছে ওর কণ্ঠ—সংলাপ। সুবর্ণা আনমনা এগিয়ে আসছে, পেছনে উদ্বিগ্ন আসাদ, ও বলতে চাইছিল কিছু একটা, কিন্তু সুবর্ণা তখন ভিন্ন মাত্রায়, ভিন্ন জগতে, গাঙচিলের ডানায় অজানার সন্ধানে।

৩৫ মিলিমিটারের ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে ব্যাক স্টেপ দিচ্ছে স্বপন। সন্দেহ নেই কাজটি কঠিন। একটু ঝাঁকি খেলে বা সুবর্ণা ভুল করলে অথবা শেষ মুহূর্তে এসে ফিল্ম রানআউট হলে তীরে এসে তরি ডুববে। রি-টেকের আর অবকাশ নেই।

শেষ দিকে কিছুই শুনতে পারছিলাম না কানে, এমনকি সমুদ্রের কণ্ঠও, সব ব্ল্যাঙ্ক, চারপাশে যেন ভয়াবহ শূন্যতা। স্বপন দাঁড়িয়ে গেছে, ওরাও। স্বপনের দিকে তাকিয়ে আমি সুবর্ণাকে বললাম, একটা কিছু বল...। আমার দিকে তাকাল স্বপন। তবে ওর মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। তবে কি শট সম্পূর্ণ হয়নি? এনজি? হায় সমুদ্র! তুই কী নিষ্ঠুর! আচমকা স্বপন একটু হেসে বলল, ওকে, বস। ব্যস! আমি প্রায় হুংকার দিয়ে ঘোষণা দিলাম, ওকে ওকে ওকে। সুবর্ণা তখনো নিশ্চুপ-নিশ্চল দাঁড়িয়ে অভিব্যক্তি ধরে রেখেছে, যেন সে কিছু শুনতেই পায়নি। শুনবে কেমন করে, ও তো সে সময় কথা বলছিল গাঙচিলের সঙ্গে। বার্তা পাঠাতে চাচ্ছিল দূর সমুদ্রের বুকে সেই নাবিকের কাছে, যার বুকে তার চুলের গন্ধ।