গানটা শুনলে মনে হয় আলস্য ঝেড়ে উঠতে হবে, শেষ পর্যন্ত পরেরবার শোনার জন্য ওই ইচ্ছাটি মুলতবি রেখে দিই

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ছবি: প্রথম আলো
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ছবি: প্রথম আলো
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। লেখক ও শিক্ষক। তিনি লিখেছেন তাঁর প্রিয় ৫ বিষয় নিয়ে।

১. প্রিয় বই

একটিকে বেছে নিতে বললে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছিন্নপত্র’

আমার বেড়ে ওঠা বইপ্রধান, বইবান্ধব সময়ে। উৎসাহী পাঠক হিসেবে, সাহিত্যের ছাত্র হওয়ার কারণে এমন অনেক বই পড়া হয়েছে, যেগুলোর সঙ্গে ‘প্রিয়’ বিশেষণটি দীর্ঘস্থায়ী হয়ে গেছে। তারপরও, সেসব বইয়ের সারি থেকে একটিকে বেছে নিতে বললে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিন্নপত্রকেই তুলে নেব। ছিন্নপত্র মানে রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকে লেখা অসাধারণ কিছু চিঠির একটি সংকলন। একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় ঐতিহ্যে গৃহীর সঙ্গে সন্ন্যাসীর বিবাদের উল্লেখ করেছিলেন, শিলাইদহ-শাহজাদপুর-পতিসরে জমিদারি দেখাশোনা করতে এসে, ‘পদ্মা’ নামের নাওয়ে পদ্মা-যমুনায় ভেসে বেড়াতে বেড়াতে, গৃহী রবীন্দ্রনাথ অন্তত তাঁর চিন্তায় ও অনুভবে এক সন্ন্যাসীকে পেয়েছিলেন, যাঁর প্রসন্ন দৃষ্টি, প্রকৃতি, মানুষ ও জীবন নিয়ে যাঁর মগ্নদর্শন আর সময় আর পরিসর নিয়ে যাঁর অনাবিল চিন্তা তিনি অনেক চিঠিতে সাজিয়েছেন। এখানে আবার গৃহী মানুষটিও আছেন, যিনি নির্মোহ চোখে জগৎকে দেখেন, উপনিবেশিতাকে প্রশ্ন করেন, এক ইংরেজ অথবা নিজেকে নিয়েও কৌতুক করেন। বাংলাদেশের হৃদয় থেকে উৎসারিত দৃশ্যকল্পে, ভাষার অসাধারণত্বে বিশিষ্ট ছিন্নপত্র সময় পেলেই পড়ার মতো এক অমর সৃষ্টি।

২. প্রিয় চলচ্চিত্র

‘বিন্দু থেকে বৃত্ত’ই চোখে লেগে আছে

সিনেমা খুব কমই দেখি, ফলে প্রিয় চলচ্চিত্র নিয়ে বলাটা সহজ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বলাকা সিনেমা হলে দেখেছিলাম বিন্দু থেকে বৃত্ত, রেবেকার পরিচালনায়। একটা চরিত্রে তিনি অভিনয়ও করেছিলেন। শহরের ইট-কাঠের অরণ্যে, রেলস্টেশনের ইস্পাত বাস্তবতায় স্থাপিত নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প। আতিয়া ছিলেন নায়িকা, মফিদুল ইসলাম নায়ক। তবে অপ্রচলিত, ব্যতিক্রমী ভাবনার নায়ক–নায়িকা তাঁরা। অসাধারণ দৃশ্য আর সংলাপ নির্মাণ। মেদহীন একটি সাহসী চলচ্চিত্র। এখনো চোখে লেগে আছে।

৩. প্রিয় গান

সময় গেলে সাধন হবে না

লালন সাঁইয়ের ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ তবে ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে। তাঁর মায়াবিস্তারি পরিবেশনায় গানটির মর্মার্থ বাঙ্​ময় হয়, লালনসংগীতে তিনি অসাধারণ। বাউল চিন্তার একটা সারাৎসার গানটিতে আছে। গানটি ভালো লাগার কারণ, কথার সঙ্গে আমার অবস্থানের দ্বন্দ্ব। আমি অলস প্রকৃতির মানুষ, আলস্য আমার প্রিয়। গানটা শুনলে মনে হয়, আলস্য ঝেড়ে উঠতে হবে। শেষ পর্যন্ত পরেরবার শোনার জন্য ওই ইচ্ছাটি মুলতবি রেখে দিই।

৪. প্রিয় চিত্রকলা

‘আমি ও আমার গ্রাম’
‘আমি ও আমার গ্রাম’

মার্ক শাগালের ছবি

মার্ক শাগালের ‘আমি ও আমার গ্রাম’। ১৯১১ সালে তেলরঙে আঁকা কিউবিস্ট ঘরানার এই ছবিতে শাগাল তাঁর জন্মগ্রামের স্মৃতিগুলো গ্রামীণ দৃশ্যপট, গৃহপালিত প্রাণী আর পরিচিত কিছু মানুষের অবয়বে ফুটিয়ে তুলেছেন। ছবিটাতে স্বপ্নের একটা ছায়া আছে, একটা নিশ্চুপ উদ্বেগেরও। উদ্বেগটা টুপি পরা সবুজ মুখের এক মানুষের উপস্থিতিতে। ছবিটিতে লোকজ ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক শৈলীর মিশ্রণটি অভূতপূর্ব। নিউইয়র্কের মমা-তে এটি চর্মচক্ষে দেখতে পেরে ছবিটা নিয়ে আমার মুগ্ধতা বেড়েছে।

৫. প্রিয় নায়ক

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় , রাজ্জাক
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় , রাজ্জাক

প্রথমে সৌমিত্র, পরে রাজ্জাক

আমার বন্ধু শান্তনু কায়সারের সঙ্গে নায়কের পছন্দ নিয়ে আমার বিস্তর তর্ক হতো। সে ছিল উত্তমকুমারের মহা ভক্ত। আমার পছন্দ ছিলেন সৌমিত্র, পরে রাজ্জাক। আমার পছন্দের বিবর্তন হয়েছে, শান্তনু উত্তম নিয়েই থেকে গেল। বিদেশে পড়ার সময় মাঝেমধ্যে সিনেমা দেখতাম। একসময় মিউনাইট কাউবয়, অল দ্য প্রেসিডেন্টস মেন, ক্রেমার ভার্সাস ক্রেমার ইত্যাদি সিনেমা দেখে ডাসটিন হফম্যানের গুণমুগ্ধ হয়ে পড়লাম। আমার দেখা পশ্চিমা চলচ্চিত্রের নাতিদীর্ঘ তালিকায় হফম্যানের ছবি একটা জায়গা জুড়ে আছে। ছোটখাটো উচ্চতার মানুষটিকে প্রথম দর্শনে নায়ক মনে হবে না, তবে একবার তিনি দৃশ্যপটে হাজির হলে মনে হবে, তিনিই নায়ক। তাঁর অভিনীত ডেথ অব আ সেলসম্যান দেখে মনে হয়েছে এ রকম কুশলী অভিনয়ও তাহলে সম্ভব!