কন্যার চোখে বাবা

‘লিলি, আমি চলে গেলাম। যাওয়ার সময় কিছুই বলে আসতে পারিনি। মাফ করে দিও। আবার কবে দেখা হবে জানি না...মুক্তির পর। তুমি ছেলেমেয়ে নিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে মিশে যেও।’

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা শুরুর দুই দিন পর ২৭ মার্চ স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে এই চিরকুটটি লিখেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী।

মুজিবনগর সরকার পরিচালনা এবং ভেতরের ও বাইরের শত্রুদের নিবৃত্ত করতে যেই মানুষটি মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন, তিনি তাজউদ্দীন আহমদ। এখনো তাঁর সেই কণ্ঠ কানে বাজে, ‘পাকিস্তান আজ মৃত।’ তাঁর ত্বরিত সিদ্ধান্তের কারণেই ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার শপথ নিতে পেরেছিল। এই ব্যতিক্রমী রাজনীতিক সম্পর্কে সহযোদ্ধাদের অনেকে লিখেছেন; বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা গবেষণা করেছেন তাঁকে নিয়ে।

সেদিক থেকে সিমিন হোসেন রিমির আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ ভিন্ন স্বাদের একটি বই। বলা যায় কন্যার চোখে পিতাকে দেখা। তিনি খুব ছোটবেলা থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছেন, তাঁর স্নেহ–ভালোবাসা পেয়েছেন, সেসব বর্ণনার পাশাপাশি তাঁকে ঘিরে যে রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে, তার একটা ছবি আঁকতে চেষ্টা করেছেন। তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তিনিই মুজিবনগর সরকার পরিচালনা করেন। কিন্তু তিনি কখনো কৃতিত্ব দাবি করেননি। বলতেন, তিনি ধাত্রীর ভূমিকা পালন করেছেন মাত্র।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীরা সপরিবার বসবাস করলেও তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। লাখ লাখ মানুষ যখন বাস্তুহারা এবং তরুণেরা রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছেন, তখন তিনিও পরিবার থেকে নিজেকে দূরে রেখেছিলেন। কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে (বর্তমানে শেকস্​পিয়ার সরণি) যেখানে অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রীর অফিস ছিল, তার পাশের ছোট কক্ষে থাকতেন এই বিরল চরিত্রের মানুষটি। যুদ্ধকালে তাঁর সম্বল ছিল একটিমাত্র শার্ট, যা নিজ হাতে ধুয়ে শুকিয়ে তিনি পরতেন।

সিমিন হোসেন রিমি বইটি শুরু করেছেন ৪ নভেম্বর ১৯৭৫-এর বর্ণনা দিয়ে। ৩ নভেম্বর ঘাতকেরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকে আরও তিন জাতীয় নেতার (সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এইচ এম কামারুজ্জামান ও এম. মনসুর আলী) সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদকেও হত্যা করে। ৪ তারিখে তাঁর মরদেহ নিয়ে আসা হয় ধানমন্ডির বাসায়। সিমিনের ভাষায়, ‘আমি অপলকে তাকিয়ে দেখেছি আমার বাবার মুখ। সেই মুখ আমার ছোটবেলাকে বন্দী করে ফেলেছে। হারিয়ে গেছে একসঙ্গে আমার সব।’

পুরো বইটিতে আছে বাবাকে নিয়ে কন্যার টুকরো টুকরো স্মৃতি। অনুভূতি। সেই স্মৃতি জেলখানার ভেতরের ও বাইরের। সেই স্মৃতি স্বাধীনতার আগের ও পরের। এক জন্মদিনে সিমিন বাবার সঙ্গে ময়মনসিংহ কারাগারে দেখা করতে গেলে তিনি তাঁকে টবে মোড়া একটি ছোট্ট চারা উপহার দিয়েছিলেন। আরেকবার সিমিন অন্যের কাছ থেকে শরৎ রচনাবলি ধার করে এনে পড়ছেন জেনে সেই রচনাবলি কিনে দিয়েছিলেন।

সিমিন হোসেন রিমি এমন এক বাবার গল্প বলেছেন, যিনি শুধু রাজনীতিক বা মন্ত্রী নন; একজন অসাধারণ মানুষ। অন্য সবার সঙ্গে থেকেও আলাদা। তাঁর শেষ উক্তি, ‘আমার কাছে আব্বু ছিলেন স্বপ্নের রাজপুত্র। আকাশের তারার মাঝে আমি তাঁকে খুঁজতাম।...তাঁর রেখে যাওয়া কর্মের মধ্য দিয়েই তিনি ফিরে আসবেন বারবার।’

বইটি স্মৃতিচারণামূলক হলেও এতে গবেষণার উপাদান কম নয়। লেখক কারাগারে বাবার সহবন্দী ও কারারক্ষীদের সঙ্গে কথা বলে জেলহত্যার সত্য উদ্​ঘাটনের চেষ্টা করেছেন। ফলে বইটি সাধারণ পাঠকের মনকে যেমন নাড়া দেবে, তেমনি রাজনীতির গবেষকদেরও কাজে লাগবে। ব্যক্তিমানুষ, তাঁর স্বজনের পাশাপাশি দেশব্রতী তাজউদ্দীন আহমদের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যাবে এই বইতে। লেখককে ধন্যবাদ।

ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ

সিমিন হোসেন রিমি

প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: (প্রথম প্রথমা সংস্করণ) ডিসেম্বর ২০১৮, ২৭২ পৃষ্ঠা, দাম: ৪৫০ টাকা।