'কবিতায় প্রতিফলিত হয় জীবন ও জগতের প্রতি কবির অন্তর্দৃষ্টি'

মাসুদ খান। ছবি: সংগৃহীত
মাসুদ খান। ছবি: সংগৃহীত
মাসুদ খানের কবিতার বই প্রসন্ন দ্বীপদেশ সৃজনশীল শাখায় এবার পেয়েছে ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই’-এর পুরস্কার। বর্তমানে এই কবি কানাডাপ্রবাসী। লিখিত এই কথোপকথনে তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর কাব্যভ্রমণের আদ্যোপান্ত। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ


আলতাফ শাহনেওয়াজ: প্রসন্ন দ্বীপদেশ আপনার ষষ্ঠ কবিতার বই। বইটি এবার ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই’ হিসেবে মনোনীত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে দূর কানাডায় বসে, প্রথম যখন খবরটি পেলেন, কেমন ছিল অনুভূতি?

মাসুদ খান: এর আগে কোনো বছরই আমার কোনো বই বর্ষসেরা নির্বাচিত হয়নি। খুব ভোরে অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ টেলিফোন পেলাম। ভালো লাগল তাৎক্ষণিকভাবে। স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের জানালাম, তারা বেশ খুশি। অনেকেই কবি হিসেবে আমাকে জানলেন। তবে এতে বইয়ের বিক্রি আদৌ কিছু বাড়ল কি না, তা অবশ্য জানি না। আমার এই বইটির পাশাপাশি অনুজপ্রতিম প্রিয় কবি ও কথাসাহিত্যিক সুমন রহমানের বইও যৌথভাবে মনোনীত হয়েছে, আমার ভালো লাগার এটাও একটা অংশ।

আলতাফ: জন্মেছেন জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে। বেড়ে উঠেছেন সিরাজগঞ্জে। পরিবারে কি লেখালেখির চর্চা ছিল? কেমন ছিল আপনার লেখালেখি শুরুর দিনগুলো?

মাসুদ: হ্যাঁ, আমার শৈশবও কেটেছে বগুড়া ও জয়পুরহাটের নানা জায়গায়, পিতার কর্মস্থলে। বরেন্দ্র অঞ্চল। শুকনো মৌসুমে সেখানকার কর্কশ লাল মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যায়। ধূলি ওড়ে খরখরে হাওয়ায়। আবার বৃষ্টি হলেই একেবারে কোমল কাদা। আবার আমার কৈশোর ও যৌবনের প্রথমাংশ কেটেছে নরম পলিমাটি-গড়া যমুনা-ধোয়া অববাহিকায়। সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে, মেছড়া গ্রামে, পৈতৃক ভিটেমাটিতে। প্রচুর আলো ও ছায়া, অক্সিজেন, গাছপালা, পশুপাখি, প্রাণবৈচিত্র্য আর প্রাণচাঞ্চল্যমুখর এক জনপদ। নদী সেখানে ভাঙে, আবার গড়ে। তালে-তালে তাই মানুষকেও ভাঙতে হয় অনেক কিছু, গড়ে তুলতে হয় পুনর্বার। প্রকৃতি ও জীবনসংগ্রামের এই সব কড়ি-কোমলের টানাপোড়েন ও মিথস্ক্রিয়া, রৌদ্র-রুদ্র-মেঘ-বৃষ্টি-খর্খরতা-নম্রতার এই সব দোলাচল ও মেলামেশা—এগুলোই হয়তো ছাপ ফেলে আসছিল ক্রমাগত আমার চেতনায়-অবচেতনায়। এভাবেই হয়তো ভেতরে-ভেতরে তৈরি হয়ে উঠছিল একধরনের কাব্যিক বোধ। যদিও পারিবারিক পরিবেশ ছিল পূর্বাপর অকাব্যিক।

আর আমার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল বুয়েটের হল-সাময়িকীতে ১৯৭৯ সালে, তখন আমি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আর জাতীয় পর্যায়ে প্রথম ছাপা হয় অধুনালুপ্ত সচিত্র সন্ধানী পত্রিকায়, ১৯৮৫-তে।

আলতাফ: গত শতকের আশির দশকে আপনারা যখন লেখালেখি শুরু করেছেন, সে সময় বাংলাদেশে ছিল বিবৃতিপ্রধান কবিতার প্রাবল্য। এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে ছোটকাগজের মাধ্যমে একদা বিদ্রোহ করেছিলেন আপনারা। পেছন ফিরে তাকিয়ে এখন সেই সময়গুলোকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মাসুদ: আমি ও আমার সতীর্থরা লিখতে আসি মোটামুটি মধ্য-আশি থেকে। সেটা এমন একসময়, যখন আমাদের মূলধারা-কবিতা পুনরুক্তিপূর্ণ ভাষ্যে, ধ্রুবপদের যথেচ্ছ ব্যবহারে আর তালিকাবয়নের আতিশয্যে হয়ে পড়েছে একঘেয়ে, ক্লান্তিকর। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে প্রবর্তিত সেই বাগবহুল বিবৃতিপ্রধান কাব্যধারাটির ভেতর তখন ক্রমে-ক্রমে জমে উঠেছে প্রাত্যহিক যাপনের উপরিতলের ফেনা, শেওলা ও খড়কুটা। কবিতা হয়ে উঠেছে চটপট করে ফুটতে থাকা পপকর্নের মতো ফোলানো-ফাঁপানো; লজিকের বিপর্যয়ের বদলে কবিতার পদে-পদে লজিকের শৃঙ্খল (অবশ্যই বেশ কিছু উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বাদে)। তা ছাড়া তখন চলছে স্বৈরশাসনবিরোধী জোরদার আন্দোলন। টালমাটাল একটা সময়—দ্রোহ ও উত্তেজনায় কাঁপা। স্বাভাবিকভাবেই কবিতাও হয়ে উঠেছে সোচ্চার।

এ রকম এক প্রেক্ষাপটে আমাদের লেখালেখির শুরু। সে সময় তরুণ কবিদের একটা চেষ্টা ছিল কবিতাকে কবিতার দিকে, সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যের দিকে ফিরিয়ে নেওয়ার। সেই বৈচিত্র্যপূর্ণ কবিতাকৃতি, পরীক্ষা–নিরীক্ষা, উন্মাদনা, অতিরেক—সবকিছুকে বিশেষভাবে ধারণ ও লালন করেছে তখনকার ছোটকাগজ ও সাহিত্যপত্রগুলো। আর আমার কবি হয়ে ওঠাও এই প্রবাহের মধ্যে।

আলতাফ: প্রথম বই পাখিতীর্থদিনেতে দেখা গেল বিজ্ঞান-প্রযুক্তির জগৎ থেকে দেদার নানা প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ কবিতায় আত্তীকৃত করছেন আপনি। ফলে এ বইয়ে আপনার কবিতার স্বর ও সুর খানিকটা অন্য রকম। কোন চিন্তা থেকে সে সময় এমন করেছিলেন?

মাসুদ: বাংলাদেশের প্রচল ধারার প্রতিবেদনধর্মী, ফেনানো কবিতার প্রতি আমাদের একধরনের ক্লান্তি ও বিতৃষ্ণা জেগেছিল। অন্যদিকে বাংলাদেশের বাইরের কবিতার সঙ্গে যখন পরিচিত হতে শুরু করলাম, তখন অবাক হয়ে দেখলাম—রচিত হয়েছে এবং হয়ে চলেছে কত বিচিত্র ঘরানার, বিচিত্র ভাব-ভাষা-শৈলীর কবিতা! আমরা তখন ভাবছিলাম—অচর্চিত, অকর্ষিত, স্বল্পালোকিত আছে কি কোনো ক্ষেত্র, কবিতায়? বাংলা কবিতায়?

আমি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছাত্র। তা ছাড়া মহাবিশ্বের উদ্ভব, পরিব্যাপ্তি, প্রগমন ও বিলয় ইত্যাদি আমার অন্যতম প্রিয় বিষয়। তাই হয়তো সেই সময় থেকেই আমার কবিতায় এষণা ও উদ্ভাস আকারে আসে ব্রহ্মাণ্ডবিদ্যা ও বিজ্ঞানপ্রযুক্তির নানা প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ। আমার কজমিক টোনের কবিতার শুরু সেই পাখিতীর্থদিনে-পর্ব থেকেই।

আলতাফ: প্রথম দিকে, বিশেষ করে পাখিতীর্থদিনে, নদীকূলে করি বাস এবং সরাইখানা ও হারানো মানুষ-এ আপনার প্রবল আত্ম-অনুভূতির ঝলক দেখা গেছে বারবার। এরপর আপনার পরের কাব্যগ্রন্থগুলোতে বেশি মাত্রায় পাওয়া গেল দর্শন তথা দার্শনিক অনুভব। এই যে পর্বান্তর, একে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

মাসুদ: আমি ব্যাখ্যা করতে চাই একটু অন্যভাবে। সাহিত্যচর্চা মূলত এক সামগ্রিক ভ্রমণ, এক অবিভাজ্য পরম্পরা। তারপরও যদি ভাগ করতে চাই, তবে আমি বরং ভাগ করব এভাবে: পাখিতীর্থদিনেকে ফেলব প্রথম পর্বে এবং সরাইখানা ও হারানো মানুষ থেকে সর্বশেষ প্রসন্ন দ্বীপদেশ পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্ব। নদীকূলে করি বাসকে বলতে পারি মধ্যবর্তী এক ট্রানজিশন-পর্ব।

বিচিত্র সব উৎস থেকে আহরণ করা শব্দ ও বিষয়বস্তুর সমাবেশ ঘটেছিল পাখিতীর্থদিনে বইটিতে; ঘটেছিল অনেকটা অনিয়ন্ত্রিত কল্পনারাশির ক্রীড়া ও বিচরণ। সেই সঙ্গে ছিল আধার ও আধেয়গত, ভাষা ও শৈলীগত নিরীক্ষা। মশগুল থেকেছি শব্দের ওজোগুণ আর ধ্বনিঝংকারের প্রেমে। কাব্যের রাশমুক্ত ঘোড়া ছোটানোর সেই বেহিসাবি দিনগুলোতে আমার কাব্যকৃতি হয়তো সুযোগ পায়নি কেলাসিত হওয়ার, অনেক ক্ষেত্রেই। তখনকার অনেক কবিতাতেই ঘটেছে সংগতি ও সুষমাভঙ্গ।

সময় যতই গড়িয়েছে ধীরে ধীরে বদলে গেছে আমার নন্দনভাবনা। দিন শেষে মনে হয়েছে কবিতা বা যেকোনো শিল্প, শেষ পর্যন্ত রূপ-রচনা, সৌন্দর্য-সৃজন—সেই রূপ, যা প্রোজ্জ্বল ও প্রশান্ত, সেই সৌন্দর্য, যা ধারালো অথচ স্নিগ্ধ, যা সংবেদী পাঠকের চিত্তে জাগায় যুগপৎ আনন্দ ও বিস্ময়।

পরবর্তীকালে তাই ধীরে ধীরে অভিনিবেশী হয়েছি কবিতার সুষমা ও সংগতির প্রতি। প্রবণতা ছিল কবিতার ভাবে ও ভাষায়, রূপে ও রীতিতে বৈচিত্র্য আনার, প্রয়াস ছিল কিছুটা সহজ ভাষায় তুলনামূলকভাবে জটিল ভাব প্রকাশের এবং কবিতাকে একধরনের সামগ্রিক অর্থময়তা দেওয়ার। কখনো কখনো কবিতার আধেয়তে যুক্ত হয়েছে কজমো-মেটাফিজিকসের ভাব, কখনোবা সমাজ ও রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ।

আলতাফ: অনেকে এমন বলে থাকেন যে আপনার কবিতায় এই যে দর্শনের সরব উপস্থিতি, ক্ষেত্রবিশেষে তা হাজির হয় একধরনের প্রকল্প হিসেবে। কবিতার কাজ কি দর্শনকে মহিমান্বিত করা?

মাসুদ: কবিতায় প্রতিফলিত হয় জীবন ও জগতের প্রতি কবির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং সেই সঙ্গে তাঁর অন্তর্দৃষ্টিও। সেই দিক থেকে যদি ‘দর্শন’ বলেন, তবে হ্যাঁ, তা প্রতিভাত হয় আমার অনেক কবিতাতেই। কিন্তু একধরনের প্রকল্প হিসেবে ‘দর্শন’ হাজির হয়, এটা হয়তো ঠিক নয়। কবিতার কাজ সৌন্দর্যসৃজন। সেই সৌন্দর্যসৃজনের উপকরণ বা বাহন হিসেবে কখনো কখনো আসতে পারে দর্শনের উদ্ভাস বা দার্শনিক দৃষ্টিপাত।

আলতাফ: আপনার অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের সাপেক্ষে সাম্প্রতিকতম বই প্রসন্ন দ্বীপদেশ-এর বিশিষ্টতা ঠিক কোথায় বলে আপনার মনে হয়?

মাসুদ: এটি আমার সাম্প্রতিকতম বই, সাম্প্রতিকতম উপলব্ধি ও সংবেদনার প্রতিফলন। বইটিতে রয়েছে নানা রকম কবিতার সমাবেশ। প্রেম, প্রকৃতি, মানুষ, সম্পর্ক, বিরহ, অধিবাস্তবতা, সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ। কবিতায় দিতে চেয়েছি অর্থময়তা ও ভাবঋদ্ধতা, সম্ভবত আগের চেয়ে আরও বেশি প্রত্যয়ের সঙ্গে।

প্রসন্ন দ্বীপদেশ
মাসুদ খান
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত
প্রকাশক: পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড, ঢাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৮
৬৪ পৃষ্ঠা, দাম: ১২০ টাকা।

মাসুদ খান
জন্ম ২৯ মে ১৯৫৯, জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলালে।
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা করেছেন সিরাজগঞ্জের মেছরা উচ্চবিদ্যালয় ও সিরাজগঞ্জ কলেজে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক। পরে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।
পেশায় তড়িৎ ও ইলেকট্রন প্রকৌশলী। বর্তমানে কানাডার টরন্টোতে সেন্টেনিয়াল কলেজে শিক্ষকতা করছেন।
ছোটকাগজের মাধ্যমে লেখালেখির সূচনা। প্রথম কবিতার বই পাখিতীর্থদিনে বেরিয়েছিল ১৯৯৩ সালে।
তাঁর অন্যান্য বই নদীকূলে করি বাস, সরাইখানা ও হারানো মানুষ, আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি, এই ধীর কমলাপ্রবণ সন্ধ্যায়, দেহ-অতিরিক্ত জ্বর, প্রজাপতি ও জংলি ফুলের উপাখ্যান ও শ্রেষ্ঠ কবিতা।
প্রথম আলো বর্ষসেরা পুরস্কার পাওয়ার আগে ২০১৭ সালে বাংলা একাডেমি থেকে তিনি পেয়েছেন ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পুরস্কার’, এ ছাড়া ১৯৯৩-এ বগুড়া লেখকচক্র পুরস্কার এবং ধানসিড়ির দেওয়া ‘জীবনানন্দ সাহিত্য পুরস্কার’ পেয়েছেন ২০১৬ সালে।