'তাঁত বাংলাদেশের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের একটা'

শাওন আকন্দ। ছবি: খালেদ সরকার
শাওন আকন্দ। ছবি: খালেদ সরকার
‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই’-এর মননশীল শাখায় এ বছর পুরস্কার পেয়েছে শাওন আকন্দের গবেষণাগ্রন্থ বাংলাদেশের তাঁতশিল্প। এই আলাপনে তিনি মেলে ধরেছেন বাংলাদেশের তাঁত ও তাঁতিদের পূর্বাপর প্রেক্ষাপট। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাহীদ রেজা নূর


জাহীদ রেজা নূর: আপনার বইয়ের আকার দেখেই বোঝা গেছে নিছক একটা বই লিখবেন বলেই এ কাজে হাত দেননি। বড় ধরনের কোনো আগ্রহই আপনাকে দিয়ে বইটি লিখিয়ে নিয়েছে। ব্যাপারটা কি সে রকম?

শাওন আকন্দ: আমি মূলত চারুকলার ছাত্র। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার পর ২০০৪–০৫ সালের দিকে ধামরায় অঞ্চলের কাঁসা-পিতলশিল্প নিয়ে একটা গবেষণা করেছিলাম। এরপর আর গবেষণা করব বলে ভাবিনি। তাঁতের কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে। ওই বইটির পাণ্ডুলিপি কনক আদিত্য দেখেছিল। কনক আমার চারুকলার বন্ধু। তত দিনে ওরা ‘দেশাল’ শুরু করেছে। কনক একদিন বলল, শাড়ির পাড় নিয়ে একটা গবেষণা শুরু করা যায় না? মনে আছে সেদিন আমরা ধ্রুবদার (ধ্রুব এষ) বাড়ি থেকে ফিরছিলাম। বললাম, করাই যায়। কিন্তু আমার সমস্যা তো অনেক। বাড়ি ভাড়া দিতে হয়। খাওয়ার জন্য পয়সা লাগে। কনক বলল, তুই একটা পরিকল্পনা কর, দেখি। পরিকল্পনা করলাম, কনক একমত হলো। একটা দল গঠন করলাম এবং দুটি শর্ত দিলাম। এক. টাকাপয়সার হিসাব দিতে পারব না। দুই. বইটি প্রকাশিত হতে হবে। প্রকাশকের দরবারে দরবারে ঘুরতে পারব না। কনক বলল, যদি শেষ করতে পারিস, আমরাই বের করব। ২০০৭ সালে কাজ শুরু করলাম। আমাদের সঙ্গে তাপস নামে একটি ছেলেও যোগ দিল। একটা ক্যামেরা, একটা ডিজিটাল অডিও রেকর্ডার কিনলাম। আমাদের পুঁজি ছিল সামান্য। দেশালও তখন খুব বড় কিছু নয়। কিন্তু একটা দারুণ ব্যাপার ঘটল, কোনো দিন টাকার জন্য আমাকে দেশালে যেতে হয়নি। মাসের শুরুতে কেউ একজন টাকা দিয়ে যেত। কীভাবে গবেষণা করব, তা নিয়েও কেউ চাপ দেয়নি। কাজে হাত দেওয়ার পরই কেবল বুঝতে পারলাম, কিসের মধ্যে হাত দিয়েছি। বিভিন্ন তাঁত এলাকায় ভ্রমণ করতে করতে সুতার কাউন্ট শিখছি, তাঁতযন্ত্রের করণকৌশল জেনেছি। প্রথমে এক বছরের পরিকল্পনা ছিল। কাজে হাত দিয়ে বুঝলাম, এ বিষয়ে তো কিছুই জানি না। কেন জানি না, তা অনেক পরে বুঝতে পেরেছি। উৎসগত দিক দিয়ে আমি চাষা পরিবারের ছেলে। চাষাদের সঙ্গে জোলাদের পেশাগত কারণেই একটা দূরত্ব আছে। কৃষিজীবী পরিবার থেকে এসেছি বলে যারা তাঁতশিল্পের সঙ্গে যুক্ত, তাদের সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ছিল না। চারুকলায় পড়েছি যখন, ট্যাপিস্ট্রি করতে দেখেছি, জামদানি দেখেছি, কিন্তু তখন ভাবিনি তাঁত নিয়ে গবেষণায় হাত দেব। আমি এমনভাবে কাজ করতে চেয়েছি যেন তাঁতবিষয়ে যিনি কিছুই জানেন না, তিনিও যেন বুঝতে পারেন।

জাহীদ: তার মানে বেশ একটা কঠিন সময় পার করতে হচ্ছিল আপনাকে?

শাওন: হ্যাঁ। বইটা হলো আমার জানার ফল। উৎসাহ ছিল আমাদের এই ইতিহাসটাকে ধারাবাহিকভাবে তুলে আনা যায় কি না। জানতে শুরু করলাম, সুতা কী, রং কী, তাঁতি ব্যাপারটা কী? এটা নিয়ে খুব কম লেখা হয়েছে। তাঁতি বললে যে এক রকম একটা দৃশ্য চোখে ভাসবে, তা নয়। পাহাড়ে, সমতলে বিভিন্ন রকম তাঁতি কাজ করে। যখন কাজের মধ্যে ঢুকে গেলাম, তখন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। এমনও হয়েছে, ৪৮ ঘণ্টা ঘুমাইনি। সাড়ে তিনটা বছর কীভাবে চলে গেল, বুঝতেই পারছিলাম না। সব মিলিয়ে এটা একটা দারুণ অভিজ্ঞতা।

জাহীদ: চারুকলার শিক্ষা কি আপনার গবেষণায় কোনোভাবে কাজে লেগেছে?

শাওন: আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ঔপনিবেশিক প্রভাব বেশ প্রবল। যদিও আমাদের চারুকলার পথিকৃৎ শিল্পীদের কেউ কেউ যেমন জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান প্রমুখ লোকশিল্পকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তার একটা প্রভাব নিশ্চয় চারুকলার শিক্ষায় আছে। তবে আমি আসলে প্রাক-ঔপনিবেশিক জ্ঞান ও সংস্কৃতির দিকে জোর দিতে চেয়েছি। বাংলাদেশের সংস্কৃতি বুঝতে গেলে উপনিবেশ-পূর্ব সংস্কৃতির কাছেই যেতে হবে। উপনিবেশের সময়ও এটা বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। সমাজের তথাকথিত নিচু অংশে তা চর্চিত হয়ে এসেছে। আপনি যদি গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেন, দেখবেন, সেখানে টিকে আছে আলপনা। এখনো অসাধারণ জামদানিশিল্পীরা টিকে আছেন। এমনকি গ্রামের পাশাপাশি শহুরে সংস্কৃতির অঙ্গ রিকশা পেইন্টিংয়েও তা খুঁজে পাবেন। এগুলোতে মানুষের নিজস্বতার প্রকাশ ঘটে। এগুলো যতটা বুঝতে, জানতে ও আত্মস্থ করতে পারব, ততই ভবিষ্যতের পথচলা সহজ হবে। চারুকলায় পড়ার সময় একটা আউটলাইনের ভেতর দিয়ে গেছি, কিন্তু গভীরে যাওয়া হয়নি।

জাহীদ: কেমন ছিল চলার পথটা?

শাওন: কাঁসা-পিতল ও তাঁত নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম এর ভেতরে ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্বের বিষয় আছে। চারুকলায় এগুলো আমরা তেমনভাবে পড়িনি। তাই কাজে নেমে মাঠ সমীক্ষার পাশাপাশি প্রথম ছয় মাস-এক বছর লাইব্রেরিতে ঘুরে ঘুরে পড়তে আরম্ভ করলাম। বন্ধুবান্ধব, ঘনিষ্ঠজনদের বাড়ি থেকেও বই সংগ্রহ করে পড়লাম। অনেকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন। যেমন হায়াৎ মামুদের নিজস্ব পাঠাগারে আমার জন্য ছিল অবারিত দ্বার।

তাঁতের ইতিহাস বাংলাদেশের শিল্পজগতে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের একটা। প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশ যে কারণে পৃথিবী বিখ্যাত, সেটা তো তাঁত—পণ্য এবং শিল্পমূল্য উভয় কারণেই। বাংলা ভূখণ্ড—মূলত ঢাকা—পরিচিতই হয়েছে তাঁতের কারণে। সুলতানি ও মোগল আমলেই তাঁতের কাজ দারুণ উৎকর্ষে পৌঁছেছিল। এই প্রায়–ঔপনিবেশিক জ্ঞান শিল্প–সংস্কৃতি—এসব আমার কৌতূহলের জায়গা ছিল। ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতল বলেন, আর তাঁত বলেন, এটা আমি বুঝতে চেয়েছি প্রাক্​ঔপনিবেশিক ধারার অংশ হিসেবে। আমি আমার মতো করেই করেছি। কোনো সন্দর্ভে এত বড় আকারে সাক্ষাৎকার থাকে না। আমি রেখেছি।

জাহীদ: আপনি প্রাক্​ঔপনিবেশিক সময়ের কথা বলছেন। ব্রিটিশ উপনিবেশের পর সংকটটা কেন দেখা দিল?

শাওন: মূলত পুঁজির কারণে, মুনাফার কারণে। সুলতানি ও মোগল আমলে এ শিল্পের জন্য একটা অনুকূল পরিস্থিতি ছিল। পলাশী যুদ্ধের পরও তাঁতের ব্যবসা ছিল। এরপর ইংল্যান্ডে যখন শিল্পবিপ্লব হলো, সুতা ও কাপড়ের মিলের সূত্রপাত হলো, তখন হাতেচালিত তাঁত ধ্বংস করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। ভারতে সুতা আমদানি হবে, সেটা ছিল অভূতপূর্ব। উনিশ শতকে সে ঘটনাটাই ঘটেছিল। ব্রিটিশ কাপড় কম দামের কারণে বাজার পেল। এ সময় সমাচার দর্পণ পত্রিকায় এক বিধবা সুতা কাটুনির চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল, যার কথা ছিল অনেকটা এ রকম: ‘রানি ভিক্টোরিয়া কি এতই গরিব যে আমার মতো বিধবার পেটে লাথি না মারলে তাঁর চলছে না?’ মূল কথা, শিল্পবিপ্লব, প্রযুক্তি, কম পয়সায় ইংল্যান্ড থেকে ট্যাক্সবিহীনভাবে কাপড় আমদানি আমাদের তাঁতশিল্পকে পথে বসিয়ে দিয়েছিল।

জাহীদ: দেশে তাঁতশিল্পের বর্তমানে অবস্থা কী, আর এ শিল্পের ভবিষ্যৎই–বা কী?

শাওন: দেশভাগের পর বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হলে দেশজ সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ বাড়ে। আটচল্লিশ বা বায়ান্নকে মাইলফলক হিসেবে ধরতে পারি আমরা। পাকিস্তানিরা সংস্কৃতিগতভাবে অনেক কিছুই আরোপ করতে চেয়েছিল, ধোপে টেকেনি। ষাটের দশকে ছায়ানট বর্ষবরণের গান করল রমনায়, লাল পাড় সাদা শাড়ির চল হলো। সত্তর দশকেই মসলিন, জামদানি ইত্যাদিকে সামনে আনার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। আশির দশকের গোড়ায় টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের উত্থান হলো। এই দেশে বাঙালি মধ্যবিত্তশ্রেণি গড়ে উঠছিল। দেশ তো একটা ধারণামাত্র। এটা বাস্তবিক করতে হলে সাংস্কৃতিক নানা উপাদান থাকা লাগে। স্বাধীনতার পর গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এবং গণমাধ্যম এ ক্ষেত্রে একটা ভূমিকা পালন করেছে। নাগরিক রুচির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ তাঁতবস্ত্র পাওয়া যেতে শুরু করল ঢাকা শহরে। ছোট ছোট কিছু পরিবর্তন আনতে হয়েছিল। যেমন গ্রামে নারীরা ১০ হাত শাড়ি পরত, শহরের নারীদের জন্য ১২ হাত করে শাড়ি বোনা হতে লাগল। রংগুলো ক্যাটকেটে না করে শহুরে নারীদের রুচির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করা হলো। এভাবে শহরে তাঁতবস্ত্রের নতুন বাজার তৈরি হলো। ছোট ছোট বুটিক হাউস এল। আড়ং এল। হস্তশিল্পের একটা অনুকূল পরিস্থিতি আশি ও নব্বইয়ের দশকে শুরু হয়ে গিয়েছিল, যা এখনো বিদ্যমান। তবে তাঁতশিল্পের প্রেক্ষাপটে বাজারটা অপেক্ষাকৃত ছোট, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের তাঁতশিল্প নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি যে, পুঁজি ও বাজারব্যবস্থার পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে যারা সংগতি রাখতে পারছে, তারা টিকে থাকছে, যারা পারছে না, তারা হারিয়ে যাচ্ছে। এখন তাঁতশিল্পের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান তুলা, সুতা, রং ইত্যাদির জন্য আমাদের মূলত বাইরের দেশের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু আমাদের আছে নিজস্ব তাঁতি সম্প্রদায়। বাংলাদেশের অসাধারণ দক্ষ তাঁতিরা নানা রকম পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তাঁতশিল্পকে আজও টিকিয়ে রেখেছে। এরাই আমাদের ভরসা। এ দেশের তাঁতিরাই এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখবে।

বাংলাদেশের তাঁতশিল্প
শাওন আকন্দ
প্রচ্ছদ: ইশরাত জাহান
প্রকাশক: দেশাল, ঢাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৮
৪৩৩ পৃষ্ঠা, দাম: ২৪০০ টাকা।

শাওন আকন্দ
জন্ম ১৫ অক্টোবর ১৯৭৫, কুষ্টিয়ায়। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পড়াশোনা করেছেন কুষ্টিয়া জেলা স্কুল ও কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে।
পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে গ্রাফিক ডিজাইনে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। প্রথম গবেষণাগ্রন্থ বাংলাদেশের আধুনিক চারুশিল্পের প্রবণতা বেরিয়েছিল ২০০৪ সালে।
তাঁর অন্যান্য বই ধামরাই জনপদের কাঁসা-পিতল শিল্প, বাংলাদেশের লোকশিল্পের রূপরেখা, বাংলাদেশের সিনেমা-ব্যানার পেইন্টিং: বিলুপ্তপ্রায় শিল্পশৈলী।
এর বাইরে বেশ কয়েকটি বই সম্পাদনা করেছেন তিনি। বর্তমানে তিনি ঐতিহ্যবাহী ও সমকালীন শিল্পকেন্দ্র ‘যথাশিল্প’-এর পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন।