'সমসাময়িক জীবনের বিপন্নতাটুকু বোঝার চেষ্টা করি'

সুমন রহমান। ছবি: খালেদ সরকার
সুমন রহমান। ছবি: খালেদ সরকার
এ বছর ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই’–এর সৃজনশীল শাখায় পুরস্কৃত হয়েছে সুমন রহমানের গল্পের বই নিরপরাধ ঘুম। তিনি কথা বলেছেন তাঁর গল্পের জগৎ নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ


ফারুক ওয়াসিফ: এবারে ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই’ পুরস্কারপ্রাপ্ত আপনার গল্পের বই ‘নিরপরাধ ঘুম’সহ আপনার আরেকটি গল্পগ্রন্থ—দুটির দিকে চোখ ফেরালে দেখা যাবে এগুলো যাকে বলে নির্জলা গল্প তা না। গল্পটা জমে ওঠে চরিত্র ও পরিস্থিতিকে মাথা খাটিয়ে দেখার মধ্য দিয়ে। এটা কি আপনাকে বাংলা গল্পের গড় ঐতিহ্যের বাইরে ঠেলে দেয় না?

সুমন রহমান: বাংলা গল্পের ঐতিহ্যের মধ্যে থাকা না-থাকা নিয়ে খুব গভীরভাবে ভাবিনি আমি, নিজের গল্পগুলো লিখতে চেয়েছি মাত্র। তা যদি বাংলা গল্পের ঐতিহ্যের ওপর এ রকম বাড়তি চাপ তৈরি করে, সেক্ষেত্রে ঐতিহ্যটাকে একটু বড় করে ভেবে নিলেই হয়। আমার ধারণা, বাংলা গল্পের মধ্যে এরকম চিন্তাশীলতার নমুনা আছে। নির্জলা গল্প অনেকেই বলতে চাননি। তবে জলযোগের ধরনধারণ একেকজনের একেক রকম হয়তো।

ফারুক: ‘নিরপরাধ ঘুম’–এর গল্পগুলো ‘আত্ম’ হারিয়ে ফেলা মামুলি মানুষ, পুরুষের বাসনা কিংবা জীবনের জটিলতার কোনো গিঁট থেকে সুতা টেনে বোনা। এসব কি সময়ের বিপন্ন করুণ বিস্ময় ধরার চেষ্টা, নাকি জীবনের কোনো অর্থ আছে কি না তা খতিয়ে দেখা?

সুমন: দুটোই সম্ভবত। প্রথমত সমসাময়িক জীবনের বিপন্নতাটুকু বোঝার চেষ্টা করি। তার কোনো অর্থ আছে কি না খতিয়ে দেখতে চাই। এই যে ভোগান্তিভরা জীবন—নৈতিকতা কিংবা নানা ধরনের মতাদর্শের ইউটোপিয়া দিয়ে এযাবৎকাল তার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু মতাদর্শ-উত্তর দুনিয়ায় এই রাশি রাশি ব্যাখ্যা অর্থ হারিয়ে ফেলল যে! ফলে গল্প বয়নের একটা অত্যন্ত জনপ্রিয় রেসিপি একেবারে আউটডেটেড হয়ে গেছে। প্রখর বাস্তবতার বহুবিধ ডাইমেনশন বা মাত্রার কাছে ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে নানাবিধ মতাদর্শ। আবার প্রখর বাস্তবতা জিনিসটাও একান্তভাবে কারও না কারও পারসিভ করারই বিষয়। এমন অবস্থায় নির্জলা গল্প বলা নিতান্ত মুশকিল। কারণ কোনো গল্পই নির্জলা নয়। বয়ানের ভঙ্গি থেকেই কাহিনি তৈরি হয়। তার সঙ্গে বাস্তবতার যোগাযোগ কোন পরিসরে ঘটে, বা আদৌ ঘটে কি না—এটা জানতে পারলে বেশ হতো। কিন্তু জানা যায় না। অধরা থাকে এসব। এই অধরা থাকার ভাগ্যই আমাকে গল্প লেখায়।

ফারুক: কিন্তু ধরুন, অতীতের যে গল্পগুলো আজও আমাদের টানে, সেগুলো তো অনেকটা ভরপুর গল্পই। সেটা হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহিরই বলি অথবা এডগার অ্যালান পো, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, হারুকি মুরাকামি। অনেক ব্যাখ্যা বা চিন্তা অপ্রতুল হয়ে গেলেও বিশ্বসাহিত্যের এলাকায় সেসবের ছায়ালাগা অনেক লেখকই কিন্তু তেজস্ক্রিয়ভাবেই টিকে আছেন।

সুমন: গল্পের চেয়ে গল্পের কথন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মার্কেসের বা মুরাকামির গল্প তাঁদের কথনের জন্যই বিশিষ্ট। শহীদুল জহিরের ক্ষেত্রেও কথনের বিষয়টি আলোচিত/সমালোচিত। আমি আপনার তালিকা থেকে পো আর ইলিয়াসের নাম নিলাম না, তার অর্থ এই না যে তাঁদের কথন ছিল না বা প্রমিন্যান্ট ছিল না। খেয়াল করলে দেখা যাবে, ইলিয়াসের গল্পের পরতে পরতে যে নিষ্ঠুরতা আছে এটাই তাঁর সিগনেচার। অ্যালান পো থেকেও এমন ন্যারেটিভ ভঙ্গি খুঁজে নেওয়া সম্ভব। সব মিলিয়ে, আমার ধারণা হলো, গল্পটা গুরুত্বপূর্ণ যতখানি, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ গল্পের বয়ান বা কথন। আমি অবশ্য গল্পের কথককেও খুব গুরুত্ব দিই। যেমন, একটি গল্পে অনেক চরিত্র আছে, কিন্তু গল্পটি কে বলবে সেটি আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এমনকি যদি উত্তম পুরুষে বলা গল্পও সেটি হয়, তাহলেও এই উত্তম পুরুষ অবধারিতভাবে গল্পকারই হবে এমন না। এগুলো আমার কাছে খুব জরুরি ফয়সালা। এসব না মিলিয়ে আমার পক্ষে একটা গল্প লিখে ফেলা কঠিন।

ফারুক: ২০০৮–এর ‘গরিবি অমরতা’ আর ২০১৮–এর ‘নিরপরাধ ঘুম’–এর গল্পের চেহারা ও ইশারা প্রায় একই রকম মনে হতে পারে। দুটি বইয়ের বিশিষ্টতা কীভাবে চিহ্নিত করবেন?

সুমন: এ নিয়ে আমি অবশ্য পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাচ্ছি। অনেকে বলেন, গরিবি অমরতা থেকে নিরপরাধ ঘুম অনেকখানি আলাদা। গরিবি অমরতা ‘স্পনটেনিয়াস’ এবং নিরপরাধ ঘুম ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ ইত্যাদি। তা ছাড়া ভাষার ব্যবহারেও দুটি বই দুরকম। আপনি বলছেন, দুই বইয়ের চেহারা ও ইশারা একই রকম। আমি অবশ্য এ–বিষয়ক ভাবনাচিন্তা সমালোচকদের হাতেই ছেড়ে দিতে চাই। নিজের পরিবর্তন বা অপরিবর্তন অন্ততপক্ষে স্থিতিজড়তা কিংবা গতিজড়তার কারণেই টের পাওয়া একটু কঠিন। আমার কাছে যেটুকু স্বস্তিদায়ক সেটি হলো, নিরপরাধ ঘুমকেও পাঠক গরিবি অমরতার লেখকের সৃষ্টি হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

ফারুক: আপনার গল্পকে ইনটিমেট–সাইকোথ্রিলার, অর্থাৎ অন্তরঙ্গ–মনোবিকারজাত রোমাঞ্চ কাহিনি বলা যাবে?

সুমন: সাইকোথ্রিলার আমার পছন্দের জাঁরা, কিন্তু আমি সেই অর্থে কোনো সাইকোথ্রিলার লিখতে পেরেছি বলে মনে হয় না। লিখতে যে চেয়েছি, তা–ও নয়। থ্রিলারের গতি, প্লট টুইস্ট এবং ক্লিফ হ্যাঙ্গার আমার পছন্দের জিনিস। আবার আমার কনটেন্ট অনেকখানি ক্ল্যাসিক্যাল বলে আমার অনুমান। এর ফলে একধরনের এসথেটিক হাইব্রিডিটি ঘটতে পারে। যদি সেটা ঘটে (আমি নিশ্চিত না), সেটাও বিশ্বসাহিত্যে অভিনব কিছু না।

ফারুক: আপনার গল্পে স্বাচ্ছন্দ্য হারানো যে চরিত্রেরা পাঠকের মধ্যে বেদনাবোধ ও অস্বস্তি তৈরি করে—তাদের আপনি কোথা থেকে সংগ্রহ করেন, কোন বাস্তবতা থেকে?

সুমন: সম্ভবত আমার জীবনের আদিগন্ত স্বাচ্ছন্দ্যহীনতা থেকে। গল্পের চরিত্র দিয়ে বাস্তবের চরিত্রকে পড়া যেতে পারে, কিন্তু দুটোকে মিরর ইমেজ মনে করা বিপজ্জনক। জীবন কিংবা বাস্তবতা অছিলা মাত্র। সাহিত্য জীবনের সমান্তরাল একটা জিনিস। তার যে বাস্তবতা, সেটা সিমুলেটেড। ফলে ক্রসফায়ারে যে মরে গেল বা গেল না, সে আমি। রোহিঙ্গা কিশোরটিও আমি। সুপারহিরো পরিবার আমারই পরিবার। টিভি স্টেশনের রিসেপশনিস্ট কিংবা হাবা যুবক—সব চরিত্রের মধ্যেই খণ্ড খণ্ডভাবে আমি অধিষ্ঠান করি। আমার চিন্তা অধিষ্ঠান করে।

ফারুক: সাহিত্যে সামাজিক বা রাজনৈতিক দায়ের কথা প্রায়ই অস্বীকার করেন আপনি। অথচ আপনার গল্পগুলোতে ধরা পড়ে সেই সমাজ–রাজনৈতিক মাড়াইকলে পিষ্ট হওয়া মানুষগুলোর প্রতি মমতা। তাহলে কি আপনার বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান এবং সাহিত্যকর্মের অভিমুখ আলাদা?

সুমন: সামাজিক বা রাজনৈতিক দায়বোধের নামে রচিত ‘ফর্মুলা সাহিত্য’ আমার বিশেষ অপছন্দের জিনিস। কারণ এই সাহিত্যের সর্বাঙ্গে একটা অতিমহৎ হামবড়া ভাব থাকে। যেন, সাধারণ মানুষের কথা লিখিত হয়েছে বলেই তাকে প্রশংসা করতে হবে। এ রকম একটা চর্চা বাংলা সাহিত্যে দীর্ঘদিন আছে। এর থেকে বাইরে যাওয়া দরকার। দায়বোধের এই ইনস্ট্রুমেন্টালিজম নিয়ে সতর্ক হওয়া জরুরি। ফলে, আমার চিন্তা ও সৃজনপ্রণালির অভিমুখ একেবারেই ভিন্ন নয়; বরং আমি এটাই বলতে চেয়েছি। দায়বোধের বটিকা আলাদা করে বেচবার কিছু নেই। সত্যিকারের সাহিত্য সব সময়ই দায়বদ্ধ। সুন্দরের কাছে, সমাজের কাছে।

ফারুক: অনেকে মনে করেন শিল্প আলাভোলা মনের কাজ, চিন্তাশীলতার উল্টোদিকে তার মুক্তি। আপনি কবিতা, প্রবন্ধ ও কথাসাহিত্য এবং শিক্ষকতা—অনেক কিছুই করছেন। আপনি কি শিল্পের ওই বিশুদ্ধতাবাদী নসিহতের সঙ্গে একমত?

সুমন: এ রকম আজকাল মনে করে নাকি লোকজন? আমার তো মনে করার কোনো সুযোগই নেই; যেহেতু আপনি এর মধ্যে বলেই দিয়েছেন যে আমি কবিতা, কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধ সবকিছুই করি। আমি তথাকথিত সৃজনশীল ও মননশীল বিভাজনে বিশ্বাস করি না। আমার কবিতা বা গল্পের মধ্যে মননশীলতা যেমন থাকে, তেমনি সৃজনশীলতার ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে প্রবন্ধ লেখাও আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

ফারুক: আপনার ২০১৯–এর সাহিত্যিক পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু বলবেন?

সুমন: নানাবিধ পরিকল্পনা আছে। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতেই একটা কাব্যগ্রন্থ বেরোবার কথা। এ ছাড়া দুটো প্রবন্ধগ্রন্থের ওপর কাজ করব গোটা বছর ধরে। একটি সাহিত্যবিষয়ক, অন্যটি ভাটি বাংলার ভাবসাধনা–বিষয়ক। গল্প দুয়েকটা লেখা হতে পারে, পরিকল্পনার বাইরে। এমনকি হয়তো উপন্যাসের চক্করেও পড়ে যেতে পারি এ বছর! এমনও হতে পারে, যাকে আমি প্রবন্ধ আকারে লিখব ভেবে রেখেছি, সেটাই উপন্যাস হয়ে বেরোল!

নিরপরাধ ঘুম
সুমন রহমান
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৮
৯৬ পৃষ্ঠা, ২০০ টাকা।

সুমন রহমান
জন্ম ৩০ মার্চ ১৯৭০, কিশোরগঞ্জের ভৈরবে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা করেছেন ভৈরবের সরকারি কেবি উচ্চবিদ্যালয় ও হাজি আসমত কলেজে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।
পরে অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ড থেকে সংস্কৃতি অধ্যয়নে পিএইচডি করেছেন ২০১৩ সালে।
কবিতার মাধ্যমে লেখালেখির শুরু হলেও গল্প, প্রবন্ধ, গবেষণা—নানা মাধ্যমে তিনি সক্রিয়।
প্রথম কবিতার বই ঝিঁঝিট বেরিয়েছিল ১৯৯৪ সালে। তাঁর অন্যান্য বই গরিবি অমরতা, সিরামিকের নিজস্ব ঝগড়া ও কানার হাটবাজার।
কমনওয়েলথ ছোটগল্প পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় প্রথম বাংলা ভাষার লেখক হিসেবে স্থান পেয়েছিল তাঁর গল্প নিরপরাধ ঘুম। বর্তমানে তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক।