গুণী ব্যক্তি, সাফল্য আর শিক্ষকতা

শওকত ওসমান (২ জানুয়ারি ১৯১৭—১৪ মে ১৯৯৮)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
শওকত ওসমান (২ জানুয়ারি ১৯১৭—১৪ মে ১৯৯৮)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

গুণী মানুষেরই কদর করে মানুষ, এ রকম স্বতঃসিদ্ধ ভাবনার কোনো মূল্য নেই। আসলে মানুষ স্তব করে সফল মানুষের, গুণী মানুষের নয়। তবে সফল মানুষও গুণী মানুষ হতে পারে—এ কথা ভুলে যাচ্ছি না।

কেন এই প্রসঙ্গটি এল, তা বলব একেবারে শেষে। তার আগে যাঁকে নিয়ে এই লেখা ফাঁদা, সেই শওকত ওসমানকে নিয়ে বিচ্ছিন্ন কিছু কথা বলে নিই।

প্রচণ্ড প্রাণশক্তির পূর্ণ ব্যবহার করে বেঁচে ছিলেন তিনি। আয়ু পেয়েছিলেন দীর্ঘ (১৯১৭–১৯৯৮)। দারিদ্র্য, আঘাত ইত্যাদি তাঁকে খুব একটা কাবু করতে পারেনি। তাঁর জীবনের কোনো কোনো কাহিনি পড়ে বিস্মিত হই। শিল্পীর জীবন যে আটপৌরে জীবনের চেয়ে একেবারে অন্য কিছু, সে কথাই সত্য হয়ে ওঠে। সাধারণ বিচারে শিল্পীকে বিচার করা যায় না।

শওকত ওসমানের পুত্রবিয়োগ হয়েছে। বিধ্বস্ত তিনি। মোমেনবাগের বাড়িটি তখনো পুরো তৈরি হয়নি। পাথরের মতো স্থির হয়ে সেই বাড়ির সবুজ মাঠে চেয়ারে বসে ছিলেন তিনি। তাঁর একটি হাত ধরে ছিলেন আবু জাফর শামসুদ্দীন। এ সময় সেখানে এলেন শামসুর রাহমান আর সৈয়দ শামসুল হক। লাশ দাফনের আগে মৌনতা। কিন্তু শওকত ওসমানের কোলে রাহমান ও হকের হাত পড়তেই ঝরঝর কান্না। সে কান্না সংক্রমিত হলো উপস্থিত মানুষের কণ্ঠে। শামসুর রাহমান আর সৈয়দ শামসুল হক বিদায় নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। এ সময় শওকত ওসমান বলে উঠলেন, ‘শামসুর রাহমান দাঁড়াও, তুমি যে আদ্রে জিঁদের বইখানা চেয়েছিলে একদিন, এসেছ যখন নিয়ে যাও।’

হতবাক হলে শামসুর রাহমান কথা বলতে পারতেন না, বিড়বিড় করতেন কেবল। তাঁর ‘থাক না, থাক’ বলাকে আমলেই নিলেন না শওকত ওসমান। বললেন, ‘জীবনে শোক–দুঃখ থাকবেই, আসবেই, তাই বলে আমাদের সব কি থেমে থাকবে?’

ফেরার পথে রায়সাহেব বাজার পর্যন্ত একসঙ্গে এসেছিলেন দুই কবি, কিন্তু কারও মুখে একটা কথাও ফোটেনি আর।

এ রকম আরেকটি ঘটনা। সে–ও মৃত্যুবাড়ির। মারা গেছেন কবি সানাউল হক। জানাজায় যাওয়ার জন্য সবাই প্রস্তুত। শওকত ওসমান তখন জনকণ্ঠ পত্রিকায় ‘শেখের সম্বরা’ লেখেন। প্রতিদিন ভোরে পরিচিতজনদের ফোন করতেন, বলতেন, ‘সুপ্রভাত ভ্রাতঃ, প্রাতঃস্মরণীয় হও।’ পকেটে রাখতেন শেখের সম্বরার ফটোকপি। প্রীতিভাজনদের মধ্যে তিনি বিলিও করতেন ‘শেখের সম্বরা’।

সানাউল হকের বাড়ি এসেছেন শওকত ওসমান। হঠাৎ করেই পকেট থেকে শেখের সম্বরার ফটোকপিগুলো বের করে পরিচিতজনদের মধ্যে বিলাতে শুরু করলেন। আনিসুজ্জামান তাঁর হাত ধরে বললেন, ‘শওকত ভাই, এখানে নয়।’

শওকত ওসমান তাতে কিছু মনে করেননি। তিনি জানতেন, কাদের তিনি স্নেহ করেন এবং কারা তাঁকে শ্রদ্ধা করে। বয়সের কারণে কখনো কখনো স্থান–কাল–পরিবেশ বুঝে উঠতে সময় নিতেন।

রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন হবে খুলনায়। সেখানে চলেছেন শওকত ওসমান। সঙ্গে আছেন কামরুল হাসান, সন্​জীদা খাতুন, শামসুর রাহমান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, ইফফাত আরা দেওয়ানসহ অনেকে। গোয়ালন্দ থেকে ছিল ট্রেন। সেই ট্রেনের কামরার একদিকে নাগরিক তাদের অচলায়ন নাটকের মহড়া করছিল, অন্যদিকে ওয়াহিদুল হক বসেছিলেন গানের মহড়ায়। আলী যাকেরকে ডেকে কামরুল হাসান বললেন, নূরলদীনের সারাজীবন নাটকে নূরলদীনের হাঁকটা হয়নি। ওটা হবে রায়বেঁশের ডাকের মতো।’

সম্মেলনে শওকত ওসমান তাঁর লিখিত ভাষণ পড়তে পারলেন না। কারণ, জনপ্রিয় টেলিভিশনের অভিনয়শিল্পী এসেছেন। দর্শকেরা হামলে পড়েছে তাঁর দিকে। এমনকি মঞ্চে ওঠার আগে শওকত ওসমান, কামরুল হাসান যখন বসে ছিলেন চেয়ারে, তখন তাঁদের পা মাড়িয়ে অটোগ্রাফশিকারিরা চলে যাচ্ছিল অভিনয়শিল্পীর দিকে! তাই সভাপতির ভাষণ আর কে শোনে? শওকত ওসমান বোঝাতে চাইছিলেন এই কথা বলে, ‘আমি একজন শিক্ষক!’ কিন্তু কে শোনে কার কথা। দর্শকেরা তখন জনপ্রিয় নাট্যশিল্পীর নাটক দেখার অপেক্ষায়।

শওকত ওসমান গুণী মানুষ ছিলেন, সন্দেহ নেই। সফলও তো ছিলেন সাহিত্যবিচারে! কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে সেই সাফল্য বা গুণ কোনো কাজে লাগেনি। টেলিভিশনশিল্পীই ছিলেন তাদের আরাধ্য।


সূত্র: সৈয়দ শামসুল হকের হৃৎকলমের টানে, আনিসুজ্জামানের বিপুলা পৃথিবী, নওয়াজেশ আহমদের দুই মহীরুহের কথা ও কথাশিল্পী শওকত ওসমান জন্মশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ।